যা দেবী সর্বভূতেষু… মহিষাসুরমর্দিনী
শ্রী শ্রী চণ্ডীস্তোত্রম্ – নবম পর্ব।  শ্রী শ্রী মহা-অষ্টমী
সংগ্রহ, সম্পাদনা ও স্তোত্রপাঠ- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।


আজ শ্রী শ্রী মহা অষ্টমী। অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হয়। জীবের দুর্গতি হরণ করেন বলে তিনি দুর্গা। আবার তিনি দুর্গম নামের অসুরকে বধ করেছিলেন বলেও দুর্গা নামে পরিচিতা হন। তিনি শক্তিদায়িনী অভয়দায়িনী। যুগে যুগে বিভিন্ন সংকটের সময় তিনি মর্ত্য ধামে আবির্ভূত হয়েছেন। বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন নামে। তাই তিনি আদ্যাশক্তি, ব্রহ্মা সনাতনী দুর্গা, মহিষ মর্দিনী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা বৈষ্ণবী, কৌমারী, বাহারী, চন্ডী লক্ষী, উমাম হৈমবতী, কমলা, শিবানী, যোগনিদ্রা নামেও পূজিতা। দেবী মা দুর্গার কাঠামোতে জগজ্জননী দুর্গা ছাড়াও লক্ষী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, সিংহ ও অসুরের মূর্তি থাকে।


এছাড়া পেঁচা, শ্বেতহংস, ময়ূর, ইঁদুর ও সবার উপরে শিবের মূর্তি বিদ্যমান। লক্ষী ধনের, স্বরস্বতী জ্ঞানের, গণেশ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতীক। মা দুর্গার দশটি হাত ও দশটি প্রহরণ অপরিমেয় বলবীর্যের। সিংহ বশংবদ ভক্তের ও অসুর অশুভ দুর্গতির প্রতীক। দেব সেনাপতি কার্তিক তারকাসুরকে বধ করে স্বর্গভ্রষ্ট দেবতাদের পুনরায় স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।


হিন্দু পুরাণে আছে, ভগবান ব্রহ্মা মহিষাসুর দৈত্যের কিছু ভালো কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চেয়েছিলেন, মহিষাসুর ‘অমর’ বর প্রার্থনা করেছিল, ব্রহ্মা সরাসরি অমরত্ব বর না দিয়ে বর দিলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না। ভগবান ব্রহ্মা, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, তার কাছ থেকে এমন বর পেয়ে মহিষাসুর ধরাকে সরাজ্ঞান করতে আরম্ভ করে। সে ধরেই নিয়েছিল যেহেতু নারীরা শারীরিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল এবং কোনো পুরুষের হাতে তার মৃত্যু নেই, তাই সে হবে অপরাজেয়, অমর।


তার খুব ইচ্ছা হলো স্বর্গ-মর্ত্য জয় করার, দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিল, তার অত্যাচারে স্বর্গের দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে মহিষাসুরের অত্যাচার দেবতাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। এভাবেই মহিষাসুর অপরাজেয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, এরপর সে স্বর্গের দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়ন করতে শুরু করে।


অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, তারা ব্রহ্মার দেওয়া কঠিন বরের ভেতরেই আলো দেখতে পান। ব্রহ্মা বর দেওয়ার সময় বলেছিলেন, কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না, এখানে নারীর কথা উহ্য রাখা হয়েছে। তার মানে নারীর হাতে মহিষাসুরের পরাস্ত হওয়ায় কোনো বাধা নেই। তখন ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব’র আহ্বানে দশভুজা যে নারী মূর্তির আবির্ভাব হলো, তিনিই দেবী দুর্গা। যেহেতু মহাপরাক্রমশালী মহিষাসুরের সঙ্গে লড়তে হবে, দুই হাতে লড়াই করা সম্ভব নয় বলেই দেবী দুর্গাকে দশ ভুজারূপে কল্পনা করা হয়েছে। দুর্গা আবির্ভূত হওয়ার পর দুর্গার দশ হাত মারণাস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করে দেওয়া হলো। শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, ইন্দ্র দিলেন তীর ধনুক, তরবারি, ঢাল, বিষধর সর্প, তীক্ষ্ন কাঁটাওয়ালা শঙ্খ, বিদ্যুৎবাহী বজ্র শক্তি এবং একটি পদ্মফুল।


দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের মধ্যে দশ দিনব্যাপী মহাযুদ্ধ হয়েছিল, মহিষাসুরকে পরাস্ত করা রীতিমতো অসাধ্য হয়ে উঠেছিল, কারণ সে মায়ার খেলা জানত, দুর্গাকে বিভ্রান্ত করতে সে একেকবার একেক জন্তু-জানোয়ারের রূপ ধারণ করছিল, দেবী দুর্গার জন্য যুদ্ধ ভীষণ কঠিন হয়ে উঠে যখন অসুরের ক্ষতস্থান থেকে রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়া মাত্র সেখান থেকে একই চেহারার আরেকটি অসুর জন্ম নিচ্ছিল।


এভাবে দুর্গার তরবারির কোপে রক্তাক্ত অসুরের প্রতি রক্তবিন্দু থেকে শত সহস্র অসুরের জন্ম হলো এবং দুর্গার দিকে ধেয়ে এলো। তখনই দেবী দুর্গা অন্য মূর্তি ধারণ করলেন, সে মূর্তির রূপ হলো আরও ভয়ঙ্কর, লম্বা জিভ, চার হস্ত কালী মূর্তি, যার প্রধান কাজই ছিল অসুরের রক্তবীজ মাটি স্পর্শ করার আগেই লম্বা জিভ বের করে চেটে খেয়ে ফেলা।


এভাবেই রক্তবীজ থেকে অসুরের উৎপত্তি বন্ধ হয়ে গেল এবং যুদ্ধের দশম দিনে অসুর মহিষের রূপ নিয়েছিল, উপায়ান্তর না দেখে মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে এলো বিশালদেহী মানুষের রূপে, তখনই দেবী দুর্গার হাতের ত্রিশূল মহিষাসুরের বক্ষ্যভেদ করল। মহিষাসুরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে শান্তি ফিরে এলো। স্বর্গের দেবতারা দেবী দুর্গার নামে জয়ধ্বনি করিলেন।


আমরা দেবী দুর্গার পূজা করি৷ দেবী দুর্গাকে নির্দিষ্ট প্রণাম মন্ত্রতে প্রণাম করা হয়৷
প্রণাম মন্ত্র—
ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে
শরণ্যে ত্র্যম্বক গৌরি নারায়ণি নমোহস্ত তে
বাংলা অর্থ–হে দেবী সর্বমঙ্গলা শিবি সর্বার্থসাধিকা শরণযোগ্যা গৌরি ত্রিনয়না নারায়ণি তোমাকে নমষ্কার৷
প্রনাম মন্ত্রের শিক্ষা–
দেবী দুর্গা বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়ে থাকেন এবং আমাদের মঙ্গল নিশ্চিত করেন ৷তাই তিনি সর্ব মঙ্গলা তিনি শিবা ৷অর্থাৎ মঙ্গলময় শিবের শক্তি বলে তিনি শিবা ৷তিনি সকল প্রার্থনা পূরণ করেন ৷তার অসাধ্য কিছুই নেই ৷তিনি শরন্য তিনি গৌরী তার কাছে শক্তি প্রার্থনা করে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো এবং নিজের ও সমাজের জন্য মঙ্গল জনক কাজ করব ৷দূর্গা পূজার প্রণাম মন্ত্র আমাদের এই শিক্ষা দেয়।


শ্রী শ্রী মহা অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র।।


* অষ্টমী :- (1) নমঃ মহিষগ্নি মহামায়ে চামুন্ডে মুন্ডমালিনি।আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবী নমোস্তুতে ||


(2) নমঃ সৃষ্টিস্তিতিবিনাশানাং শক্তির্ভূতে সনাতনি।গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোস্তু তে ||


(3) নমঃ শরণাগতদীর্নাত পরিত্রাণপরায়ণে।সর্বস্যাতিহরে দেবী নারায়ণি নমোস্তু তে ||


এষ সচন্দন-পুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলিঃ নমঃ দক্ষযঞ্জ বিনাশিন্যে মহাঘোরায়ৈ যোগিনী কোটিপরিবৃতায়ৈ ভদ্রকাল্যৈ ভগবত্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ ||


* প্রণাম মন্ত্র :- জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোস্তু তে ||  


শ্রী শ্রী দুর্গোত্সব-১৪২৬ শারদীয়া পূজা-সংকলন
মহা অষ্টমী কাব‍্য- দুর্গাপূজার কবিতা- ৪
কবি- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


মহা অষ্টমীর পূজা বিদিত ভুবনে,
বিধিমতে সন্ধিপূজা পূণ‍্য সন্ধিক্ষণে।
হোমযজ্ঞ চণ্ডীপাঠ অঞ্জলি প্রদান,
সন্ধিক্ষণে বলিদান শাস্ত্রের বিধান।


শোভিছে মঙ্গলঘট তাহে আম্রশাখা,
ফুলমালা চতুর্দিকে আলপনা আকা।
জ্বলে দীপ পুড়ে ধূপ বাজে জয়ঢাক,
পুজারীর ঘণ্টা বাজে বেজে উঠে শাখ।


গব‍্য ঘৃত মধু আর সুগন্ধি চন্দন,
ধান‍্য দূর্বা গঙ্গাজলে দেবীর পূজন।
অষ্টোত্তর শত নীল কমল সহিতে,
মহা অষ্টমীর পূজা হয় বিধিমতে।


পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শেষে প্রসাদ বণ্টন,
অষ্টমীর কাব্য লিখে শ্রীমান লক্ষ্মণ।