আজ মহা অষ্টমী। দেবী দুর্গতিনাশিনী আদ্যাশক্তি মহামায়ার অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে এই পূজা দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ শক্তির আরাধনা। বিধিমতে সুগন্ধি চন্দন, পুষ্পমালা, ধূপদীপ সহকারে মাতৃপূজা করা হয়। হোম যজ্ঞ ও আহুতি প্রদান করা হয়।


জগতমাতাকে (দেবী দুর্গা) আমরা আরাধনা করি তিনি সকল নারীর মধ্যে মাতৃরূপে আছেন। এ উপলব্ধি সকলের মধ্যে জাগ্রত করার জন্যই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দুর্গা মাতৃভাবের প্রতীক আর কুমারী নারীর প্রতীক। কুমারীর মধ্যে মাতৃভাব প্রতিষ্ঠাই এ পূজার মূল লক্ষ্য। কুমারী পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে মহারাজ বলেন, দেবী দুর্গার সামনে বসিয়ে ঠিক যেভাবে তার (দুর্গার) আরাধনা করা হয়,
একইভাবে কুমারীকে সে সম্মান প্রদান করা হয়।


পৌরাণিক ইতিহাস


মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে, মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করলে দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য ছিলেন বলে বিষ্ণু দেবতাদের পরামর্শ দেন যে, ‘প্রত্যেক দেবতা নিজ নিজ তেজ ত্যাগ করে একটি নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন।


এরপর সমবেত দেবতারা তেজ ত্যাগ করতে আরম্ভ করেন। যে যে দেবতার তেজ থেকে এই নারী মূর্তির শরীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি হলো, তা এ রূপ ‘মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙুল, বসুগণের তেজে হাতের আঙুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতার তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হলো।


এরপর দেবতারা তাকে বস্ত্র, পোশাক ও অস্ত্র দান করলেন। এক্ষেত্রে যারা যা দান করলেন, তা হলো—মহাদেব দিলেন শূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, সূর্য দিলেন রশ্মি, কালখক্ষ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পান পাত্র, শেষ নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতা তাদের সাধ্যমতো বিষয় উপহার দিলেন। এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রতিরূপ।


অঞ্জলি


অষ্টমী মানেই কিন্তু পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া নতুন জামাকাপড় পড়ে। স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে প্রতিমার সামনে বসুন। তিনবার হাতে গঙ্গাজল নিয়ে আচমন করুন। এবার হাতে ফুল নিন ও তিনবার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র পড়ে ঠাকুরের চরণে তা প্রদান করুন। এবার প্রণাম মন্ত্র অর্থাৎ “ ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে, শরণ্যে ত্রম্ব্যকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে’’ ইত্যাদি বলে অঞ্জলি প্রদান শেষ করুন।


কুমারী পুজো


সকল মেয়েই মা দুর্গার অংশ, তাই মৃন্ময়ী প্রতিমাকে পুজো করার পাশাপাশি কম বয়সের ছোট মেয়েদেরও পুজো করা হয়। বেলুড় মঠে  প্রথম কুমারী পূজা করেন ১৯০১ সালে। ষোলো বছরের মেয়ে পর্যন্তই কুমারী হিসাবে পুজো করা যায়। একটি মেয়েকে প্রথমে আমন্ত্রণ করে তাকে শাড়ি ও গয়না উপহার দিতে হয়। সেই  তাকে পড়িয়ে মাতৃমূর্তির সামনে এনে উঁচু আসনে বসাতে হয়। কুমারীর পা জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার পূজা শুরু হয়। তাকে মিষ্টান্নাদি নৈবেদ্য প্রদান করা হয়। তার উদ্দেশে অঞ্জলি দেওয়া হয়। এইদিন ওই কুমারীকে দেবী দুর্গার রূপ হিসাবেই ধরা হয়।


সন্ধি পুজো


এটি দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মূলত অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিস্থলে অর্থাৎ অষ্টমী শেষ হবার ২৪ মিনিট ও নবমী শুরু হবার ২৪ মিনিট এই সময়ের মধ্যে এই পূজা হয়। এই সময়ে মূলত দেবী চামুন্ডার পূজা করা হয়। এই পূজাতেই ১০৮ টি পদ্মফুল দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। এর মূলে রামায়ণের কাহিনী আমরা সবাই জানি। রাবণ বধের জন্য রাম ১০৮ পদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা করেন ও তারপর রাবণ নিধন হয়। সেই সূত্রেই এই সন্ধি পূজা করা হয়। দেবীর সামনে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য কাঁচা অবস্থায় এবং রান্না করা ভোগ হিসাবেও রাখা হয়। ১০৮ টি মাটির প্রদীপ দেবীর সামনে জ্বালানো হয়। কোনো কোনো জায়গায় এই দিন বলিও দেওয়া হয়। বলি হিসাবে পশুবলি নিয়ে অনেক নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বলেই আখ, চালকুমড়ো এইসব বলি হিসাবে প্রদত্ত হয়।


দুর্গাপুজো বাঙালির জীবনে অন্যতম উত্সখব। সারা বছর বাদে বাইরে থেকে এসে বহু মানুষ মিলিত হন এই উত্সাবে। বহু শিল্পীর সারা বছরের রুজি রোজগারও জড়িয়ে থাকে এই ৫ দিনের পুজোর সঙ্গে। তাই আক্ষরিক অর্থেই, দুর্গাপুজো হল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উত্স ব।


শারদীয়া দুর্গাপূজা জাতীয় জীবনে সর্বাঙ্গীন। তাই বাংলা কবিতা আসরের সকল  কবি ও সহৃদয় পাঠকবৃন্দকে জানাই শুভ মহা অষ্টমীর শুভকামনা, প্রীতি আর শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিগণের জয় হোক।


আসুন আমরা সকলেই জাতিধর্ম নির্বিশেষে শক্তির আরাধনায়
রত হয়ে শারদীয়া দুর্গাপূজার আনন্দে মেতে উঠি।
জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!


মহা অষ্টমী দুর্গাপূজা
                লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


মহা অষ্টমীর পূজা পূণ্য শুভক্ষণে,
মণ্ডপে বাজায় ঢাক যত ঢাকীগণে।
দেবীর মণ্ডপমাঝে শঙ্খঘণ্টা বাজে,
আবির্ভূতা হন দেবী অপরূপ সাজে।


হোম যজ্ঞ বিধিমতে হয় সমাপন,
অবশেষে আসে সেই পূণ্য সন্ধিক্ষণ।
মহা অষ্টমীতে করে ছাগ বলিদান,
পশুরক্তে দেবীপূজা শাস্ত্রের বিধান।


শুনহ জীবের জীব আমার বচন,
পশুরক্তে মাতৃপূজা না হয় কখন।
মাতৃপূজা কর জীব বিনা বলিদান,
হত্যায় না হয় কভু পূর্ণ মনস্কাম।


বলিহীন হোক পূজা বিনা বলিদান,
লক্ষ্মণের কাব্য হোক শাস্ত্রের বিধান।