ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (সপ্তম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


কাশীপুরে দেখে আইলাম / দালান কোঠায় টিকটিকি, / এমনই বাবার বিবেচনা / এক জামাইকে দুই বিটি। লালপাড় শাড়ি পরে কোমর দুলিয়ে ঢোলের নিখুঁত বোলের সঙ্গে গাইছেন শঙ্করী দাস, কুমকুম দাসরা। কাটোয়ার চুড়পুনি গ্রামের দাসপাড়ার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মহিলারা বছর বছর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন ভাদু গাইতে বেরিয়ে পড়েন। মাটির তৈরি ভাদু ঠাকরুণকে নিয়ে। কাটোয়া মহকুমার নানা গ্রাম ঘুরে পয়লা আশ্বিন গঙ্গায় স্নান করে ঘরে ফেরেন।


ভাদু গানের মতো পুরনো লোকগানকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে চুরপুনি দাসপাড়া। বিভিন্ন জায়গায় ভাদু দলে পুরুষরা মেয়ে সেজে গান–নাচ করেন। কিন্তু চুড়পুনির ভাদু গাওনার পুরো দলটিই মহিলাদের। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের ১৩ জন মহিলার দলটি ভাদ্র মাস পড়লেই সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে মহড়া শুরু করে দেন। মূল গায়েন শঙ্করী দাস গান ধরেন, মাটি ফুঁড়ে জল সরে / ভাদুকে কে সাজাইছে। দলের অন্যান্য সদস্য সুমিত্রা দাস, কুমকুম দাসরা ধরতাই দেন, সেই জলে জমি আবাদ হছে / ভাদুকে কে সাজাইছে।


কাটোয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক রণদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ভাদুকে সামনে রেখে গাওনার দলের সদস্যরা তঁাদের রাগ–দুঃখ–জ্বালা–অভিমান–আনন্দ গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই গানে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার প্রকৃত ছবিটা ধরা পড়ে। শস্যকন্যা ভাদুর মধ্যে নিজেকে খোঁজার এই ধারাটিই ভাদু গানের নজরটানা বৈশিষ্ট্য। শুধু কাটোয়া মহকুমাই নয়, দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া জেলাতেও ভাদ্র মাসজুড়ে ভাদু গানের উৎসব চলে।’ গায়িকা শঙ্করী–কুমকুমরা প্রশাসনকে কুর্নিশ জানিয়েছেন।


তাঁরা বলেন, ‘আমাদের দলে সকলে মহিলা। কিন্তু আমরা নিরাপদেই গ্রামে গ্রামে ঘুরতে পারছি। এটা খুবই ভাল ব্যাপার।’ ভাদুকে ফসলের প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। শ্রাবণ মাসে ধান রোয়া–সহ চাষবাস শেষ হয়ে যায়। ভাদ্র মাসটা কৃষক পরিবারের সদস্যদের কাছে অখণ্ড অবসর। সেই অবসর যাপনের জন্য বিনোদন হিসেবে ভাদু গানের উৎপত্তি বলে মনে করেন লোক গবেষকরা।


ভাদু–মূর্তিকে সামনে রেখে ফসল ভাল হওয়ার প্রার্থনা করেন শিল্পীরা। অঝোর বৃষ্টি চান গানে গানে, চল্ ভাদু চল্ / মেঘে এল জল / ভিজে গেল দামি শাড়ি / ভেঙে গেল মল। কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি বলেন, ‘বর্তমান রাজ্য সরকার ভাদু–সহ বাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি বঁাচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। লোকশিল্পীদের মাসোহারার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির শাখাগুলিকে বঁাচাতে এমন পদক্ষেপ এর আগে কেউ নেয়নি।’


ভাদু গান গেয়ে ঘুরে বেড়ানোর শিল্পীরা কোনও পারিশ্রমিক দাবি করেন না। যার যা মন চায় দেন শ্রোতা–দর্শকরা। তাতেই খুশি শিল্পীরা। তবে দক্ষিণা দাবির কৌশলটিও বেশ। দাবি করা হয় গানের কলিতেই, ভাদু লে লে লে পয়সা দু’আনা / কিনে খাবি মিছরিদানা। সেই আবেদনে পয়সার বটুয়া উপচে পড়ে। শিল্পীদের হাসি চওড়া হয়। টিভি–মোবাইলের যুগেও মানুষ ভাদু গান শুনছেন, এটাই শিল্পীদের প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তির আনন্দই গানে গানে ঝরে, এক পিঠ চুল ভাদুর / পিঠের পরে রহে না/ শাশুড়িতে তেল দেয় না / চুলের যতন জানে না।


ভাদু গানের আসর  আমার গীতিকবিতা (সপ্তম পর্ব)
কথা - আঞ্চলিক সুর - অপ্রচলিত
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


চল ভাদু জল আনত্যা যাব, অজয় লদীর ওই ঘাটে।
মাঠ্যের আল্যে ছাগল চরে ফকির ডাঙার ধানখ্যাতে।


ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো  জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।


জল ভর জল ভর ভাদু তুমার কাঁখের কলসীত্যা।
সিনান করে জল ভরে আসবেক ভাদু  বাড়িত্যা।।


ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।


লদীর ঘাটে কালী মন্দির লিতুই জুড়া পাঁঠা বলি হয়।
সাঁজ্যের বেলায় ঘন্টা বাজে রাত বিরেতে লাগে ভয়।।


ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো  জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।


অজয় লদীর ধারে ধারে শাল পিয়াল কুলের বন।
আসছ্যে বছর এমন দিনে আনব্য ঘুরাঁই ভাদুধন।।


ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো  জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।