ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (ষষ্ঠ পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


ভাদু আদতে লোকজীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মেয়েদের গান। শুধু তাই নয়, ভাদু আসলে লোকউৎসবও। যে গান, যে উৎসবের গড়ন, রীতি ঐ রাজপরিবারের দরবার ছাড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। এ কেমন করে সম্ভব? ভদ্রাবতীকে নিয়ে আরেকটি গল্পে হয়তো রয়েছে এর ইঙ্গিত। সেই গল্পে ভদ্রাবতী রাজার ঔরসজাত রাজকন্যে নয়।


লাড়া গ্রামের মোড়ল এক ভাদ্রমাসে ধানখেতের আলের পাশ থেকে কুড়িয়ে পেলেন ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানকে। তাকে কোলে নিয়েই মোড়ল বুঝলেন, শিশুটি সদ্যোজাত। কে জানে, হয়তো এই উর্বরা ভূমিই জন্ম দিয়েছে তার। যেভাবে ভূমি জন্ম দিয়েছিল সীতারও। মোড়ল শিশুটিকে নিয়ে এলেন ঘরে। সেই ভাদ্র ছিল রোদে পোড়া, খটখটে। কিন্তু, এই মেয়ে ঘরে আসতেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। ধান হল খুব। সবাই বললে, এ মেয়ে ভারী লক্ষ্মীমন্ত। মোড়ল-দম্পতি মেয়ের নাম দিলেন ভদ্রাবতী। ডাকনাম ভাদু। ভাদুর রূপ হল খুব। চাষির ঘরে এমন রূপ মানায় না। রাজা নীলমণি সিংদেওর কানেও গেল ভাদুর কথা। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদকে রাজা বললেন, ওই মেয়েকে তিনি দত্তক নেবেন। রাজপরিবারই ওর যোগ্য স্থান। কিন্তু, ভাদু কিছুতেই যেতে চাইল না বাবা-মাকে ছেড়ে। তখন রাজা গ্রামে-গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে বলে দিলেন, রাজপ্রাসাদে না থাকলেও ভদ্রাবতী রাজকন্যেই।


ভাদু তখন ষোড়শী। তার কানে উজিয়ে আসে বাঁশির সুর। গ্রামের কবিরাজের ছেলে অঞ্জন সেই বংশীবাদক। মন দেওয়া-নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে, হইহই করে পঞ্চকোটেও এসে পড়ে ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহে মদত দেওয়ার অভিযোগে ইংরেজদের হাতে বন্দি হন রাজা নীলমণি সিংদেও। রাজা বন্দি, এদিকে রাজকন্যে প্রেমে পড়েছে কবিরাজপুত্রর। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। রাজা মুক্তি পেতেই সে জানায় সবটা। ক্রুদ্ধ রাজা বন্দি করেন অঞ্জনকে।


অঞ্জনের কয়েদের খবরে ছুটে আসে ভদ্রাবতী। তার করুণ আকুতিতেও মন গলে না রাজার। তখন ভাদু, দিনের পর দিন হৃদয় নিঙড়ানো করুণ গান গেয়ে ঘুরতে থাকে কয়েদখানার চারপাশে। সেই গানে একদিন মন গলল রাজার। অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন তিনি। কিন্তু, ভাদুর খোঁজ আর মেলে না। কেউ বলল, ভাদু শোকে আত্মঘাতী হয়েছে নদীর জলে। কেউ বলল, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল ভাদু, আবার ফিরে গেছে আকাশেই। বাকিরা বলল, ভাদু ভেসে গেছে নদীর কান্নার সঙ্গে। সেই থেকে ভাদুর গান ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের নানান কোণে।


এই গল্প বিশ্বাস করতে বড়ো সাধ হয়। যদিও, বীরভূমে গেলে দেখা যাবে ভদ্রাবতী নাকি পুরুলিয়ার নন, হেতমপুরের রাজকন্যে। বর্দ্ধমানের রাজপুত্রকে মন দিয়েছিল সে। ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতরা যখন মেরে ফেলল রাজুপুত্রকে, তখন তাঁর সঙ্গেই সহমরণে গেছিল ভদ্রাবতী। সেই যন্ত্রণার ইতিহাসই নাকি বোনা ভাদু গানে।


ভাদু গানের আসর  আমার গীতিকবিতা (পঞ্চম পর্ব)
কথা - আঞ্চলিক সুর - অপ্রচলিত
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।


আয় আদুরী আয় কাজুরী ভাদুপূজা করব্য আয়,
গেন্ধা ফুলের মালা গাঁথে পরাব্যঅ ভাদুর গলায়।


তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।


বাড়ির নামু গয়ল্যা পোখর ধারে ধারে কলাগাছ,
আমার ভাদু খায় না খাড়ি খেতে দিব পোনামাছ।


তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।


আঁচিলে পাঁচিলে কত পোরুলের ফুল ফুটেছ্যা,
পোরুল ভাজা খেতে মজা জিভে জল আসিছ্যা।


তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।


গুড় বাতাসা ফুল বাতাসা ভাদুকে দিব কলাপাকা,
চিড়া গুড় আর দুধের চাঁছি কুলুঙ্গিতে আছে রাখা।


তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।