অজয় নদীর কাব্য– একাদশ পর্ব
দ্বিতীয় বর্ষ – প্রথম সংখ্যা
কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারীর কবিতাগুচ্ছ
——–:)(:———
অজয় নদীর কাব্য
একাদশ পর্ব।
——–:)(:———
প্রথম প্রকাশ- 25শে জানুয়ারী, 2018
দ্বিতীয় প্রকাশ- 25শে ফেব্রুয়ারী, 2018
তৃতীয় প্রকাশ- 25শে মার্চ, 2018
চতুর্থ প্রকাশ-17ই মে, 2018
পঞ্চম প্রকাশ- 2রা জুন, 2018
ষষ্ঠ প্রকাশ- 26শে জুন,2018
সপ্তম প্রকাশ- 2রা সেপ্টেম্বর, 2018
অষ্টম প্রকাশ- 30শে অক্টোবর, 2018
নবম প্রকাশ- 15ই নভেম্বর, 2018
দশম প্রকাশ- 27শে নভেম্বর, 2018
একাদশ প্রকাশ-15ই জানুয়ারী, 2019
ভূমিকা
পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তিতে অজয়ের ঘাটে দূরবর্তী বহু গ্রাম থেকে মকর স্নান করতে বহু লোকের জন-সমাগম হয় আজকের দিনে। তীরে তীরে বহু দোকানপাট বসে, স্নানের পরে সবাই মুড়ি মুড়কি, সিঙাড়া, আলুর চপের দোকানে ভিড় জমায়। গাঁয়ের এই মহামিলনে সকলেই সমবেত হয় অজয়ের ঘাটে।
গ্রাম বাংলার অনেক স্থানে একসময় কুমারী মেয়েরা এইদিন থেকে কনকনে ঠাণ্ডার ভোরে একমাস ব্যাপী মকরস্নান-ব্রত শুরু করতো। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা-তামসিকতার রিপুগুলিকে জয় করার এ ছিল এক সংগ্রামী মনোবৃত্তি। ছড়া গেয়ে পাঁচ ডুব দেওয়ার নিয়ম আছে: “এক ডুব দিলে আই-ঢাই।/দুই ডুব দিলে তারা পাই।।/তিন ডুব দিলে মকরের স্নান।/চার ডুব দিলে অজয় স্নান।/পাঁচ ডুব দিলে গঙ্গাস্নান।।
পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যায়। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে দেবী বিসর্জন করে থাকে। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে।
অজয় নদীর ধারায় আছে আজও গতির নির্দেশ। আজও অজয়ের ঘাটে বসে আছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহীমণ্ডিত মেলা ধর্মশীলা মেলা। মকর সংক্রান্তির পরদিন সকালে আখ্যানের দিন এখানে একটি মেলা বসে। বহু জনসমাগম হয়। এই পূন্যতিথিতে প্রকাশ করা হলো অজয়নদীর কাব্য। দ্বিতীয়বর্ষ – প্রথম সংখ্যা। কবিতাগুলি সবার সুখপাঠ্য ও হৃদয়গ্রাহী হলে কবির সাধনা সার্থক হবে।
সকল কবি ও লেখকগণকে শুভ মকর-সংক্রান্তির আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।
সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। সুস্থ থাকুন, অপরকে সুস্থ থাকতে দিন।
জয়গুরু জয়গুরু।
বিনীত কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
নারায়না বিহার, নতুন দিল্লী-১১০০২৮
——–:)(:———
সূচীপত্র:
১. অজয় নদী আপন বেগে
২. অজয় নদী ঘাটে।
৩. পূব আকাশে প্রভাত হলে
৪. নিশি পোহাইল প্রভাত হইল
৫. ভুবন জুড়ে আলোর খেলা
৬. নতুন সকাল আসে
৭. ছড়িয়ে পড়ে ভোরের আলো
৮. বেলাশেষে
৯. সবুজ ছায়াঘেরা গা
১০. সেদিন দেখি অজয়নদীর ঘাটে
১১. দূরে অজয়ের চর
১২. টুসু পূজা গীতিকবিতা
১৩. অজয়ের ঘাটে মকর স্নান
——–:)(:———
অজয় নদী আপন বেগে
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
সাঁঝ আকাশে উঠল তারা
নামল আঁধার গাঁয়ে,
বাঁশের বনে আঁধার ঘনায়
কাজলা দিঘির বাঁয়ে।
মন্দিরে বাজে কাঁসর ঘণ্টা
সাঁঝের সানাই বাজে,
তুলসী তলে প্রদীপ জলে
মাটির আঙিনা মাঝে।
পথের ধারে আঁধার নামে
আকাশে তারারা জ্বলে,
আঁধার নামে নির্জন ঘাটে
অজয় নদীর জলে।
দূরের গ্রামে জ্বলিল দীপ
শেয়ালের দল হাঁকে,
নদীর চরে জোছনা হাসে
অজয় নদীর বাঁকে।
ঘুমিয়ে পড়ে কিষাণ পাড়া
রাত্তির গভীর হয়,
নিশুতি রাতে অজয় নদী
আপন বেগেতে বয়।
——–:)(:———
অজয়নদী ঘাটে
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
গাঁয়ের পথে আলোক ঝরে
প্রভাতে সূর্য উঠে,
তরুর শাখে পাখিরা ডাকে
বাগানে ফুল ফুটে।
প্রভাত পাখি উঠলো ডাকি
বট গাছের পাশে,
নীল গগনে পাখনা মেলে
সাদা বলাকা ভাসে।
মাটির ঘরে খাটিয়া পরে
আছে বসে তোতন,
সকাল হলে পড়তে বসে
করে না জ্বালাতন।
আঙিনা মাঝে চড়ুই নাচে
কাকেরা জোরে ডাকে,
মাটির ভাঁড়ে খেজুর গুড়ে
সুগন্ধ আসে নাকে।
চায়ের কাপে সবাই চায়ে
চুমুক দিতে চায়।
মাটিতে পড়া আখের গুড়
মাছিরা সব খায়।
রাঙা মাটির সরান দিয়ে
কৃষক চলে মাঠে,
পূব আকাশে অরুণ হাসে
অজয় নদী ঘাটে।
কাজলা দিঘি পাড়েতে তার
আছে নিমের গাছ।
দিঘির কালো শীতল জলে
জেলেরা ধরে মাছ।
কলসী কাঁখে বধূরা আসে
নদীতে নিতে জল,
নদীর তটে প্রাচীন বটে
পাখির কোলাহল।
অজয় নদী ঘাটের কাছে
ওড়ে শালিক ঝাঁকে,
শাল পিয়ালের বন আছে
অজয় নদীর বাঁকে।
পশ্চিম ধারে নদী কিনারে
তপন বসে পাটে,
সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ে
অজয় নদী ঘাটে।
——–:)(:———
পূব আকাশে প্রভাত হলে
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
পূব আকাশে প্রভাত হলে
সোনার অরুণ উঠে,
ফুলের বনে পাপড়ি মেলে
ফুলকলি সব ফুটে।
শিশির ঝরে ধানের শীষে
আজকে সকালবেলা,
রোদ হেসেছে নদীর চরে
শালিক পাখির মেলা।
অজয় নদী আপন বেগে
ধাবিছে সাগর পানে,
দুধারে হেরি সোনালী খেত
শোভিছে সোনার ধানে।
অজয় নদী ঘাটের কাছে
বক বসে সারি সারি,
কলসী কাঁখে বধূরা আসে
পরনে হলুদ শাড়ি।
দুপুর হলে নদীর জলে
সকলেই স্নান করে,
চপ্পল পায়ে কেউবা আসে
লুঙি ও গামছা পরে।
জেলেরা দেখি মাছ ধরিছে
জাল ফেলে নদীজলে,
সাদা বকেরা পাখনা মেলে
আশমানে উড়ে চলে।
পড়িল বেলা সোনালী সূর্য
পশ্চিমে পড়িছে ঢলে,
দিবস শেষে পাখিরা নীড়ে
মেতে ওঠে কোলাহলে।
নদীর চরে আঁধার নামে
সানাই বাজিছে সুরে,
নির্জন ঘাটে রাত্রি নামিল
শৃগাল কাঁদিছে দূরে।
——–:)(:———
নিশি পোহাইল প্রভাত হইল
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
নিশি পোহাইল প্রভাত হইল
ফুটিল কুসুম কলি,
কুসুম কাননে মধু আহরণে
জুটে হেথা যত অলি।
তরুর শাখায় বিহগেরা গায়
প্রভাতে অরুণ উঠে,
বায়সেরা ডাকে বসি তরুশাখে
জুঁইশাখে ফুল ফুটে।
তাল ও সুপারি খেজুরের সারি
কাঞ্চন তলার মাঠ,
আমাদের গাঁয়ে রাঙাপথ বাঁয়ে
অজয় নদীর ঘাট।
অজয়ের জলে সাদা পাল তুলে
মাঝি নাওখানি বায়,
দূরের আকাশে সাদামেঘ ভাসে
শঙ্খচিল উড়ে যায়।
সাঁঝের আকাশে চাঁদতারা হাসে
ফুটফুটে জোছনায়,
অজয়ের জলে জোছনারা খেলে
অজয় বহিয়া যায়।
——–:)(:———
ভুবন জুড়ে আলোর খেলা
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ভুবন জুড়ে আলোর খেলা
সোনালী রং ছড়ায়,
প্রভাত রবি উঠলো হেসে
পূব আকাশের গায়।
ফুল বাগানে ফুলের কলি
উঠলো সবই ফুটে,
ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে
অলিদল আসে ছুটে।
পথের ধারে গাছের ডালে
পাখি সব গায় গান,
দুপাশে হেরি সোনালী ছবি
মাঠে মাঠে সোনা ধান।
সোনালী রোদ সোনা ছড়ায়
সোনা ধানের খেতে,
সোনা গাঁয়ের সোনা চাষীর
উঠলো হৃদয় মেতে।
অঘ্রানেতে নবান্নের উত্সব
চাষীদের ঘরে ঘরে,
আখের গুড়ে আতপ চাল
পায়েস দুধের সরে।
পাটালি গুড়ের গন্ধ ভাসে
সারা গ্রামখানি মাঝে,
মন মাতানো মধুর সুরে
রাখালের বাঁশি বাজে।
অজয় নদী ঘাটের কাছে
যাত্রীদল আসে মেলা,
পশ্চিম রবি পড়েছে ঢলে
পড়ে আসে যবে বেলা।
——–:)(:———
নতুন সকাল আসে
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
শীতের কুয়াশা ভরা বিবর্ণ সকাল,
ঘন কুয়াশায় আজি ঢাকিল আকাশ।
নদী ঘাট দিঘি জল আর বিল খাল
হতে উঠে বাষ্পসম শীতল বাতাস।
শীতের সকালে রবি নাহি দেখা যায়,
তরুশাখে পাখিসব কাঁপিছে সমীরে।
কাকগুলি পাঁচিলেতে ডানা ঝাপটায়,
উত্তরে হাওয়া বয় অজয়ের তীরে।
দিঘিজলে হাঁসগুলি কাটিছে সাঁতার,
ওপাড়ের গাছগুলি শোভে ছায়াময়।
মাঠ ঘাট জন শূন্য হেরি চারিধার,
অজয়ের নদীঘাট ছবি মনে হয়।
শাল পিয়ালের বনে মুরগীরা ডাকে,
কুয়াশার চাদরেতে রবি মুখ ঢাকে।
ধীরে ধীরে কেটে যায় ভোরের কুয়াশা,
নতুন সকাল আসে, জাগে নব আশা।
——–:)(:———
ছড়িয়ে পড়ে ভোরের আলো
-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ছড়িয়ে পড়ে ভোরের আলো
সূর্যি ওঠার আগে,
নানা রঙের ফুলের কুঁড়ি
ফোটে ফুলের বাগে।
ওঠে অরুণ পূব আকাশে
চাঁপা ডাঙার মাঠে,
দিঘির জলে রাজ হাঁসেরা
দেখি সাঁতার কাটে।
রাঙা পথের দুই ধারেতে
তাল খেজুর গাছ,
পথের বাঁকে তরুর শাখে
ফিঙে পাখির নাচ।
সবুজ মাঠে চরায় গরু
রাখাল ছেলে ভাই,
মধুর সুরে বাজায় বাঁশি
তুলনা তার নাই।
নদীর পারে বনের ধারে
শেয়াল কাঁটা বনে,
লেজ ঝুলিয়ে হনুমানটি
চলে আপন মনে।
দুপুর হলে ঘুঘুরা ডাকে
অজয় নদী কূলে,
নদীর জলে তরণী ভাসে
সবুজ পাল তুলে।
পথের বাঁকে কলসী কাঁখে
দাঁড়িয়ে থাকে মেয়ে,
লয়ে দোতারা ভক্ত বাউল
চলেছে গান গেয়ে।
দিবস শেষে আঁধার নামে
আকাশে তারা ফুটে,
ধরণী পরে জোছনা ঝরে
চাঁদ আকাশে উঠে।
——–:)(:———
বেলাশেষে
-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
বেলাশেষে মাঝিভাই শেষ খেয়া বায়,
সোনালী কিরণ ঝরে নদী কিনারায়।
লুকায় অরুণ রবি অজয়ের চরে,
নাওখানি বেঁধে কূলে মাঝি যায় ঘরে।
পাখিরা বাসায় ফেরে দিবসের শেষে।
সাঁঝের সানাই বাজে আসে সুর ভেসে।
দূরে গ্রামে জ্বলে দীপ নামলো আঁধার,
ছোট ছোট তারা ফোটে আকাশ মাঝার।
ওঠে চাঁদ মুছে যায় অন্ধকার কালো,
চারিধারে পড়ে ঝরে জোছনার আলো।
দূরে কোথা বনপথে কাঁদছে শেয়াল,
জোছনার রাত যেন স্বপ্ন মায়াজাল।
বইছে অজয় নদী সারা রাত ধরে,
রাত কাটে ভোর হয় অজয়ের চরে।
——–:)(:———
সবুজ ছায়াঘেরা গাঁ
-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
আমাদের গাঁয়ে সবুজের ছায়ে
ছোট ছোট বাড়িঘর,
পূরব আকাশে লাল সূর্য হাসে
ছড়ায় রবির কর।
তরুর শাখায় বিহগেরা গায়
ফুল ফোটে বনে বনে,
ফুলের কাননে যত অলিগণে
ধায় মধু আহরনে।
রাঙাপথ বাঁকে বক ঝাঁকে ঝাঁকে
পাখা মেলে উড়ে চলে,
অজয়ের জলে সাদা পাল তুলে
নৌকা চলে অবহেলে।
সকালে বিকালে আসে যত ছেলে
স্নান সেরে বাড়ি যায়,
কলসী কাঁখেতে আসে বধূ ঘাটে
মুখ ঢাকা ঘোমটায়।
সবুজ ছায়ায় আমাদের গাঁয়
তাল খেজুরের বন,
রাখালিয়া সুরে বাজে বাঁশি দূরে
শুনে খুশি হয় মন।
পড়ে আসে বেলা দিবসের খেলা
অবশেষে শেষ হয়।
রাত হয় সারা অজয়ের ধারা
আপন বেগেতে বয়।
——–:)(:———
সেদিন দেখি অজয় নদীর ঘাটে
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
সেদিন দেখি অজয় নদীর ঘাটে
বক বসেছে সরু বালির চরে।
চাষীরা ধান কাটে মাঠে মাঠে,
গোরু বাছুর চরে ডাঙার পরে।
সকাল হলে যাত্রীরা সব আসে,
নদীপার হয় লয়ে মাথায় বোঝা।
শাল পিয়ালের বন নদীর পাশে
বনের ধারে পথ চলেছে সোজা।
রাঙামাটির পথ ধরে গাঁয়ের বধূ,
জল নিতে আসে কলসী কাঁখে।
ছেলেরা আসে চান করতে শুধু,
ঘাটে বসে তেল সাবান মাখে।
অবশেষে বেলা নামে অজয়ের চরে,
কাশের বনে সোনার রবি বসে পাটে।
নাওখানি বেঁধে কূলে মাঝি যায় ঘরে,
আঁধার নামে হেথা অজয়নদীর ঘাটে।