নিশি অবসান প্রায় ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত,
আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত।
বন্ধু হও শত্রু হও
যেখানে যে রও,
                 ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।  
                             -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজ চৈত্রমাস সংক্রান্তি। বর্তমান বছরের সর্বশেষ দিন। চৈত্র সংক্রান্তি হল গাজন উত্স ব এর শেষ দিন । গোটা চৈত্র মাস ধরে পালিত হয় এই গাজন উত্স ব যার সমাপ্তি হল চড়ক । গ্রাম বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর বছর শেষের উত্সউব হল "গাজন ও চড়ক "। আধুনিক যুগে গাজন উত্সিবে কিছুটা তথাকথিত শিক্ষিত উচ্চবর্ণের পৃষ্ঠ পোষকতা লক্ষ্য করা গেলেও আসলে এটি একটি লোক উত্সব ।


চড়ক শব্দটি এসেছে চক্র থেকে। অনেক উঁচু একটি শালগাছের কাণ্ডের আগা থেকে দড়ি দিয়ে বাঁধা গাজন-সন্ন্যাসী দের ঘূর্ণনকে বলা হয় চড়ক । ঐ শাল কাণ্ডটি আগে নিকটবর্তী কোন পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। চড়কের দিন সেটিকে তুলে, মাটিতে গর্ত খুঁড়ে প্রথমে লম্বালম্বি ভাবে পুঁতে দিতে হয়। তার আগায় একটি বংশ - দণ্ড বা লম্বা শক্ত কাঠের লাঠি ,আরও একটি কাঠের টুকরো-সহ এমন ভাবে বেঁধে দিতে হয় যাতে ঐ বংশদণ্ড বা লাঠিটি বাধাহীন ভাবে ঘুরতে পারে ।


গাজন আদতে লোকউত্সেব, পরে এটি হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে এটি শিবের উত্স বে পরিণত হয়েছে। বাংলার আদি লৌকিক দেবতা ধর্ম ঠাকুরের (যম নয়) এই পুজোর সাথে জড়িত । পরবর্তীকালে কিছু বৌদ্ধ তন্ত্র মন্ত্র মিশে যায় । আরও কিছু সময় পরে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে শিব বা রুদ্র ঐ ধর্ম ঠাকুরের সাথে মিশে যায় । তারই ফলে অন্তজ বর্ণের আরাধ্য দেবতা ধর্মের গাজন পরবর্তীকালে শিবের গাজনে পরিণত হয় বলে অনেক সমাজ গবেষক মনে করেন।


গাজনের ব্রত প্রধানত পুরুষরাই পালন করে । যারা ব্রত পালন করেন তাদের গাজন সন্ন্যাসী বলা হয় । চৈত্র মাসের শুরু থেকে গাজন সন্ন্যাসীরা গেরুয়া বসন পরে, হবিষ্যান্ন খেয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করেন । সংক্রান্তি দিন ঐ সন্ন্যাসীদের এক এক করে ওই চড়ক গাছের আগায় রাখা বংশদণ্ডের একপ্রান্তে বাঁধা লম্বা দড়ির সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় । বংশদণ্ডের অন্য প্রান্ত থেকে ঝোলানো অন্য একটি দড়ি ধরে অন্য সন্ন্যাসীরা তাঁকে ঘোরাতে থাকেন । শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে সন্ন্যাসীরা ঝোলায় রাখা ফলমূল ছুঁড়তে থাকেন দর্শক তথা পুণ্যার্থীদের দিকে ।


পুরাণ অনুযায়ী চড়ক পুজোর অন্য একটি ব্যাখ্যা আছে । তা হল-অসুররাজ বাণরাজের কন্যা ঊষার প্রণয়ী ছিলেন কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ, বাণরাজ অনিরুদ্ধকে বন্দি করলে কৃষ্ণ-বলরাম বাণগড় আক্রমণ করেন। যুদ্ধে যাদব বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বাণরাজ মৃত্যু বরণ করার আগে নিজের আরাধ্য দেবতা শিবের কাছে নিজেকে উত্সার্গ করেন আর কৃষ্ণের কাছে বর প্রার্থনা করেন যে, বছরে অন্তত একদিন যেন তাঁর মত অন্ত্যজ বর্ণের মানুষদের উচ্চবর্ণের মানুষরা প্রণাম করে ।


কৃষ্ণ বাণরাজকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত বর দান করেন । তাই অন্তজ বর্ণের প্রতীকী বংশধর হিসেবে গাজন সন্ন্যাসীরা বছরের শেষ মাসটি কঠোর সংযম পালনের মধ্য দিয়ে এইভাবে ব্রতটি উদযাপন করেন এবং শেষদিনটি বাণফোঁড়া, কাঁটাঝাঁপ, গুনঝাঁপের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষতবিক্ষত করে নিজেদের শিবের কাছে উত্সনর্গ করেন । তবে ওই প্রথা অমানবিক হওয়ার কারণে ব্রিটিশ আমলে নিষিদ্ধ করা হয় । বর্তমানে ওই সব প্রথা এমন ভাবে পালন করা হয় যাতে শারীরিক কোনও ক্ষতি না হয় ।


'গাজন বা চড়ক' আসলে একটি লোকাচার বা লোকসংস্কৃতি । মূল কথা হল, জগত্‍-সংসারকে ভোগ করতে হলে ত্যাগের মাধ্যমেই তার রসাস্বাদন করতে হয় । চৈত্র মাসের এই শিব সাধনাকে কেউ বলে শিবের গাজন আবার কেউ বলে নীলের গাজন ।


ইতিহাসবিদদের মতে মধ্যযুগের প্রথমদিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বৌদ্ধরা দলে দলে হিন্দু ধর্মে আশ্রয় নিতে থাকেন । 'গাজন ও চড়ক' এদেরই উত্সনব । তন্ত্র সাধনার অনুপ্রবেশ ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম ধ্বংসের অন্যতম কারণ । চড়কে নিষ্ঠুর প্রথাগুলির বহুল প্রচলনে এই তন্ত্র সাধনার প্রভাব থাকে । তাদের সন্ন্যাস ব্রতপালন, সারা মাস জুড়ে ভিক্ষা, সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধন-এ সবই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রাত্যহিক কাজ । প্রধানত নদীর ধারের গ্রাম-গঞ্জে, শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে জমে উঠত চড়ক গাজনের মেলা ।


'গাজন ও চড়ক'-এর ইতিহাস সম্বন্ধে সমাজতত্ত্ববিদরা বলেন, মুলত নিম্নবর্ণের মানুষজনই গাজনে সন্ন্যাস গ্রহণ করত । উচ্চবর্ণের মানুষরা তাদের প্রণাম করত । গাজন প্রধানত কৃষক শ্রেণীর উত্সব । উত্সবের মূল লক্ষ্য ছিল সূর্য ও পৃথিবীকে ঘিরে। সারা বছর ঘুরতে ঘুরতে সূর্য আলো ও শক্তি শেষ করে আলোকশূন্য হয়ে পড়তে পারে এই ছিল গ্রামবাংলার মানুষের ধারণা।


সূর্যের তাপই শস্যের ফলনে সাহায্য করে, বৃষ্টি আনে, পৃথিবী সুফলা হয় । গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে উদ্বিগ্ন কৃষক সমাজ নিজেদের বাঁচার তাগিদে বর্ষার আগমন দ্রুত হোক, এই প্রার্থনা জানাতেই সারা চৈত্র মাস ধরে উত্সরবের মধ্যে 'চড়ক' পুজো বা সূর্য পুজোর আয়োজন করে। এ সময়ে সূর্যকে দেখা যায় রুদ্র রূপে। এ ক্ষেত্রে শিব, রুদ্র এবং সূর্য এক। চড়কপুজো মানে শিবের পুজো । নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে প্রিয় দেবতা শিব । তাই শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করেই এই উত্সপবের সূচনা ।


বাংলা কবিতা আসরের সকল কবি ও পাঠকগণকে জানাই চৈত্র-সংক্রান্তি ও গাজন উত্সাবের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। সাথে থাকুন। পাশে রাখুন। জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!


বর্তমান বছরের শেষ দিনে কবির  এ বছরের শেষ কবিতা।
আগামীদিনে প্রকাশিত হবে শুভ নববর্ষের প্রথম কবিতা।
সকলের সহযোগিতা ও শুভাশীর্বাদ কাম্য।


বিদায়ের অশ্রুজলে
              লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


চৈত্র মাস সংক্রান্তি শিবের গাজন,
বিদায় বছরে আজি পূণ্য শুভক্ষণ।
এ বছর যাবে চলে একদিন পরে,
রবে মাত্র স্মৃতি শুধু চিরদিন তরে।


আগামীর সুপ্রভাত আসিবে যখন,
শুভ নববর্ষ তাই প্রীতি সম্ভাষণ।
তরুশাখে পাখি সব করিবে কূজন,
সকালে সোনার রবি উঠিবে তখন।


স্বাগতম নববর্ষ! এস ত্বরা করি,
প্রতীক্ষায় শুভবর্ষ, সারাবর্ষ ধরি।
বিদায়ের অশ্রুজলে হয় অবসান,
পুরাতন বর্ষ যায় রাখি অভিমান।


চৈত্র মাস সংক্রান্তি পূণ্য শুভক্ষণ,
কবিতা রচিল কবি শ্রীমান লক্ষণ।