শুভ জামাইষষ্ঠী-১৪২৭
তথ্য সংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
জামাই-ষষ্ঠীর মূল বৃত্তান্ত:
মা ষষ্ঠী হলেন সন্তানাদির দেবী। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হয়, যাতে তিনি কন্যাকে সন্তানবতী হওয়ার আশীর্বাদ দেন।
কথিত আছে, জনৈক গৃহবধূ শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন মাছ চুরি করে খেয়ে বারবার বিড়ালের ওপর দোষ দিতেন। এরপর একদিন তার সন্তান হারিয়ে যায়৷ তখন পাপের ফল ভেবে সন্তান ফিরে পেতে সে বনে গিয়ে দেবী ষষ্ঠীর আরাধনা শুরু করে। ওই গৃহবধূর আরাধনায় মা ষষ্ঠী সন্তুষ্ট হলে সেই বনে সন্তান ফিরে পায়।
এই জন্যই নাকি ষষ্ঠীদেবীর অন্য নাম অরণ্যষষ্ঠী। এদিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার অপরাধে গৃহবধূর শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে ওই গৃহবধূর মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে দেখতে একবার ষষ্ঠীপূজার আয়োজন করে এবং সেই পুজোর দিন শ্বশুরবাড়িতে আসার জন্য জামাইকে নিমন্ত্রণ করেন।
এরপর সেই পুজো উপলক্ষ্যে সস্ত্রীক জামাই হাজির হলে মেয়েকে দেখে তার মা-বাবার মনে আনন্দ আর ধরে না৷ ৷ষষ্ঠী পুজো ঘিরে এমন ঘটনা ঘটায় বাঙালি হিন্দুসমাজে এক নতুন উৎসবের সূচনা হয়৷ কার্যত ষষ্ঠী পুজো রূপান্তরিত হয় সামাজিক অনুষ্ঠান জামাইষষ্ঠীতে ৷ ফলে যে পরিবারে সদ্যোবিবাহিতা কন্যা আছে, সে পরিবারে এ পার্বণটি ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে।
এখন মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাই জুড়ে দিয়ে এর নাম হয়েছে ‘জামাই ষষ্ঠী’। প্রকৃত পক্ষে জামাইষষ্ঠীর আসল উদ্দেশ্য হল মাতৃত্ব, সন্তান ধারণ এবং বংশবৃদ্ধি। মেয়ে যাতে সুখে শান্তিতে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে পারে, তার জন্য মঙ্গল কামনা।
ষষ্ঠী পূজার উপকরণ: আম্রপল্লব, তালপাখার পাখা, ধান, দূর্বা, পাঁচ থেকে নয় রকমের ফল, ফুল এবং বেলপাতা, সাদা সুতো ও হলুদ।
এখন দেখে নেওয়া যাক শ্বাশুড়িরা কী ভাবে মা ষষ্ঠীর আরাধনা করেন:
ষষ্ঠীপুজো উপলক্ষ্যে শ্বাশুড়িরা ভোরবেলা স্নান করে ঘটে জল ভরে নেন এবং ঘটের ওপর স্থাপন করেন আম্রপল্লব। সঙ্গে রাখেন তালপাতার পাখা। ১০৮টি দূর্বা বাঁধা আঁটি দিয়ে পূজোর উপকরণ সাজানো হয়। করমচা ফল-সহ পাঁচ থেকে সাত বা নয় রকমের ফল কেটে কাঁঠাল পাতার ওপর সাজিয়ে রাখতে হয় শ্বাশুড়িকে।
এরপর একটি সুতো হলুদে রাঙিয়ে তাতে ফুল, বেলপাতা দিয়ে গিট বেঁধে সাজানো হয়। এর পর মা ষষ্ঠীর পুজো করা হয়। জামাই এলে তাঁকে বসিয়ে সুতোটা হাতে বেঁধে দিয়ে শ্বাশুড়ি পাখার হাওয়া দিয়ে ‘ষাট-ষাট-ষাট’ বলে ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন।
বর্তমানে শহরাঞ্চলে অনেকেই এ ধরনের নিয়ম পালন না করলেও জামাইষষ্ঠীর দিন অবশ্যই জামাইদের নিমন্ত্রণ করেন। কোথাও কোথাও আবার শ্যালিকারা বাঁশের কঞ্চি বেঁকিয়ে ‘হার্ট শেপ’ তৈরি করে তাতে লালসুতো দিয়ে ধান বেঁধে সুন্দর আকৃতি করে ভগ্নিপতিকে উপহার দেন।
জামাই-ষষ্ঠীর অনুষ্ঠানের আচরণগুলোর প্রত্যেকটিই অর্থবহ।
যেমন:
ফুল, বেলপাতা দিয়ে সুতো বেঁধে দেওয়ার অর্থ, তোমার সঙ্গে আমাদের পরিবারের বন্ধন এবং আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার বন্ধন অটুট থাকুক ও সুখপ্রদ হোক।
পাখা দিয়ে হাওয়া করার অর্থ, তোমার সমস্ত আপদ-বিপদ দূরে যাক, শান্ত থাকুক পরিবেশ।
তিন বার ‘ষাট-ষাট-ষাট’ বলার অর্থ দীর্ঘায়ু কামনা করা।
ধান সমৃদ্ধি ও বহু সন্তানের প্রতীক। দূর্বা চিরসবুজ ও চির সতেজতার প্রতীক।
এ সব কিছুই জামাইয়ের মঙ্গলের জন্য যেমন শুভ কামনা, তেমনই মেয়ের সুখে-শান্তিতে থাকার জন্য মঙ্গল চিন্তা এবং সুন্দর সাংসারিক জীবন যাপনের জন্য মা ষষ্ঠীর কাছে প্রার্থনা।
এটা একটা সামাজিক প্রথা মাত্র। জামাই-এর সাথে আপ্যায়ন করতে হবে মেয়েকেও। তা না হলে সমাজজীবন ও পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি আসে না। আসতে পারে না। গৃহবন্দী অবস্থায় আজকের জামাইষষ্ঠীর পূণ্য শুভক্ষণে সব জামাইবাবুদের জানাই
আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
সপরিবারে সকলে সুস্থ থাকুন।
জয়গুরু!
শুভ জামাইষষ্ঠী-১৪২৭
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
জামাই ষষ্ঠীর দিনে ভারি ধূম হয়,
জামাই সকলে আজি গৃহে বন্দী রয়।
ট্রাম, ট্রেন বাস বন্ধ, বন্ধ আনাগোনা,
গৃহে গৃহে কলরব নাহি যায় শোনা।
গৃহে বন্দী থাকে করে সব আয়োজন,
জামাতার নাহি হয় গৃহে আগমন।
মোবাইলে বার্তা আসে আজি শুভদিন,
বিষাদে সবার মুখ আজিকে মলিন।
শ্বশুর শ্বাশুড়ি করে কত আয়োজন,
গৃহ বন্দী সকলেই বিষাদে মগন।
বাজারে ইলিশ মাছ দেখা নাহি মিলে,
লিচু আম মিষ্টি দই গেল রসাতলে।
নন্দিনী ও জামাতারে করো আশীর্বাদ,
গৃহে বন্দী থাকি আজি পুরে মনোসাধ।
পূর্ব প্রকাশিত কয়েকটি জামাইষষ্ঠীর কবিতা
আজিকে জামাইষষ্ঠী-১
- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
জামাইষষ্ঠী আজিকে ধূম হয় ভারি,
আসিবে জামাতা তাই ব্যস্ত সারাবাড়ি।
বাড়িঘর ছিম-ছাম কত আয়োজন,
শুভক্ষণে জামাতার হয় আগমন।
ইলিশের মাথা দিয়ে সুস্বাদু ব্যঞ্জন,
বিবিধ মিষ্টান্ন দ্রব্য না যায় বর্ণন।
রাজভোগ সীতাভোগ মিহিদানা আর,
চিনি পাতা মিষ্টি দই হরেক প্রকার।
আম কলা কাঁঠালের ভেসে আসে গন্ধ,
তাই নিয়ে তিন শালী অধিক আনন্দ।
হেসে হেসে বসে এসে জামাতার পাশে,
জামাই-বাবুকে তারা অতি ভালবাসে।
সারাদিন হাসি খুশি আনন্দ সবার,
আগামী বর্ষের তরে প্রতীক্ষা আবার।
আজিকে জামাই ষষ্ঠী-২
-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
আজিকে জামাই-ষষ্ঠী পূণ্য শুভদিনে,
জামাইকে দিতে হয় নব বস্ত্র কিনে।
জামাই ষষ্ঠীর দিন ভারি ধূম পড়ে,
হাসিখুশি বাক্যালাপ সারাদিন ধরে।
সামাজিক প্রথা এই জানি ভালমতে,
এ নিয়ম আসে চলে যুগ যুগ হতে।
আনন্দের স্রোত বয় প্রতি ঘরে ঘরে,
আয়োজন করে কত জামাতার তরে।
বেগুন পটল ভাজা, ঝোল ইলিশের,
আলুভাজা উচ্ছেভাজা, চাটনি আমের।
যত্ন সহকারে কত হয়েছে রন্ধন,
ইলিশের মাথা দিয়ে সুস্বাদু ব্যঞ্জন।
চিনিপাতা দই আর সাথে রাজভোগ,
খিলিপান তার সাথে করা হয় যোগ।
আজিকে জামাই-ষষ্ঠী পূণ্য শুভক্ষণ,
কবিতা লিখেন কবি শ্রীমান লক্ষ্মণ।
আজিকে জামাইষষ্ঠী-৩
- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
জ্যৈষ্ঠেতে জামাই-ষষ্ঠী ভারি ধূম পড়ে,
হাসিখুশি আনন্দেতে ঘর ওঠে ভরে।
জামাতা আসিলে ঘরে পড়ে যায় সাড়া,
জামাতার আপ্যায়নে মেতে ওঠে পাড়া।
অন্ন ব্যঞ্জনাদি রাঁধে করিয়া যতন,
পলান্ন ক্ষীর পায়েস বিবিধ ভোজন।
চিনি পাতা দই আর মিষ্টান্ন ও আম,
ইলিশের মাথা চাই হোক যত দাম।
জামাতার আপ্যায়নে ব্যস্ত লোকজন,
ভাল করে করা হয় সব আয়োজন।
জামাইবাবুরে ডাকি আসনে বসায়,
ভোজনান্তে গুঁয়াপান শ্যালিকা সাজায়,
আজিকে জামাইষষ্ঠী ভারি ধূম হয়,
খুশির জোয়ার আসে সারা পাড়াময়।
জামাইষষ্ঠীর আয়োজন
- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
জামাই ষষ্ঠীর দিনে, ভারি ধূমধাম,
ঘরদোর পরিস্কার, অতি ছিমছাম।
কার্পেটে জড়ানো মেঝে, সোফা গদিআঁটা,
পালঙ্কে চাদর দামী, তাতে নক্সাকাটা।
জানালার পর্দাখানি, অতি মনোহর,
সুসজ্জিত দরজায়, শোভিছে ঝালর।
টেবিলেতে ফুলদানি, সযতনে রাখা,
সম্মুখে পূজার ঘর, আলপনা আঁকা।
জামাই আসিছে, তাই পড়ে যায় সাড়া,
শাশুড়ির ঘুম নেই, কত কাজে তাড়া।
শ্বশুর দায়িত্বহীন, বসে থাকে ঘরে,
শাশুড়ি হিসাবমত, কেনাকাটা করে।
ত্রুটি যেন নাহি হয়, জামাই আসিলে,
যতনে সাজায় ঘর, তিন শালী মিলে।
জামাইষষ্ঠীর আয়োজন ২
- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
জামাইষষ্ঠীর দিনে আসবে জামাই বাবাজীবন,
ঘরে ঘরে হচ্ছে তাই, জামাইষষ্টীর আয়োজন।
আনবে বড় দেখে রুই তিন কেজি ওজনের,
বাজারেতে খোঁজ নিয়ো কত দাম ইলিশের।
গলদা চিংড়ি পাবদা কই, এনো ঝোলা ভরে,
শিঙ্গি মাগুর ও কাতলা, চিনবে ভালো করে।
দামী দামী ভালো সন্দেশ রাখবে এনে ফ্রিজে,
রসগোল্লা পানতোয়া যেন থাকে রসে ভিজে।
ভালভাবে হওয়া চাই জামাইয়ের আপ্যায়ন,
ঘরে ঘরে হচ্ছে তাই জামাইষষ্ঠীর আয়োজন।