মনসা মঙ্গল কাব্য .... জয় জয় মা মনসা
মা মনসার গল্প (সমাপ্তি পর্ব)
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনা ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
দক্ষিণ বঙ্গে অধিকাংশ গ্রামগুলির সার্বজনীন থানে মনসা দেবীর মূর্তি পূজার একটা বেশ বড়সড় রীতি রিয়াজ পালন করা হয়ে আসছে বহু পূর্বপুরুষ ধরে। যদিও সেখানে দেবাদিদেব মহাদেব (পঞ্চনন্দ), বনবিবি, শীতলা, লক্ষ্মী, কালি, চণ্ডী, বারা ঠাকুর সহ আরো আট দশটা দেব দেবীকে পূজা করে গ্রামের মানুষ। কিন্তু তার সত্বেও সার্বজনীন মন্দিরের বাইরেও এমন কিছু কিছু থান বা মন্দির রয়েছে যেগুলোতে শুধুমাত্র মনসা দেবীর মূর্তি ব্যাতিত আর অন্য কোনো দেব দেবীর মূর্তি পূজা করা হয় না অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবে শুধুমাত্র মনসা দেবীর জন্য বহু মনসা মন্দির রয়েছে। সেগুলি মনসার থান নামে পরিচিত।
দক্ষিণ বঙ্গের চাষাবাদ যুক্ত পল্লী গ্রামাঞ্চল গুলিতে এ জাতীয় মনসা মন্দির সচরাচর বহু পরিমাণে দেখা যায়। কোনো স্থানে একবার মনসা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে সেই স্থান দিনের পর ভক্তদের সমাগম বাড়ে কিন্তু কমে না। শুধু তাই নয় সেই মন্দির নির্মাণের উপাদান প্রথমে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি হলেও দিনের পর দিন অজস্র ভক্তের গুপ্ত ব্যা ধি তথা নানান রোগ নিরাময় ও অন্যাান্যি বহু সুখ সমৃদ্ধির মূলে দেবীর মহিমাকে দায়ী করে তাঁকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও নানান গহনাদি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়।
পাড়ার বয়স্ক মোড়ল মতিব্বরদের উপস্থিতিতে সকলকে সাক্ষী করে ব্যাকক্তিগত জায়গায় সৃষ্ট পূজনীয় স্থানকে মনসা দেবীর মন্দিরের নামেই উৎসর্গ করে জমির মালিক পক্ষ। এরপরে ধুমধাম করে জাগ্রত করা হয় পুরোহিতের পূজার নানান সাংস্কৃত মন্ত্রে। গ্রামের কুমারী, সধবা ও বিধবা মহিলারা প্রতিনিয়ত সকাল সন্ধ্যায় এইসব থানে বা মন্দিরে ভোগ লাগাতে শুরু করে।
বহু ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ মনসা দেবীর থানের সন্নিকটে রয়েছে সিজ মনসার গাছ। এই গাছকে দক্ষিণাঞ্চলের মনসা ভক্তদের একাংশ স্বয়ংসিদ্ধ মনসা দেবীই জ্ঞান করে। বহু স্থানে কিছু পুরানো মনসা মন্দির রয়েছে। যেখানে সিজ মনসার গাছ গুলি প্রচণ্ড বড় এবং তার নিচের অংশ গুঁড়ির আকারে পরিণত হয়েছে। তাই মনসা দেবীর মুর্তি পূজার সঙ্গে সঙ্গে সীজ মনসার ডাল পূজার প্রচলনও রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মনসা ভক্তদের একদল অনুগত ভক্তরা বলেন যে সমস্ত গৃহে মনসা মূর্তি নাই তাঁরা সীজ মনসার কান্ড কাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যদি পূজা দেয় তবে সেই পূজাতেও এই দেবী সন্তুষ্ট হয়।
মনসা রূপী এই সীজ মনসার ডালের সামনে পূজার নানান নৈবেদ্যাদি সাজিয়ে পূজার আয়োজন করা যেতে পারে। বস্তুত মনসা মূর্তি ও সীজ মনসার কান্ড পূজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দী হতে পল্লী বাংলার গ্রামাঞ্চল গুলিতে গৃহস্থের নিজের আরাধ্য দেবীর পূজার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মনসা। এই দেবীর ভাক্তাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়তার যে কারণ গুলি মানা হয় তা বিস্তারিত তথ্যে উপস্থাপন করা হল;
1. অখণ্ড বাংলায় আর দশ বিশটি লৌকিক দেবদেবীর মতো খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে মনসা দেবীর উত্থান হয়েছিল সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গ তথা বাংলার লোক সমাজে। প্রতিটি লোক দেব দেবীর বাহনের ন্যায় এই দেবীর প্রধান অনুচর কাল বিষাক্ত সর্প। যার কামড়ের হাত থেকে রক্ষার্থে অতি সহজেই তার পূজার জনপ্রিয়তা কয়েক দশকের মধ্যে তুঙ্গে উঠে যায়। তার ভক্তরা স্বেচ্ছায় নয় বরং ভয়ে ভয়ে দেবীকে বেশি পূজা দেয় কেবলমাত্র কাল সর্পের কামড়ের হাত থেকে সপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রক্ষার্থে।
2. প্রতিটি লোক দেবী দেবীর উত্থানের পিছনে একটি মহান উদ্দেশ্য থাকে। গ্রামের মোড়ল মতিব্বরদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সব দেব দেবীর মূর্তি রাখার প্রধান উদ্দেশ্য বহিরাগত শত্রুদের আক্রমণ থেকে সমগ্র গ্রাম কে রক্ষা করা। অনুরুপ কালসর্পমূর্তি বিশেষ মনসা দেবীর এই ভয়ঙ্কর মূর্তি প্রতিষ্টার পিছনে এটাই মহান উদ্দেশ্য।
3. শিবের অসাধ্য হাম, বসন্ত, গুটি বসন্তের মতো কতকগুলো রোগের প্রকোপে অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গ্রামের পর গ্রাম মড়ক দেখা দিত। যার ফলশ্রুতিতে উজাড় হয়ে যেত সমগ্র গ্রামের নিরপরাধী মানুষ। এই সমস্ত রোগের কোনো চিকিৎসা তো ছিলই না বরং বলা হত শীতলা, মনসা ও বিবি মায়ের মতো কিছু দেব দেবীর ব্রত ও পূজা পার্বনের কর্মকাণ্ডে ভুল ত্রুটি হলে তার পরিবর্তে রুষ্ট হয়ে দেবদেবীরা এসব অনিষ্ট দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি করেন। তাই ভক্তি সহকারে ধুমধাম করে তাদের পূজা ও সন্তুষ্টিতে এহেন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এমন ধ্যান ধারণায় শীতলা বনবিবির ন্যায় মনসার ও সামাজিক গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
4. মনসা ভয়াল, ভয়ঙ্কর সর্পের দেবী রূপে জগতে পূজিতা হয়ে আসছে। কিন্তু মনসা মঙ্গল কাব্যের একেবারে শেষ মূহুর্তে আমরা এই দেবীর একটু বিপরীত চরিত্র খুঁজে পায়। চাঁদ বনিকের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার কাহিনী বঙ্গের কোনোও নারীর অজানা নয়। বেহুলার সতীত্ব ও সত্য বচন রক্ষার্থে চাঁদ সওদাগর মনসাকে বাম হাতে পূজা দেয়। চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজার পরিবর্তে মনসা যখন সন্তুষ্ট হয়ে লক্ষীন্দর সহ ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিল, তার প্রিয় বন্ধু শঙ্কর গারুরীর জীবন ফিরিয়ে দিল, সপ্ত ডিঙ্গার প্রতি ডিঙ্গা জলে ভাসিয়ে দিল এবং মহাজ্ঞান মন্ত্র সহ হাতি শালের হাতি, ঘোড়া একে একে সব ফিরিয়ে দিল এসমস্ত ঘটনায় আমরা কাহিনীতে আমরা মনসার ভক্ত বাৎসল্য রূপ খুঁজে পাই। সেই হারানো কাঙ্ক্ষিত সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি পুনরায় ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় দক্ষিণ বঙ্গে মনসার দেবীর পূজা খুবই শীঘ্রই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
5. মনসার প্রধান অনুচর কাল সর্প। যা বংশবৃদ্ধি ও বংশগতির ধারাবাহিকতার অগ্রগতির বিশেষ প্রতীক। স্নেহ বাৎসল্য়ময়ী এক পুত্র সন্তানের বা কন্যার সন্ততির জননী হওয়ার আশা বা বাসনা প্রতিটি সধবা রমনীর মনে থাকে। সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ব্যা থা বেদনায় সে মনসার কাছে আকুণ্ঠ ভরে প্রার্থনা করে শুধুমাত্র একটি পুত্র বা কন্যাহ পাওয়ার আশায়।
6. দেবী ভাগবত বা দেবী পুরাণে দুই হিন্দু দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের প্রধান বাহন শ্বেত হংস। এই দুই দেবীর একদিকে মা স্বরস্বতী ও অন্য দিকে মা মনসা। যদিও দেবী স্বরস্বতী বৈদিক যুগের সুরের আরাধ্য দেবী। তার প্রধান বাহন হংস হলেও এযুগের লোক দেবী মনসারও প্রধান বাহন হংস। হিন্দু সম্প্রদায়ের আর দশ বিশটি দেব দেবীদের ভিন্ন ভিন্ন বাহন দেখা গেলেও শ্বেত হংস সচরাচর নম্র, ভদ্র ও শ্বেতশুভ্র শান্তির পথিক। পঙ্কিল সলিলে হংস যেমন তার প্রয়োজনীয় খাদ্যেবস্তু গ্রহন করে অপ্রয়োজনীয় খাদ্য্বস্তু পরিত্যা্গ করে। তৎরূপ ভক্ত বাৎসল্য ময়ী এই মনসা ভক্তদের মন কেই ভালোবাসে, কোনো পূজার বাহ্যিক আড়ম্বরে নয়। তাই তার ভক্তদের একাংশ বিনম্র ভক্তি ও শ্রদ্ধায় তাঁকে পূজা করে।
7. দক্ষিণাঞ্চলের লোক সঙ্গীতের আসরে এক শ্রেণীর সঙ্গীতজীবি সম্প্রদায়ের কাছে এই দেবীর গুরুত্ব অসীম। মনসামঙ্গল কাহিনীর মূল মাহাত্ম্য কথা মনসার গান আজ বাংলার কোণায় কোণায় প্রচলিত রয়েছে। পূর্বে এই পালাগান সিঙ্গেল পাঁচালির মতো করে গান ও অভিনয়ের প্রথা প্রচলন থাকলেও বর্তমানে শ্রোতাদেরকে রসাপ্লুত ও দৃষ্টিগোচরে অত্যঁন্ত আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য যাত্রাপাঁচালির প্রচলন শুরু হয়েছে। এহেন লোক শিল্পীরা বছরে প্রায় সত্তর, আশি, এমনকি একশো পালা পর্যন্ত মনসা, শীতলা ও বনবিবির গান করে তাদের সংসার খরচ বহন করে আসছে। তাই এদিক দিয়ে এই দেবীর সামাজিক গুরুত্ব অনেক খানি।
(গ্রন্থঋণ :-বাংলা মঙ্গল কাব্যেওর ইতিহাস – ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ও সুন্দরবনের লোকদেবতা – ড . দেবব্রত নস্কর।)
মনসার বন্দনা গান
গ্রামের সার্বজনীন মন্দির গুলির মহোৎসব পর্বে মনসা দেবীর উত্থান ও পূজা পার্বণের পুণ্য লগ্নে সমগ্র উনবিংশ, বিংশ শতাব্দী থেকে আজও গ্রামের সধবা মহিলাদের একদল সমবেত কণ্ঠে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মঙ্গল ঘট বসিয়ে এক সুন্দর লোক সুরের আঙ্গিকে মনসার বন্দনা গান গায় দশহরার ব্রত পালন করে। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থান বা মন্দিরে সমগ্র গ্রামের মাঙ্গলিক লোক দেবী রূপে দীর্ঘকাল যাবৎ ভক্তদের কাছে থেকে মনসা পূজা নিয়ে আসছে। তাই বৎসরান্তে এক দুই বার তার মহিমা কীর্তন পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে মানসিক সুখ শান্তি অনুভব করে দক্ষিণ বঙ্গে এই দেবীর অনুগত ভক্তরা। লোক সঙ্গীতের আর অন্যান্য শৈলীর মতো মনসার পাঁচালীগান বা অভিনয়ের মধ্যেে দিয়ে যাত্রা পাঁচালী পরিবেশনের মধ্যেশ দিয়ে তারা দেবীর গুনকীর্তনে আনন্দে মাতে।
মনসার পাঁচালী গান সম্প্রদায়ের শিল্পীরা দেবী মাহাত্ম্য কীর্তনের পালায় অনুপ্রবেশের পুণ্য মূহুর্তে পুরুষ ও মহিলা চরিত্রের সমস্ত নরনারীরা সর্বপ্রথমে ‘আশাবারী’ খনন করে দেবীকে আনয়ন করে। লোক সমাজের প্রতিটি গৃহস্থের ধারণা এই সময় মনসা দেবী জাগ্রত হয়ে তার অনুগত ভক্তদের কৃপা করেন। সেই কৃপা বর্ষনের সামান্য করুণা লাভের আশায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের একদল গন্ডি দেয় থানের চতুর্দিকে। অন্যা ন্যু জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষরা এই পবিত্র সঙ্গীতানুষ্ঠানেও কমবেশি উপস্থিত হয়। সেই পুন্যদ ক্ষনে শিল্পীরা মহানন্দে মনসা বন্দনা পরিবেশনের মধ্যের দিয়ে দেবীর চরণে নিবেদন রেখে সকলে উচ্চৈঃস্বরে গাইতে থাকে ;
জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো ।
বন্দনা করি মাগো মা মনসার চরণে।।
তার পরে বন্দনা করি মহাদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি ভগবতীর চরণে।জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি মা কালীর চরণে। জয় জয় মা মনসা
ও মা – – –
মাগো আকাল বন্দন পাতাল বন্দন বন্দনা করলাম,
আমি গুরুদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি তেত্রিশ কোটি দেবতা। (জয় জয়) (সংগৃহীত)
মা মনসার পূজা (ধর্মীয় কবিতা) সমাপ্তি পর্ব
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
(পঞ্চম পরিচ্ছেদ)
চাঁদ সদাগরে বলে সায়বেনের ঝি,
বামহস্তে পূজা দিতে চাঁদ হল রাজি।
ছয় পুত্র প্রাণ পায়, ভাসে মধুকর,
বামহস্তে পূজা করে সাধু চন্দ্রধর।
পূজা নিতে মনসার মর্ত্যে আগমন,
স্বর্গ হতে পুষ্প বৃষ্টি করে দেবগণ।
মা মনসার পাঁচালি যেবা পাঠ করে,
সর্প ভয় কাটে তার মনসার বরে।
শুনহ জীবের জীব বচন আমার,
শ্রাবণ সংক্রান্তিতে পূজা মনসার।
উপবাসী থাকি সবে পূজা কর তাঁর,
লভিবে অপার সুখ কহিলাম সার।
মা মনসার পাঁচালি হল সমাপন,
জয় মা মনসা দেবী বল সর্বজন।
(শ্রী শ্রী মা মনসার পাঁচালি পর্বে পর্বে সমাপ্ত। বাকি পর্বগুলি ভাদ্র সংক্রান্তিতে প্রকাশ করার রাখি)