যা দেবী সর্বভূতেষু… মহিষাসুরমর্দিনী
মহালয়া স্তোত্রম্ – পঞ্চম পর্ব।  
সংগ্রহ, সম্পাদনা ও স্তোত্রপাঠ- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।


দেবী পূজা
সত্যযুগে এই দেবীর পূজার প্রচলন হয়। সত্যযুগের রাজা ও সমাধি বৈশ্য দুর্গামূর্তি তৈরি করে তিন বৎসর পূজা করেন। ত্রেতাযুগে রাবণ চৈত্রমাসে (বসন্তকালে) এঁর পূজা করতেন। সে কারণে এই পূজার নাম বাসন্তী পূজা বলা হত। রামচন্দ্র রাবণের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে আশ্বিন মাসে (শরত্কাল) অকালে দুর্গার পূজা করেন। সে কারণে এই পূজাকে দুর্গার অকালবোধন বলে। বাংলাদেশে রামচন্দ্রের অনুসরণে এই পূজা, শারদীয়া দুর্গা পূজা হিসাবে পালিত হয়।


দুর্গার সকল রূপের নাম-তালিকা :


অগসূতা, অগাত্মজা, অতসীপুষ্পবর্ণাভা, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, অনন্তা, অনাদ্যা, অন্নদা, অন্নপূর্ণা,  অপরাজিতা,  অপর্ণা,  অব্যয়া, অভয়া, অমোঘা, অম্বা, অম্বালা, অম্বালিকা, অক্বিকা, অষ্টভুজা,অসুরনাশিনী, আদিদেবী,  আদিভুতা,  আদ্যা,  আদ্যাশক্তি, আনন্দময়ী,  আর্যা,  ঈশানী, ঈশ্বরী,  উমা,  কপর্দিনী,  কাত্যায়নী,  কাণ্ডবারিণী,  কামাক্ষী,  কৈলাশবাসিনী,  কৌশিকী,  ঈশানী,  গিরিকুমারী,  গিরিজা,   গিরিনন্দিনী,  গিরিবালা,  চণ্ডবতী,  জগদক্বা,  জগদ্ধাত্রী,  জগন্ময়ী,  জগন্মাতা, জয়ন্তী,  জয়া,  গিরিসূতা,  গৌতমী,  গৌরী,  চণ্ডী,  চামুণ্ডা,  জগজ্জননী,  জগদ্গৌরী, জ্বালমালিনী, তারিণী,  ত্রিগুণা, ত্রিনয়না, ত্রিনয়নী ত্রিশূলধারিণী, ত্রিশূলিনী,  দক্ষকন্যা,  দক্ষজা,  দশভুজা, দাক্ষায়ণী, দনুজদলনী,  দানবদলনী,  দুর্গা,  নগনন্দিনী,  নন্দা,  নিস্তারিণী, পরমাপ্রকৃতি,  পরমেশ্বরী,  পর্বতদুহিতা,  পর্বতসূতা,  পার্বতী,  প্রকৃতি,  বভ্রবী, বাভ্রবী,  বাসন্তী, বিজয়া,  বিন্ধ্যবাসিনী,  বিশ্বেশ্বরী,  ভগবতী,  ভদ্রকালী,  ভদ্রাণী,  ভবতারিণী,  ভাস্বতী,  মঙ্গলা,  মহাদেবী,  মহাবিদ্যা,  মহামায়া,  মহাশক্তি,  মঙ্গলচণ্ডী,  মহিষাসুরমর্দিনী,   মহেশানী,   মহেশী,  মোক্ষদা,  যোগমায়া,  রাজরাজেশ্বরী,  রুদ্রাণী, সতী,  সর্বজ্ঞা,  সাবিত্রী,  শঙ্করী,  শরণ্যা,  শর্বাণী, শাকক্ভরী,  শারদা,  শিবপত্নী,  শিবপ্রিয়া,  শিবা,  শিবানী,  শুভঙ্করী,  শুভচণ্ডী,  শূলিনী,  শৈলজা,  শৈলসূতা,  শৈলেয়ী,  সনাতনী,  সর্বজয়া,  সর্বমঙ্গলা, সর্বাণী, সর্বার্থসাধিকা, সাত্তি্বকী, সিংহবাহিনী,  সুরেশ্বরী, হিমালয়নন্দিনী, হৈমবতী।


দুর্গার দশ মহাবিদ্যা : কমলা, কালী, ছিন্নমস্তা, তারা, ধূমাবতী, বগলা, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, মাতঙ্গী, ও ষোড়শী।
দুর্গার ত্রিশক্তি : কালী, তারা ও ত্রিপুরা।
দুর্গার নয়টি মূর্তি : কাত্যায়নী, কালরাত্রি, কুষ্মাণ্ডা, চন্দ্রঘণ্টা, পার্বতী, ব্রহ্মচারিণী, মহাগৌরী, সিদ্ধিদা ও স্কন্দমাতা।


শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনীগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় আবার গ্রন্থের মধ্যম চরিত্র বা দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লিখিত  বধের কাহিনীটি। এই কাহিনি অনুসারে : পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ন সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনি শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমণ্ডল ভীষণাকার ধারণ করল। প্রথমে বিষ্ণু ও পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমণ্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হল। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হল। সু-উচ্চ হিমালয় স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। অন্য সূত্র থেকে জানা যায়, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন; শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে দেবী মহিষাসুর বধ করেন।


যাই হোক, এক এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল। প্রত্যেক দেবতা তাঁদের আয়ূধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তাঁর বাহন দান করলেন। এই দেবীই অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন (শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে, মহালক্ষ্মী দেবী মহিষাসুর বধ করেন। ইনিই দুর্গা। তবে বাঙালিরা এঁকে দশভূজারূপে পূজা করে থাকেন)। দেবী ও তাঁর বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে লাগল।


মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তাঁর বাহন সিংহ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে একে সকল যোদ্ধা ও অসুরসেনাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রজালিক মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন; কিন্তু দেবী সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন অসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করল। দেবী বললেন,


গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম।
ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।।


রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।।


এই বলে দেবী লম্ফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে তাঁর কণ্ঠে পা দিয়ে শূলদ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করে তাকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে পলায়ন করল এবং দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন।


শরতের আগমনী-পূজোর কবিতা সংকলন
মন্দিরে কাঁদে পাষাণ দেবতা
কবি-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


মন্দিরে কাঁদে পাষাণ দেবতা
দেবতার চোখে জল,
ঘরে কাঁদে তোর আপন জননী
চোখ করে ছল ছল।


মাটির প্রতিমা কি হবে পূজে
যে মুর্তি দেয় না সাড়া,
পথে কাঁদে কত ক্ষুধাতুর শিশু
কেঁদে কেঁদে দিশেহারা।


আধপেটা খেয়ে ধরিত্রীর বুকে
লাঙল চালায় যাঁরা,
মাটিতে ফলায় সোনার ফসল
অনাহারে থাকে তাঁরা।


ওরাই মানুষ, ওরাই দেবতা
ওরাই দেশের রাজা,
বিধাতার রুদ্র অভিশাপে আজ
ওরা পায় কেন সাজা?


মন্দিরে নাই দেবতা তোদের
দেবতা তোর সামনে।
মানুষ তোদের জাগ্রত দেবতা
এদের তো চিনিস নে?


মানুষকে যদি ভালবাস তুমি
মানুষের কর পূজা,
মানুষের পূজা করলে তবে
খুশি হয় দশ-ভূজা।


যেথা আছে জীব সেথায় শিব
জীবজ্ঞানে শিব সেবা।
জীবে প্রেম কর ঘৃণা নাহি কর
কর সেবা নিশি দিবা।


মন্দিরে কাঁদে পাষাণ দেবতা
পাথরের চোখে জল,
মানুষ দেবতা অভুক্ত রেখো না
অন্ন দাও অবিরল।


মন্দিরে কাঁদে মাটির প্রতিমা
পাষাণ দেবতা কয়,
অন্নহীনে অন্ন দানিতে এসো
হয়েছে পূজার সময়।


শোন বিশ্ববাসী এসেছে আজি
নর রূপে ভগবান,
মানবের সেবা ভগবানের পূজা
মানবের জয়গান।