হিন্দু বাঙালিদের দোল উৎসবের কয়েক দিন আগেই সাঁওতালদের নববর্ষ উৎসব হয়, তার নাম বাহা। বাহা মানে ফুল, নানা কারণে এখন প্রায় সবাই সে কথা জানেন। শালগাছ, যা কিনা সাঁওতালদের পবিত্র গাছগুলির মধ্যে অন্যতম, তার ফুল এলে বাহা-র সময় হয়। শালের বা সারজোম, যে নামে এই বৃক্ষপ্রিয় জনগোষ্ঠি এই গাছকে ডাকেন, তার ফুল সম্পর্কে ‘এলে’ই বলতে ইচ্ছে করে এমন সে ফুল হালকা। যেন রুপোর নাকফুলের মতো মিহি আর, অবিশ্রান্ত ঝুরু ঝুরু করে প্রায় উড়ে পড়ছে সেই সমুন্নত বৃক্ষের অঞ্জলি থেকে। প্রকৃতির সেই গাঢ়বসন্ত শ্বেতসুগন্ধ রূপই নতুন বছরের সবচেয়ে শুদ্ধ রূপ যেন। আশপাশে সাজানো শালের কচি সবুজ পাতা আর লাল মাটির ঢেউখেলানো নাচ। এই নাট্যপটে হয় বাহা উৎসব।


গ্রামের নাইকি হাড়াম বা পুরোহিত একটি নতুন কুলোয় সারজোমের পাতাসুদ্ধ ফুল রেখে সকলের বাড়িতে ঘুরিয়ে তা দেখিয়ে আনবেন। প্রত্যেক গৃহস্থের মেয়ে-বউরা তাকে পা-ধোয়ার জল দেবে, আদর করে উঠোনে ডেকে নেবে। বাহা-র আগে উঠোন নিকোনো হবে জেরের কাঠ বুলিয়ে, মসৃণ করে। দেওয়ালে আঁকা হবে পাতাসুদ্ধ ফুল, ময়ূর, মোরগ। সন্ধ্যাবেলায় হবে গান, নাচ। এই সর্বব্যাপী আনন্দের প্রধান অঙ্গ হল সকলের প্রতি ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। পবিত্র বনস্থলীকে, পরস্পরকে, ছোটদের—সকলকে আদর জানানো, সৌন্দর্যের আমন্ত্রণ করা, শুভেচ্ছা জানানোই বাহা উৎসবের আসল বিষয়।


সমাজের সকলে, বিশেষত যুবকযুবতীরা, পরস্পরের গায়ে জল ছুঁড়ে দেয়। কলসি বা অন্য কোন পাত্রে করে এই জল ছুঁড়ে দেওয়া সকলেই খুব প্রসন্নভাবে নেয়। ওই জল ছোঁড়ার মানে হল, গত এক বছরে আমি যদি জেনে বা না-জেনে তোমার মনে কোন দুঃখ দিয়ে থাকি এই নতুন বছরে জল দিয়ে তা ধুয়ে দিলাম।


বাঙালিদের নববর্ষে পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করার, পরস্পরকে আলিঙ্গন করার বিধি ছিল। আর, তা ছিল যেন অনেকটা বেশি ঘরোয়া ভাবে। বাচ্চা থেকে প্রবীণ— সকলেরই এক রকম অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকত পাড়া, প্রতিবেশীর সঙ্গে। সেটা সর্বদাই গভীর প্রেমপূর্ণ, এমন নাও হতে পারে। কিন্তু বিজয়া, ঈদ বা নববর্ষের দিনে সেই বিভেদ বা সোজা কথায় মন কষাকষি ভুলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা, এক সঙ্গে মিষ্টি খেয়ে শুভকামনা করা, এই প্রথা প্রচলিত ছিল। আজ মনে হচ্ছে, সেও তো এক রকম ধুয়ে দেওয়াই। হয়ত সেই প্রাচীন সামাজিক সম্পর্কেরই বিকল্প হয়েছে আজকে নগরজীবনের বিভিন্ন হাউজিং বা ফ্ল্যাট-সোসাইটি। হতেই হবে, কারণ মানুষ মূলত সামাজিক জীব। অন্যের সঙ্গে ভাগ না করে কোনও সুখ বা দুঃখকে সে ঠিকমতো বোধের মধ্যে নিতে পারে না বলেই হয়ত নানা উৎসবের উপলক্ষ তৈরি করেছে।


সেই অবসরগুলিতে সে একক সংসার ছেড়ে সমাজের সঙ্গে মেলে। কবে থেকে কোন বছর গোনা শুরু হল, কখন চান্দ্রমাস আর কোথায় বা সৌরমাস— ‘পণ্ডিতেরা বিবাদ করুন লয়ে তারিখ সাল’। নতুন বছরটিকে বরণ করে নেওয়া, এ কথা জেনেই যে, এ হবে ঠিক আগের বছরেরই মতো এবং মাত্র এক বছরই স্থায়ী। তবু সজ্জায়, শুভেচ্ছায় এই উপলক্ষটিকে ভরিয়ে তোলা সংস্কৃতির এক অঙ্গ হয়ে আছে। বাইরের সজ্জা যখন অন্তর থেকেও উদ্‌যাপিত হয়, তখন তাতে মেশে অপূর্ব সুগন্ধ। কোনও বিশেষ সমাজ নয়, প্রায় সব সমাজেরই আছে এরকম সব শুভক্ষণ। শুভ উৎসব। সে সবের মধ্যে স্তরে স্তরে মানব সমাজের কত যে ভাবনার ছবি, প্রাকৃতিক চিহ্নাবলী সাজানো রয়ে যায়, তার এক রূপমঞ্জুষা রয়ে গিয়েছে। কখনও এক, দু’টি হিমশৈলের চূড়ায় তার রহস্য হঠাৎ ঝলক দিয়ে যায়।


পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বৃহৎ অঞ্চলে এই পরস্পরের গায়ে জল দেওয়া, অর্থাৎ গত এক বছরের দোষ, ত্রুটি প্রক্ষালন করে দেওয়া নববর্ষ উৎসবের এক বিশিষ্ট অংশ। প্র-ক্ষালন শব্দটিও প্রণিধানযোগ্য। সাধারণ ভাবে ‘ক্ষালন’ শব্দের মানে (মালিন্য) মোচন করা। কিন্তু তার আগে প্র-উপসর্গ যুক্ত হলেই তার অর্থ দাঁড়ায় ধোয়া, অর্থাৎ কাজটার সঙ্গে আবশ্যিক ভাবে জল যুক্ত হল। বিশেষ করে বৌদ্ধধর্ম প্রধান অঞ্চলে, জাপানে, মায়ানমারে, বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এই প্রথা নববর্ষ পালনের সঙ্গে যুক্ত। নানা নদী বা জলাশয়ে প্র-ক্ষালন অথবা অবগাহন স্নানের সঙ্গে।


জলের সঙ্গে আরও খানিক মিষ্টতা যুক্ত আছে পাঞ্জাবী নববর্ষ উৎসব পালনে। বাংলা নববর্ষের এক দিন আগে ‘বৈশাখী’। নতুন বছর বরণে পাঞ্জাবীদের প্রধান উপাচার চেনা-অচেনা নির্বিশেষে লোকদের বড় বড় গ্লাসে করে সরবত খাওয়ানো। শুকনো ধুলো ওড়া গ্রীষ্মের দিনে তার চেয়ে যত্ন আর কিসে! সে সব গ্লাসের আলাদা নামই ‘বৈশাখী গ্লাস’। মনে আছে, পঞ্চনদের দেশে জল সঙ্কট শুরু হওয়ার দিনকালে এক তরুণের চোখ ছলছল করে ওঠা, ‘বতাও বহনজি, বিসলেরিকে পানি খরিদকে বৈশাখী কৈসে মনাউঁ?’


আবার প্রতিবেশী রাজ্য ওডিশায় এই ‘বৈশাখী’ উৎসবই অন্য ভাবে বরণীয়তা পাচ্ছে ‘বিষুব সংক্রান্তি’ নামে। বাংলা নববর্ষের আগের দিন এই বিষুব সংক্রান্তির বৈশিষ্ট্য হল একই দিনে বর্ষশেষ ও বর্ষশুরু পালিত হয়। দু’বছর আগে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, হরেকৃষ্ণ মহতাবের ছেলে ভর্তৃহরি মহতাবের আমন্ত্রণে তাঁদের সাহিত্যপত্র ‘ঝংকার’এর হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে কটক গিয়ে এই উৎসব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। সেখানেও এই সকলে মিলে এক সঙ্গে খাওয়া, উৎসবের এক প্রধান অঙ্গ। খাওয়ার মূল উপকরণের মধ্যে বেশিরভাগই গ্রীষ্মের উপযোগী উপকরণ। সকলে মিলে একসঙ্গে খাওয়াটাই প্রধান উৎসব।


আজকের বৃক্ষ-ছায়াহীন, জলাশয়হীন, রুক্ষ দগ্ধ পয়লা বৈশাখের সঙ্গে একশো বছর আগেকার নতুন পাতায় ঝলমলে গাছপালা ভরা, পুকুরের জলে ঢেউ দিয়ে জল ছুঁইয়ে আসা পয়লা বৈশাখের বোধ হয় বেশ কিছুটা অমিল ছিল। পয়লা বৈশাখের অঙ্গে জড়ানো থাকত বেলফুল আর নিমফুলের মৃদু গন্ধ। ফলের সরবত।


পয়লা বৈশাখে বাঙালির সেই সুখস্মৃতি এখনও অনেকখানি বহন করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। বাংলা কবিতার আসরের সকল কবি ও পাঠকগণকে জানাই শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি আর শুভেচ্ছা। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!


শুভ নববর্ষ
              লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


শুভ নববর্ষ আজি, পয়লা বৈশাখ,
বর্ষ-বরণ মেলায় বেজে ওঠে শাঁখ।
বাঙালীর সুখস্মৃতি পয়লা বৈশাখে,
সুপ্রভাতে তরুশাখে পাখিসব ডাকে।


শুভ নববর্ষে সবে হরষিত মন,
নতুন প্রভায় প্রভা দিতেছে তপন।
ফুলে ফলে নদীজলে নতুনের সুর,
পুরানো বিষাদ যত সব হোক দূর।


শুভ নববর্ষ আজি, হর্ষ প্রতি ঘরে,
সুখ দুঃখ কান্না হাসি সারাবর্ষ ধরে।
অজয়ের খেয়াঘাটে মাঝি ধরে গান,
কোকিলের কুহুতানে ভরে মনপ্রাণ।


আন্তরিক প্রীতি মোর করিও গ্রহণ,
নববর্ষে কাব্য রচে ভাণ্ডারী লক্ষ্মণ।