চলুন কবি ও কবিতার পরিভ্রমনে বেরোই। গতানুগতিক স্রোতকে অনুসরণ না করে নতুন কিছু আঙ্গিকে লেখার তাগিদে আমার এই পরিভ্রমণ সব কবিবন্ধুদের নিয়ে। গত তিন চার দশকে অনেক কবি স্বতন্ত্র জায়গায় দাঁড়িয়েও আজ বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছেন।


বিস্মৃতি
সমর সেন


ভুলে যাওয়া গন্ধের মতো
কখনো তোমাকে মনে পড়ে।
হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস।
আর মেঘের কঠিন রেখায়
আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে।
হলুদ রঙের চাঁদ রক্তে ম্লান হ'লো,
তাই আজ পৃথিবীতে স্তব্ধতা এলো,
বৃষ্টির আগে শব্দহীন গাছে যে-কোমল, সবুজ স্তব্ধতা আসে।


এমন কিছু কবিকে খুঁজে বের করে তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা ও কবিতা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে আমার এই পরিক্রমা। নতুন আঙ্গিকে ও নতুন ভাবনায় কিছু কবিতা লিখতে গেলে বা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে গেলে পুরোনোকে জানা অত্যন্ত জরুরি। পুরোনো ঘরগুলোর কাঠামো, তাদের গঠন পদ্ধতি ইত্যাদি না জানলে বা না চিনলে নতুন কিছু সৃষ্টি করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তার জন্যে দরকার অনেক বই, গল্প ও কবিতা পড়ার। আর সেই প্রক্রিয়াই এনে দেবে আপনাকে নতুন সৃষ্টির প্রবহমান স্রোত।


কয়েকদিন আগে আলোচনা পাতায় এনেছিলাম প্রথম মুসলিম মহিলা কবি 'মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা' কে।
তার আগে এনেছিলাম ইতালিও কবি দান্তে কে। আর আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত করবো স্বাধীনতা-উত্তর কালের প্রখ্যাত বাঙালি কবি 'সমর সেন' কে যিনি ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ দীনেশচন্দ্র সেনের পৌত্র।
জন্ম ১০ অক্টোবর, ১৯১৬
মৃত্যু ২৩ আগস্ট, ১৯৮৭


তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হলো  আন্তর্বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা 'শ্রীহর্ষ' এ যখন কবির বয়স মাত্র সতেরো বছর। তারপরে আলাপ হলো কবি বুদ্ধদেব বসু ও কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রথম সংখ্যায় তাঁর কবিতা পড়েই চিঠিতে লিখছেন — 'এঁর লেখা ট্যাঁকসই হবে বলেই বোধ হচ্ছে'। গ্রাডুয়েশন করলেন  ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে। হলেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম।পেলেন পদক ও স্কলারশিপ। এম এ তেও প্রথম স্থান। ১৯৩৭-এই বেরুল বেশ কয়েকটি কবিতা যা উৎসর্গ করা হল ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমেদকে।(মনে করিয়ে দিই যে  ৩/৪ সি তালতলা লেন, কলকাতায় নজরুলের রুমমেট ছিলেন এই মুজফফর আহমেদ, যিনি তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতার প্রথম পাঠক)।সেই একই বছরে কামাক্ষীপ্রসাদ, বুদ্ধদেব, প্রতিভা বসু প্রভৃতির সঙ্গে রবীন্দ্র সন্দর্শনে শান্তিনিকেতন যাত্রা। সে-বছর নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সম্মেলনের ৩য় অধিবেশনে পড়েন In Defence of the Decadents--যা নিয়ে বিতর্ক চলে বহুকাল।


বরাবর তার জীবনে কেমন যেন একটা অস্থিরতা ছিল।১৯৪০ সালে নিলেন  কাঁথির প্রভাতকুমার কলেজে চাকরি। কিছুদিন যেতে না যেতেই নিলেন চাকরি  দিল্লীর কমার্শিয়াল কলেজে(১৯৪০)।
১৯৪১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
'নানাকথা' (১৯৪২), 'খোলা চিঠি' (১৯৪৩), 'তিনপুরুষ' (১৯৪৪) বেরুল, স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাব এডিটর পদে চাকরি (১৯৪৯) তার আগে বিজ্ঞাপন অফিসে দিন সাতেক (১৯৪৪), দিল্লীর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে কাজ (১৯৪৪), এবার বড়ো লাফ--অনুবাদকের চাকরি নিয়ে মস্কো যাত্রা (১৯৫৭), দেশে ফেরা, বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ (১৯৬১), হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এ যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে যোগদান (১৯৬২), তারপর 'নাউ' পত্রিকার সম্পাদক (১৯৬৪) পদ ত্যাগ ক'রে ফ্রন্টিয়ার সাপ্তাহিক-এ সম্পাদনার দায়িত্ব (১৯৬৮)
উপরের লেখাটি পাঠে পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই এই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অস্থিরতার বিস্তর আভাস পেলেন ।  


এহেন একজন বিরাট ব্যক্তিত্বের কবি মাত্র ৩৮ বছর বয়েসে কবিতা থেকে হটাৎ দূরে সরে গিয়ে কবিতা লেখাই ছেড়ে দিলেন।তাঁর মধ্যে এলো এক অদ্ভুত রকমের কবিতা সম্পর্কে উদাসীনতা। কবিতাকে দিলেন চিরতরে ছুটি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রয়াণের ঘন্টা দুয়েক আগেও কবিতা রচনা করেছিলেন, সেখানে সমর সেনের এই নৈঃশব্দ্য বিস্ময়কর। রীতিমত নাটকীয় বলেই মনে হয়।
যাঁরা কবিতা লেখেন, যাঁরা কবিতায় মশগুল থাকতে ভালোবাসেন তাঁরা জানেন রোমান্টিক ব্যাধি না থাকলে কবিতা সজীব হয়ে ওঠে না, গ্যেটে বলেছিলেন একটু ঘুরিয়ে — কবিতার সতেজতা থাকে তরুণ বয়সেই।


শেষ করার আগে তাঁর রচিত শেষের দিকের কয়েকটি কবিতার লাইন উল্লেখ করলে হয়তো বোঝা যাবে তাঁর একাকিত্বের তীব্রতা।
"দুনিয়াদারীর দুর্দিন, বাজার অন্ধকার
পথে জমকালো স্তব্ধতা।"


"উদভ্রান্ত প্রাণ খোঁজে তিব্বতী স্তব্ধতা"


"নিঃসঙ্গ বট
যেন পূর্বপুরুষের স্তব্ধ প্রেত"


সমর সেনের ইতিহাস সচেতনতার কিছু কথা ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায় :-


"নবাবী আমল শুধু সুর্যাস্তের সোনা"


"বয়ঃসন্ধির সময়
মহাত্মাজীর আন্দোলন শুরু হল
লবণ আইন ভাঙে, দলে দলে জেলে যায়
মাঝে মাঝে বিপ্লবী বোমা ফাটে
হাতে হাতকড়া, নানাবিধ রদ্দা, চরম শাস্তি
বন্ধ সংবাদপত্র, রাস্তায় নিষিদ্ধ পোস্টার
জার্মানরা বুঝি বা বঙ্গোপসাগরে এল।"


"রক্ত আশ্বিনে রুষ বিপ্লবের পর
মধ্য ইউরোপে
জারজ সন্তানকে সঙ্গোপনে রসদ জোগায়
মাতা তার, দাঁতচাপা বৃদ্ধা গণিকা
পশ্চিমী গণতন্ত্র নাম"


"বিধ্বস্ত মাটিতে আনে ট্রাক্টরের দিন
জোসেফ স্টালিন।"


আবার কোথাও লিখলেন :-


"আজকাল ঘরে ঘরে সমাজধার্মিক অনেক
মুখে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বুলি
মনে রোমান্টিক বুলবুলের অবিরত গান":


"কিন্তু আগামী কাল আসুক ঘর-ফিরতি মজুরের গান
শতাব্দীর যন্ত্রণার পর
নতুন দিন আসুক সভ্যতার পরম চিত্তশুদ্ধিতে।"


"লেনিন, স্ট্যালিন, জুখভ্‌ ও গোর্কি
তাদের আমরা চিনি।
কিন্তু বুঝি না তাকে
দুধ ও তামাকে সমান আগ্রহ যার
দুনৌকোর যাত্রী এই বাঙালী কবিকে
বুঝি না নিজেকে।"


আশা ও নিরাশার দ্বন্দ্ব কবিকে চিরকালই জ্বালিয়েছে। হতাশার মাত্রা তীব্র ,সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার দেশী-বিদেশী দৃষ্টান্তে বীতশ্রদ্ধ হয়েই সরে গেলেন কবিতা রচনার জগৎ থেকে, আত্মহনন-ইচ্ছু আশ্চর্য ক্ষমতাবান মানুষের মতো।

উপসংহার:-
তাহলে কি ধরে নেবো কবিতা লেখাতেও ক্লান্তি আসে ? কবিদের মধ্যে থাকে সুদূরাভিসার, আত্মপ্রকাশের ব্যাকুলতা, অনন্তের বোধ, কখনও অতীন্দ্রিয় অনুভবের নিবিড় স্পর্শ, হৃদয়ানুভবের আত্মমগ্নতা, প্রবল আকাঙ্খা ও বিষাদবোধ ইত্যাদি। এগুলো হারিয়ে গেলে হয়তো আসে অস্থিরতা, ক্লান্তি, ধূসরতা, অন্ধকার অথবা একাকীত্বের তীব্রতা।


টিকা:-
যারা কষ্ট করে আমার লেখাটি পড়লেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ,প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। যদি কেও এ কবির ব্যাপারে কিছু সংযোজন করতে চান তাকেও স্বাগতম। এখানে কিছু সংগৃহিত তথ্য যেমন আছে, তেমন কিছু ব্যক্তিগত চিন্তার জায়গাও আছে।