সূচনা:-
কেমন আছেন বন্ধুগণ?শিউলি ফোটার দিন তো ফুরোলো!
আমের বোলের গন্ধ পাচ্ছেন কি? তাপিত প্রাণে ক্লান্ত কোকিল ডাকে। তাই দারুন অগ্নিবানের আগে চলুন কবি ও কবিতার পরিভ্রমনে বেরিয়ে আসি। আজ কোন কবির কাছে যাওয়া যায় ভেবেছেন ? গত রবিবারে ছিল মাতৃ দিবস। মা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দ। কি যেন এক মাধুরী মাখানো আছে এই শব্দ জুড়ে ! এই একটিমাত্র শব্দ দিয়ে বোধহয় অন্তহীন কথা লেখা যায় ! হাজার কথাতেও যেন এর শেষ নেই ! প্রথমেই মনে পড়ে রাশিয়ার লেখক 'গোর্কি'র 'মাদার '। মাতাল স্বামীর অত্যাচারে 'পাভেল' এর  এই বিপন্ন শ্রমজীবী মা হাতুড়ি দিয়ে তীব্র আঘাত হেনেছিল তার স্বামীকে। মা পেলেগেয়া প্রথমে গেলেন ভয় পেয়ে।  কিন্তু নিজেকে পাল্টে ফেলে এসে দাঁড়ালেন পুত্রের পাশে।  বাস্তব চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে এই উপন্যাস।  বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সর্বপ্রথম তিনি পাঠকদের কাছে হাজির করলেন এক শ্রমজীবী মা কে ও তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রাম নিয়ে ! সন্তানের নাম ছিল 'পাভেল' ! গল্পের প্রথমদিকে লেখক দেখালেন ভীরু মা ।  পুত্রকে গ্রেফতার করা হলো ! আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সকল মায়েদের প্রতি তার দীপ্ত ধ্বনি উচ্চারিত হলো "দুনিয়া এগিয়ে চলেছে।আমাদের সন্তানেরা তাদের ছড়ানো আলোয় আলোকিত হবে বিশ্ব। আমার পুনরুজ্জীবিত আত্মাকে মারতে পারবেনা ওরা" ! সেই থেকে 'পেলেগেয়া" হয়ে গেলেন সকলের মা !


তাই আজ ইচ্ছে হলো, আজ ঠিক এমন ই একজন সাহসিনী মাতৃরূপিণী কবিকে আপনাদের সামনে হাজির করবো যার নাম বেগম সুফিয়া কামাল।


শুরু করবো এই দুর্দান্ত বিদ্রোহের জননী কবির একটি সাহসিকতার দৃষ্টান্ত দিয়ে।


১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'নারীকল্যাণ সংস্থা' এবং 'পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি'-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এই বৎসরে পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব তীব্রতর হয়ে উঠে। এই সময়ে  তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বুদ্ধিজীবীদের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। আইয়ুব খানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'আপনি সব শুনুন এবং এর একটা সমাধান করে দিয়ে যান'। আইয়ুব খান উদ্ধত কণ্ঠে তাঁর কথার জবাব দিলেন, 'ওধার তো সব ইনসান হ্যায়, এধার তো সব হাইওয়ান' (ওদিকে তো সব মানুষ, এদিকে তো সব জানোয়ার)। বেগম সুফিয়া কামাল আইয়ুব খানের মুখের উপর তীব্র ভাষায় উত্তর ছুঁড়ে দিলেন, 'আপ তো উও হাইওয়ানকৌ প্রেসিডেন্ট হ্যায়' (আপনিত সেই জানোয়ারদেরই প্রেসিডেন্ট)।


যিনি এই ধরণের উত্তর ছুড়ে দিতে পারেন একটি দেশের প্রেসিডেন্টের মুখের ওপর, তাকে সাহসী জননী ছাড়া আর কি বলবো? এতো সেই নজরুলের ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবার মতো!! তাই তো তিনি ছিলেন নজরুলের প্রিয়।


সুফিয়া কামালের বিখ্যাত একটি উক্তি যা চিরদিন নারী চেতনা কে করে রেখেছে জাগ্রত।
‘নারীমুক্তি মানেই মানবমুক্তি’


বাংলায় নারী জাগরণের কথা এলে প্রথমেই যে নামটি আমাদের মানসপটে জ্বলজ্বল করে ওঠে তিনি মহীয়সী নারী সুফিয়া কামাল। পরাধীন দেশে নারীকে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তিনি অগ্রগণ্য। অন্যায়, অসত্য আর অশিক্ষার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অগ্রদূত, নিরন্তর সংগ্রামী
ক্রম পঞ্জিকা:-
জন্মঃ
১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময়ে বাঙ্গালি মুসলিম নারীদের কাটাতে হত গৃহবন্দি জীবন। স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিলো না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। ঐ বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থান পতনের মধ্যে তাঁর মা সাবেরা বেগমের কাছে বাংলা পড়তে শেখেন। মাত্র বার বছর বয়সে তাঁকে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন।তিনি সুফিয়া কামালকে সাহিত্যপাঠে উৎসাহিত করেন।
১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তাঁর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তাঁর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের একটি রচনার কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম :-
"জাগো মাতা ভগিনী কন্যা - ওঠো শয্যা ত্যাগ করিয়া আইস,অগ্রসর হও। ওই শুনো মোয়াজ্জিন আজান দিতেছেন।তোমরা কি ঐ আজান-ধ্বনি, আল্লাহার ধ্বনি শুনিতে পাওনা? আর ঘুমাইও না,এখন আর রাত্রি নাই, এখন সুবেহ-সাদেক--মোয়াজ্জিন আজান দিতেছেন। সমগ্র নারী জাতি জাগিয়া উঠিয়াছে ............................... আমরা বঙ্গনারী গৃহকারাগারে স্যাঁতসেতে মেজেতে পড়িয়া অঘোরে ঘুমাইতেছি ......."  
১৯২৫: 'মাতৃমঙ্গল' নামক সংগঠনের তিনি একমাত্র মুসলিম সদস্য ছিলেন। গান্ধীজী বরিশালে এলে সুফিয়া খাতুন হিন্দু মহিলাদের সাথে, তাঁদের মতো কাপড় পরে কপালে সিঁদুর দিয়ে প্রকাশ্য সভায় নিজের হাতে-কাটা সুতা গান্ধীজীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
১৯২৬ :  'সওগাত' পত্রিকাতে তাঁর প্রথম কবিতা পাঠান। কবিতাটির নাম 'বাসন্তী'।
আমার এ বনের পথে
কাননে ফুল ফোটাতে
ভুলে কেউ করত না গো
কোনদিন আসা-যাওয়া।
সেদিন ফাগুন-প্রাতে
অরুণের উদয়-সাথে
সহসা দিল দেখা
উদাসী দখিন হাওয়া।...
বুকে মোর চরণ ফেলে
বধুঁ মোর আজকে এলে
আজি যে ভরা সুখে
কেবলই পরাণ কাঁদে।
(আমার মন্তব্য :
কবিতাটি পড়ে মন প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়)
১৯২৭: কাজী নজরুল ইসলামকে সাহায্য করার জন্য সওগাত পত্রিকার সম্পাদক নাসিরুদ্দিনকে এক চিঠিতে অনুরোধ জানান।
১৯২৮: পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে প্রথম বাঙালি মুসলমান নারী হিসাবে বিমানে উড্ডয়ন করেন। তাঁর কাজের জন্য বেগম রোকেয়া তাঁকে বিশেষভাবে অভিনন্দিত করেন
১৯২৯: তিনি 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীন ইসলাম'-এর সদস্যা হয়ে কাজ শুরু করেন। এই বৎসরে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যান। রবীন্দ্রনাথে তাঁকে তাঁর রচিত 'গোরা' উপন্যাস উপহার হিসাবে দেন।
১৯৩১:  ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশন-এর প্রথম মহিলা সদস্যা মনোনীতা হন।
১৯৩২: স্বামী নেহাল হোসেনের মৃত্যু। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগ। ১৯৩৩ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন এডুকেশন অফিসার শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নিজ উদ্যোগে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে সুফিয়া খাতুনকে শিক্ষকতার চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন।
১৯৩৭ : তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'কেয়ার কাঁটা' প্রকাশিত হয়।
১৯৩৮ : প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ 'সাঁঝের মায়া'।
উল্লেখ্য কবি বেনজীর আহমদ নিজ খরচায় 'কেয়ার কাঁটা' ও 'সাঁঝের মায়া' প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং লেখক-সম্মানীর ব্যবস্থাও করেছিলেন। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে 'সাঁঝের মায়া'র ভূমিকা লিখে সুফিয়ার সাহিত্যিক মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৬১ :পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দেওয়া 'তঘমা-ই-ইমতিয়াজ' প্রত্যাখ্যান করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।


মহাপ্রয়াণঃ
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।


রচনাঃ
কাব্যগ্রন্থ
সাঁঝের মায়া (১৯৩৮)
মায়া কাজল (১৯৫১)
মন ও জীবন (১৯৫৭)
শান্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮)
উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪)
দিওয়ান (১৯৬৬)
মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)


পুরস্কারঃ
সুফিয়া কামাল ৫০টির বেশী পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মাঝে কয়েকটিঃ
বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২)
সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০)
একুশে পদক (১৯৭৬)
বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯২)
জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫)
দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬)
স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯৭)


উপসংহার:-
আমার এই প্রবন্ধ শেষ করার আগে প্রখ্যাত সংগীত রচয়িতা ও সংগীত শিল্পী সুমন কবিরের মুখে আসুন একটি আবেগ ভরা গল্প শুনি:-
বেগম সুফিয়া কামালের দর্শন আমি জীবনে প্রথম পাই ১৯৯৬ সালে; আমার প্রথম সঙ্গীত সফরে বাংলাদেশে- যখন আমি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য তহবিল তুলতে গিয়েছিলাম।  আমার বাংলাদেশের বন্ধুরা যখন নিয়ে গেলো তার বাড়িতে আমার এটা প্রথম উদ্ঘাটন হলো যে আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিন সাক্ষাৎ আমার মা। আমি দ্বিতীয়বার এক মায়ের দর্শন পেলাম। আমার প্রথম মা উমা চট্টোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় মা বেগম সুফিয়া কামাল।
মাটিতে পায়ের কাছে বসে পড়লাম। কোনোদিন তাকে আগে দেখিনি। তিনি আমায় আদর করছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর আমিও তাকে আদর করছি। আমিও…! ছেলেরা যেমন মায়ের সঙ্গে করে। আমি তার গাল টিপে দিচ্ছিলাম। অতো মিষ্টি একজন মানুষ যে হতে পারে আমার জানা ছিল না। ঠিক আমি নিজের মাকে যেভাবে আদর করতাম সেভাবে আমি খালাম্মাকে আদর করেছি। বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের খালাম্মা, মাসি মা। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি হলেন ‘নানি’।
বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন সারা পৃথিবীর মানুষ। তার ওপর গান লিখে আমি প্রথম গেয়েছিলাম বাংলাদেশেই। ১৯৯৮ বাংলাদেশে আমার দ্বিতীয় সঙ্গীত সফরে, মিরপুর স্টেডিয়ামে।


ওই তো লক্ষ ছেলেমেয়ে
নাতিনাতনি দামাল
সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে
সুফিয়া কামাল
এক একটা দেশ থাকে মানচিত্রেই শুধু রাখা
কারুর নয়নে থাকে স্বদেশের ছবিখানি আঁকা
আমি সেই স্বদেশের ছবি দেখি আপনার মুখে
সুফিয়া কামাল মানে বাংলাদেশের ছোঁয়া বুকে।
মাটিতে পায়ের কাছে বসেছি ধুলোর মতো আমি
পৃথিবীকে চুমু খায় গানে গানে আমার বোকামি
বোকারাই গান লেখে, গান বাঁধে, গান গেয়ে মরে
এবার মরলে আমি জন্মাব আপনার ঘরে।
আপনার ঘর মানে ঘর আর বাইরের মিল
ভাষার থালায় ভাত খেতে বসে অপার নিখিল
কারা ভাত কেড়ে নেয় সাবধান সামাল সামাল
ভাত মানে ভাষা আর খালাম্মা সুফিয়া কামাল।


আমার ভাবতে গর্ব হয়, আমার গর্ভধারিণী মা উমা চট্টোপাধ্যায়কে শুনিয়েছিলাম, তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বেঁচে থাকো…’


তথ্য সংগ্রহ :-
https://www.sahos24.com/


mujibsenanews.com/content/10403.html


বিভিন্ন বই, ওয়েব ডেস্ক ও নিজের ভাবনা