এসো হে পঁচিশে বৈশাখ... কবিগুরু প্রণাম
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  চতুর্থ পর্ব
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


নব আনন্দে জাগো আজি, বৈশাখের প্রথম পুণ্য প্রভাতে ।
সব জ্বালা যন্ত্রণা যাক মুছে, আসুক এক নতুন ভোর ।
এসো হে বৈশাখ ! এসো হে নতুন এসো
নিত্য নব নব সাজে।
এসো হে পঁচিশে বৈশাখ।
দিকে দিকে শুনি তার ডাক।


ভারতবর্ষ বহু ধর্মের দেশ। বহু ভাষার দেশ। বহু সংস্কৃতির দেশ। ভারতের ভৌগোলিক সীমা বুঝিয়ে দেয় ভাষার বহুত্ব, সংস্কৃতির বহুত্ব। ভৌগোলিক সীমাকে পরোয়া করে না সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ধর্ম। তাই একই ভৌগোলিক সীমায় হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস এই ভারতবর্ষে।


প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী মানুষের আলাদা আলাদা দেবদেবী, আবার কোনও ধর্মের দেবদেবী নিরাকার। যথন ভায়ে ভায়ে গণ্ডগোল হয় তখন ধর্মের কথা আসে না। যখন পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগোল হয় তখন ধর্মের কথা আসে না। যখন রাজনৈতিক দলাদলি হয় তখনও ধর্মের কথা আসে না। হ্যাঁ, তখনই ধর্মের কথা আসে যখন গণ্ডগোলটা একটি ধর্মের মানুষের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের হয়। আর তা যখন রাজনৈতিক স্তরে পৌঁছোয়, তখন আমরা মানুষকে ভুলে যাই, কেউ হিন্দু, কেউ বা ইসলাম, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ বা জৈন ধর্মাবলম্বী।  এই জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী স্থাপন করেছিলেন শান্তিনিকেতনে।


আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ গিয়েছিলেন। এটা ছিল দ্বিতীয় ইউরোপ ভ্রমণ। সেখান থেকে ফিরে এসেই তিনি একটি সভা ডেকেছিলেন। সেই সভার সভাপতি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল জানিয়েছিলেন কবির মর্মকথা। বিশ্বভারতী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাটা ছিল– ‘বিশ্বভারতীর আক্ষরিক অর্থের দ্বারা আমরা বুঝি যে, ‘ভারতী’ এতদিন অলক্ষিত হয়ে কাজ করছিলেন। আজ তিনি প্রকট হলেন। কিন্তু এর মধ্যে আর একটি ধ্বনিগত অর্থ আছে– বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌছবে, সেই বিশ্বকে ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিত করে, ভারতের মহাপ্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে উপস্থিত করব।’


ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথ এইরকম কথা বলতে কোন দর্শনে পৌছে গিয়েছিলেন। বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌঁছবে, ভারত থেকে গােটা বিশ্ব প্রাণবায়ু নেবে। অনুরঞ্জিত বিশ্ব আবার প্রাণবায়ু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বভারতী পরিচালনা করেছিলেন। হিন্দু সংহিতার বিরোধিতা করে বিশ্বভারতীতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের বিদ্যাচর্চার পথ সুগম করেছিলেন।


এখন প্রশ্ন, ধর্ম কী? ব্যুৎপত্তিগত অর্থের কথা বললে লিখতে হয় যা ধারণ করে। অর্থাৎ ধর্মীয় সর্বাঙ্গীন কল্যাণ করে যা, তাই ধর্ম। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অবাধ যাতায়াত রয়েছে সকলের কাছে অর্থাৎ যে ধারণ করে তার কাছে। আরও পরিষ্কার করে বললে বলা যাবে তা হল মনুষ্যত্ব।


“পুষ্পকে আজ প্রাতঃকালে বলিতে হয়। নাই যে, ‘রজনী প্রভাত হইল– তুমি আজ প্রস্ফুটিত হইয়া ওঠ!’ ইহা দেখিয়া মনের মধ্যে এই আক্ষেপ জন্মে যে, আমার জীবন কেন বিশ্বব্যাপী আনন্দকিরণ পাতে এমনি সহজে, এমনি সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া ওঠে না।” ‘মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠিক এইরকম করেই মানুষের আত্মসৃজনের ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকেই বলেছেন বেদের অনগমনই ধর্ম। একথা যদি সত্যি হয় তবে নিশ্চিতরূপেই ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ বা জৈন এর কোনওটাই ধর্ম নয়। কিন্তু সবাই জানে এগুলি ধর্ম। এইসব ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে প্রচুর। আসলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই ধর্মের সঙ্গে রিলিজিয়নকে একাকার করেছে। আমাদের ধর্ম রিলিজিয়ন নহে’।


রবীন্দ্রনাথ ‘ধর্মপ্রচার’ প্রবন্ধে দীপ্ত কণ্ঠে একথা ঘোষণা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বেচ্ছাচারিতার কোনও জায়গা নেই ধর্মের মধ্যে। ধর্ম আনন্দের সঙ্গে যুক্ত, অনুভুত। নিভৃত সাধনার মধ্যে দিয়ে ধর্ম সার্থকতা লাভ করে। আর রিলিজিয়নের। মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা আস্থার সমষ্টি, যা কিনা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে অসহিষ্ণুতার ইতিহাস গড়ে তোলে। আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, পৃথিবীতে আজ মানুষে মানুষে যে বিরোধ, হানাহানি, যুদ্ধ তা শুধু রিলিজিয়নের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। ধর্মের মহৎ উদ্দেশ্য না বোঝার কারণে। বৃহৎ অর্থে না দেখে ধর্মকে দেখা হয়েছে সংকীর্ণ অর্থে, রিলিজিয়নের সঙ্গে এক করে। রবীন্দ্রনাথ কখনওই সংকীর্ণ অর্থে ধর্মকে দেখেননি। তিনি বুঝেছিলেন, ধর্ম হল ঐহিক ও পারমার্থিক প্রাপ্তির মাধ্যম।


রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্মের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব হল ঔপনিষদ ভিত্তিক। এই সাধনাতেই তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৃতীয় পর্বে রয়েছে ব্রহ্মভাবনা উপলব্ধির বিষয়টা। এর ফলে তিনি লিখে দিলেন ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থ। চতুর্থ পর্বে রয়েছে মগ্নতা। এখানে তাঁর ধর্ম ভাবনায় যুক্ত হয়েছে বহির্বিশ্ব এই পর্বেই তিনি অনুভব করেছেন বাইরের কোনও কিছুর মধ্যেই মনের মানুষ নেই। সে আছে নিজ নিজ অন্তরে। অর্থাৎ মন্দির, মসজিদ বা গির্জা নয়— মনের মানুষের অবস্থান মনেই বলা যায়, এখান থেকেই তিনি ধর্মবোধে যাবার চুড়ান্ত পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। ‘গীতাঞ্জলি’র গান তো তিনি এই পর্বেই লিখেছিলেন। নোবেল পাবার সময় থেকেই রবীন্দ্রমননে বিশ্ববোধের সমন্বয় হয়েছিল। আর পঞ্চম পর্বে দেখা গেল মানব ধর্মের কথা।


অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে হিবার্ট বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার থেকেই এই ভাবনার সূচনা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। ষষ্ঠ ও শেষ পর্বের কথা হল মানব ধর্মের সাধনা। হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান নয়, মানুষের ধর্ম হল মানব ধর্ম, যা এককথায় শুভ, কল্যাণকর, মঙ্গলময়।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন– “যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে / সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে / যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড় / পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।”


আমাদের একটাই দেশ। তা হল বিশ্ব। একটাই জাতি, তা হল মানুষ। একটাই ভাষা, তা হল মানব ভাষা। একটাই ধর্ম তা হল মানবধর্ম। তাই তো আজও সারা বিশ্ববাসী বিশ্বকবির জয়গান করে-
এসো হে পঁচিশে বৈশাখ এসো এসো।


এসো হে পঁচিশে বৈশাখ  
কবিপ্রণাম আমার কবিতা-৪
কবি- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


এসো হে আবার পঁচিশে বৈশাখ
নব নব রূপ সাজে,
জন্ম দেহ এক নব বিশ্বকবি
এই বসুধার মাঝে।


হে মহান কবি তুমি বিশ্বকবি
মানব প্রেমিক তুমি,
পঁচিশে বৈশাখ শুনি তার ডাক
কান পেতে তাই শুনি।


আসিলে ধরায়, এই বসুধায়
মানুষেরে ভালবেসে,
সবার হৃদয়ে আছো তুমি কবি
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে।


বাংলার কবি বাঙালির কবি
তুমি যে বিশ্বের কবি,
তব বন্দনায় সারা বসুধায়
কিরণ ছড়ায় রবি।


এসো হে আজিকে যুগান্তের কবি
বিশ্বজুড়ে তব আহ্বান,
শুনি সেই ডাক পঁচিশে বৈশাখ
গাহে তব জয়গান।


আবার আসুক পঁচিশে বৈশাখ
এই ধরণীর তলে,
মহা মানবের এ সাগরতীরে
আসমুদ্র হিমাচলে।