যা দেবী সর্বভূতেষু… মহিষাসুরমর্দিনী
মহালয়া স্তোত্রম্ – দ্বিতীয় পর্ব।  
সংগ্রহ, সম্পাদনা ও স্তোত্রপাঠ- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।


সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বাথসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে।।


সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানং শক্তির্ভূতে সনাতনী।
গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোহস্তু তে।।


মা আসছেন তাই সর্বত্র শুরু হয়ে গিয়েছে তারই প্রস্তুতি। এই মা দুর্গাকে নিয়ে আছে নানান কাহিনী। এই মা দুর্গা আসলে কে বা তার জগৎজননী হয়ে ওঠা পেছনে আছে এক কাহিনী।
মা দুর্গার সেই কাহিনী বলতে গেলে উঠে আসে নানা তথ্য। সেই তথ্য জানতে হলে ঘাটতে হবে পুরাণও।


দুর্গাপুজোর আর মাত্র কয়েকটা দিন। পুজোর কেনাকাটা, প্ল্যানিং বহু ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে সবার। প্রতি বছর মহান উদ্যোগ এবং উদ্দীপনা সাথে উদযাপিত হয় দুর্গোৎসব। পুজোর কিছুদিন বাকি থাকলেও, দেবীপক্ষের সূচনার দিন অর্থাৎ ‘মহালয়া’ প্রত্যেকের দরজায় কড়া নাড়ছে। এইবছর, মহালয়া পড়েছে ২৮ সেপ্টেম্বর। অতএব, ইতিমধ্যেই উৎসবের প্রস্তুতি জোরকদমে চলছে।


কোন বাহনে চড়ে দেবীর আগমন ও গমন হবে এবার? কীভাবে নির্ধারিত হয় দেবীর আসা যাওয়া?
প্রতি বছরই বাঙালি বিজয়ার পর থেকে পরের বছরের পুজোর (puja) জন্য অপেক্ষা করে। ‘আসছে বছর আবার হবে!’ এই কথা যেন সার্থক। আর মহালয়া হয়ে গেলে তো আর কাজ কর্মে একদমই মন বসে না। তবে আমরা যেমন রূপচর্চা থেকে শরীরচর্চা থেকে শপিং এসব নিয়ে মেতে থাকি, বাড়ির বড়রা গম্ভীর মুখে বসে পড়েন পাঁজি বা পঞ্জিকা নিয়ে। তাঁদের চিন্তার বিষয় হল, এবার দেবী কিসে আসছেন (coming) আর কিসে যাবেন (going)। অর্থাৎ দেবীর আগমন ও গমন কিসে । কিন্তু এটা নিয়ে এত ভাবনা চিন্তার কী আছে। চিন্তার বিষয় একটাই। দেবী কিসে আসছেন আর কিসে যাচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। দেবী যাওয়ার পর ফসল কেমন হবে, দেশে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটবে কিনা, এসব নাকি নির্ভর করে এই আসা যাওয়ার উপর! তা এবারে কিসে  করে আসছেন মা দুর্গা (durga)? যাচ্ছেনই বা কিসে?


এবার পুজো শুরু হচ্ছে ৩ অক্টোবর থেকে। সেদিন হল পঞ্চমী। পঞ্জিকা বলছে এবার মা আসছেন ঘোটকে বা ঘোড়ায় চেপে। দশমীর দিন তিনি ফিরেও যাচ্ছেন ঘোড়ায় চেপে। অর্থাৎ এই বছরে দেবীর আগমন ও গমন ঘোটকে। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা বলছেন, ঘোড়ায় আগমন ও গমন মোটেই শুভ নয়। ঘোড়া ছটফটে প্রাণী। সে যখন যায়, সব কিছু ছত্রভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই দেবীর ঘোটকে আগমন ও গমনে প্রমাদ গুনছেন শাস্ত্রজ্ঞরা। এতে ফসল নষ্ট হওয়ার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা ও খরা হতে পারে। দেখা দিতে পারে মহামারী ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। জানেন কি কীভাবে দেবীর বাহন প্রতি বছর বেছে নেওয়া হয়। অর্থাৎ তিনি কিসে চড়ে আসবেন ও যাবেন, সেটা জানার জন্য একটা মজার অঙ্ক আছে!


শাস্ত্র বলে


দেবীর মর্তে আগমন হয় সপ্তমীতে আর গমন হয় দশমীতে। এই দুটো দিন কোন বার পড়েছে সেই অনুযায়ী ঠিক হয় দেবী কীসে আসবেন আর কিসে যাবেন। উপরের এই শ্লোক দেখে বোঝা যাচ্ছে, সপ্তমী ও দশমী রবিবারে পড়লে দেবী গজ বা হাতিতে আসবেন ও যাবেন। যদি সপ্তমী শনিবার বা মঙ্গলবার হয় তা হলে ঘোটক বা ঘোড়ায় আসবেন। যেমনটা এই বারে হয়েছে। বৃহস্পতি বা শুক্রবার সপ্তমী হলে দেবী দোলায় আসবেন। আর বুধবার সপ্তমী বা দশমী পড়লে, তিনি নৌকায় আসবেন। দেবী কিসে করে এলে ঠিক কী হতে পারে, তার বর্ণনাও শাস্ত্রে আছে। যেমন বলা হচ্ছে, “গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা।” অর্থাৎ গজে এলে বা গমন হলে বসুন্ধরা শস্য শ্যামলা হয় অর্থাৎ ফসল ভাল হয়। আবার “ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে” এটি বলা হয় ঘোটকের ক্ষেত্রে। নৌকার ক্ষেত্রে বলা হয় “শস্যবৃদ্ধিস্থুতাজলম”। অর্থাৎ নৌকায় এলে শস্য দ্বিগুণ হয় কিন্তু বন্যা দেখা দিতে পারে। দোলায় বা আগমন বা গমনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, “দোলায়াং মরকং ভবেত।” অর্থাৎ দোলায় এলে বা গমন হলে মহামারী, ভুমিকম্প বা বড় রকমের যুদ্ধ হতে পারে।


বর্ষার দীর্ঘ বর্ষণ শেষে যখন সাদা তুলোর পেঁজার মতো মেঘদল আকাশে ভেসে বেড়ায়, রাতে ঝরে মৃদু শিশির, তখন শরতের প্রাক্কালে অরুণ রাঙা দৃপ্ত চরণে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। শাঁখ কাঁসার শব্দে, উলুধ্বনিতে, চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে মর্ত্যালোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার ধরাধামে আগমনই শুভ মহালয়া হিসেবে পরিচিত। অসুরনাশিনী দেবী দুর্গা প্রতি বছর মর্ত্যে আসেন তার ভক্তকূলের জন্য শক্তির বর নিয়ে।

তৈত্তেরীয় আরণ্যকে প্রথম দুর্গা শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে শব্দটা যে একটি প্রাচীন শব্দ তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি সর্ববিধ দুঃখ, দুর্গতি ও ভয় হরণ করেন তিনিই দুর্গা। স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে যে রুরুদৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করায় “তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমখ্য মহাসুরম্”। শুধু রুরুকেই নয় তিনি বিভিন্ন সময় বহু অত্যাচারী দৈত্যাদি যেমন মধুকৈটভ, শুম্ভনিশুম্ভ, মহিষাসুর, দুর্গামাসুর ইত্যাদি অত্যাচারী দৈত্যাদিকে বিনাশ করে জগৎবাসীর দুর্গতি নাশ করেছিলেন বলেই তিনি দুর্গা নামে পরিচিত। প্রচলিত ধারণা অনুসারে যিনি বিভিন্ন প্রকার বাধা বিঘ্ন, রোগ-শোক, পাপভয়, শত্রু ও বিপদ থেকে মুক্ত করেন তিনিই দুর্গা।


এই দুর্গা আবার জগতের কল্যাণকারী তাই তিনি জগৎজননী। তিনি ভক্তদের ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ দান করেন বলেই তিনি সর্ব কামার্থদায়িনী। তিনি জগতের অন্নদাতা, তাই তিনি অন্নদা। রুদ্রের ঘরনি তাই তিনি রুদ্রাণী। শত অক্ষির দ্বারা তিনি সকল কিছুই লক্ষ করে থাকেন বলেই তিনি শতাক্ষী। তিনি পরম বৈষ্ণব তাই তিনি বৈষ্ণবী, তার অঙ্গকান্তি গৌরবর্ণা তাই তিনি গৌরী এবং পর্বত দুহিতা তাই পার্বতী। তিনি বহু নামের অধিকারনী। স্বরূপত তিনি এক ও অভিন্ন এবং অনন্য শক্তির রূপে রূপান্তরে প্রকাশ হওয়ায় তিনি মহাশক্তি মহামায়া।


বিভিন্ন দেবতার তেজপুঞ্জে সৃষ্টি হয়েও তিনি সমস্ত তেজের উৎস রূপেই প্রতিভাত তেজময়ী। এই দেবীই মহিষাসুরকে দমন করার পর শাস্ত্রমতে শিবের পায়ে প্রবেশ করে। তাই বলা হয়ে থাকে এই দুর্গা আসলে রুদ্রপন্তী উমা, অম্বিকা, হৈমবতী, দুর্গা , গৌরী, ভবানীর মিলিত দৈব সত্তা। ভাবপ্রবণ বাঙালির কাছে তিনি পরিপূর্ণ ভাবেই শিবপত্নী শিবানী বা দুর্গা। তাই দুর্গা প্রতিমার চালচিত্রে দুর্গার মাথার উপরে শিবের অবস্থান। সেই সঙ্গে তার দুর্গার দুপাশে তাঁর সন্তান সন্ততির অবস্থান। যে রূপে শারদীয়া দুর্গা পুজোতে দুর্গা পুজিত হন।


এই দেবী দুর্গা আমাদের রক্ষাকর্ত্রী তাই চণ্ডীতে বলা হয়েছে-


বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথাসংহতি রূপান্তে জগতোহস্য জগন্ময়ে।।
মহাবিদ্যা মহামায়া মহা মেধা মহা স্মৃতি,
মহা মোহ চ ভবন্তি মহাদেবী মহাসূরী।


হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে–  দেবী বিশেষ।


যে দেবী অগম্যা, দুষ্প্রাপা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না এই অর্থে– দুর্গা। দুর্গ নামক দৈত্যকে দমন করে ইনি দুর্গা নাম প্রাপ্ত হন। হিন্দু ধর্মমতে– পরমাপ্রকৃতি স্বরূপা মহাদেবী, পত্নী । মার্কেণ্ডেয় পুরাণের মতে– ইনি মহামায়া, পরমবিদ্যা, নিত্যস্বরূপা, যোগনিদ্রা। ইনি জন্মমৃত্যু-রহিতা। আদিকালে যখন যোগনিদ্রায় ছিলেন, তখন মধু ও কৈটভ নামক দুটি ভয়ঙ্কর দৈত্য ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। এই সময় ব্রহ্মা যোগমায়া রূপী এই দেবীকে বন্দনা করেন। পরে এই দেবীর দ্বারা বিষ্ণু বলিয়ান হয়ে এই দৈত্যদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। আবার এই দেবীর প্রভাবে দৈত্যরা বিষ্ণুর সাথে যুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।


শরতের আগমনী-পূজোর কবিতা সংকলন
সমাপ্তি পর্ব- পূর্ব প্রকাশিত পূজোর আগমনী কবিতা
কবি-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


শরৎ এসেছে, পরাগ মেখেছে
শিউলি ফুটেছে বনে,
বেলি ও টগর শোভে মনোহর
শরতের আগমনে।


শারদ আকাশে পূবে রবি হাসে
সোনা রোদ আঙিনায়,
পূজা এলো কাছে মন্দির মাঝে
ঢাকীরা ঢাক বাজায়।


শারদ আকাশে সাদা মেঘ ভাসে
অজয়ের দুই কূলে,
অজয়ের চরে শালিকেরা উড়ে
শোভা দেয় কাশফুলে।


সবুজের খেতে প্রাণ উঠে মেতে
সুশীতল হাওয়া বয়,
সোনা রোদদুরে অজয়ের চরে
স্মৃতি হয়ে কথা কয়।


যেদিকে তাকাই দেখিবারে পাই
শরতের সোনা ছবি,
পূর্বদিকে দেখি লাল রং মাখি
ওঠে শরতের রবি।