যা দেবী সর্বভূতেষু… মহিষাসুরমর্দিনী
শ্রী
শ্রী চণ্ডীস্তোত্রম্ – একাদশ পর্ব।  শ্রী শ্রী বিজয়া দশমী
সংগ্রহ, সম্পাদনা ও স্তোত্রপাঠ- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।


দুর্গাষষ্ঠী বোধন থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত নানা আচার-উপাচার ও ভক্তিশ্রদ্ধায় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দশমীতে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শারদীয়া দুর্গোৎসব। সনাতন হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী বিজয়া দশমীর দিনে মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে ফিরে যাবেন মা দুর্গা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে। দেবী দুর্গাকে বেদনাবিধূর বিদায়লগ্নে তেল, সিঁদুর ও পান দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয়। এরপর শোভাযাত্রা। সর্বশেষ প্রতিমা বিসর্জন।


দুর্গাপুজোর ইতি ঘটে এই দশমীতে৷ মহাভারতে কথিত আছে পাণ্ডবদের ১২ বছরের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়েছিল আশ্বিনের শুল্কা দশমীতে৷ ওইদিন তারা শমীবৃক্ষে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র বের করে আনেন এবং তাঁরা তাদের ছদ্মবেশ ছেড়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করে৷ এটাও বিজয়া দশমী হওয়ার অন্যতম ত্যৎপর্য বলে উল্লেখ করা হয়৷


আধুনিক যুগেও বিজয়া দশমী নিয়ে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের এক ব্যাখ্যা৷ এই বিসর্জন ঘিরে একটি কাহিনী প্রচলিত৷ রাণী রাসমণির জামাতা মথুরবাবু একবার আবেগের বসে দশমীতে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দেবেন না বলে ঠিক করেন৷ তাঁর যুক্তি ছিল- বাড়ির মা দুর্গাকে কী ভাবে জলে ভাসাব৷ তখন রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বোঝান,- বিজয়ার অর্থ মা দুর্গা এবং তাঁর সন্তানদের সঙ্গে বিচ্ছেদ নয়৷ শ্রীরামকৃষ্ণ ব্যাখ্যা হল,-এই কয়েকদিন বাড়ির পুজোর দালানে বসে মা পুজো নিয়েছেন, এবার থেকে মা হৃদয় মন্দিরে বসে পুজো নেবেন৷ শাস্ত্রমতে যিনি সাকার তিনিই আবার নিরাকার৷ দেবী সাকার রূপে মর্তে পুজো নিয়ে নিরাকার রূপে কৈলাসে গমন করেছেন৷ এর অর্থ সন্তানের সঙ্গে কোনও রকম বিচ্ছেদ নয়৷ এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হলেন মথুরবাবু এবং জেদাজেদি ছেড়ে ভাসানের অুমতি দিলেন৷


দুর্গাপুজোর ক’টা দিন আনন্দে মেতে ওঠে আপামর বাঙালী৷ মাতবেই না কেন? বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব যে৷ এখন তো খুঁটি পুজো থেকে শুরু হয় পুজো প্রস্তুতি৷ এরপর মহালয়া থেকে শুরু হয়ে যায় উৎসবের পালা৷ চলে বিসর্জনের দিন পর্যন্ত৷ দশমীর দিন ঘরে ফিরে যায় উমা৷ উমার ঘরে ফেরার বিশাদে বিষন্নতা কাটাতে আনন্দে মেতে ওঠে বাঙালী৷ মাকে বরণ করে সিঁদুর খেলে হাসি মুখে বিদায় জানায় ঘরের মেয়েকে৷ কিন্তু জানেন কি কেন বিদায়ের আগে মায়ের সঙ্গে সিঁদুর খেলা হয়?


পুরাণ মতে, মহালয়া থেকে শুরু দেবীপক্ষ৷ বছরে একবার মাত্র দশ দিনের জন্য মা দুর্গা তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাপেরবাড়ি আসে৷ এক বছর পর ঘরে ফিরে আসে উমা৷ মেয়ের ঘরে ফেরার আনন্দে জোরকদমে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি৷ সেজে ওঠে উমার ঘর৷ মেয়েকে তার পচ্ছন্দের খাবার রেঁধে খাওয়ানো হয়৷


দশমী আসতেই উমাকে তার শ্বশুড়বাড়ি পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়৷ রীতি নীতি মেনে মেয়েকে শ্বশুড়বাড়ি পাঠানো হয়৷ সিঁদুর খেলা হল অন্যতম রীতি৷ বিদায়ের আগে সিঁদুর খেলা হয় কারণ, মা দুর্গাকে বাঙালীরা বিবাহিতা নারী হিসাবে মনে করে৷ হিন্দু রীতি অনুযায়ী সিঁথির সিঁদুর আসলে বিবাহিতা নারীর চিহ্ন৷ অনেকের বিশ্বাস, যথাযথ রীতি মনে সিঁদুর খেলা হলে অকালে কোন মহিলা বিধবা হবেন না৷


বিজয়া দশমীর দিন আগে মাকে বরণ করা হয়৷ পান পাতা, সন্দেশ ও সিঁদুর দিয়ে উমাকে বরণ করা হয়৷ মুখে পান পাতা ছুঁইয়ে, সন্দেশ খাইয়ে এবং সিঁদুর পড়িয়ে করা হয় বরণ৷ একপরই বিবাহিতা বাঙালী মহিলারা মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়৷ আগে শুধু বিবাহিতা মহিলাদেরই সিঁদুর খেলতে দেখা যেত৷ এখন অবশ্য অবিবাহিতারাও মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়৷


পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এই দিনেই পিতৃ-আবাস ছেড়ে দেবী পাড়ি দেন স্বামীগৃহ কৈলাসের দিকে। এই দিনেই তাই দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। রাজধানী শহর দিল্লিতে যমুনা নদীতে, কোলকাতায় গঙ্গানদী অভিমুখে অসংখ্য প্রতিমা সারি সারি নিয়ে শোভাযাত্রা চলে সারাদিন ধরে।


পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনিতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূতা হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর-বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে।


তবে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই দিনে যে দশেরা উদযাপিত হয়, তার তাৎপর্য অন্য। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘দশহর’ থেকে, যা দশানন রাবণের মৃত্যুকে সূচিত করে। বাল্মীকি রামায়ণে কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই রাবণ-বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ, তুলসীদাসের রামচরিতমানস, কিংবা কেশবদাসের রামচন্দ্রিকা-য় এই সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ-বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ।


রাবণ-বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষেই যথাক্রমে দশহরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। আবার মহাভারতে কথিত হয়েছে, দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শু‌ক্লা দশমীতেই পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ-মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এই উল্লেখও বিজয়া দশমীর তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।


বিদায়ের অশ্রুজলে সব আনন্দের হয় বিসর্জন দেবী বিসর্জনের সাথে সাথে। আবার একটি বছর ধরে চলতে থাকে প্রতীক্ষা। দুর্গাপূজা প্রবাসী বাঙালিদের সার্বজনীন। কোলকাতা সহ ভারতে বিভিন্ন রাজ্যেও এই উত্সব অতি ধূমধামের সাথে পালন করা হয়। ভারতবর্ষ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের এই পূজার প্রচলন আছে।


বাংলা কবিতা আসরের সাথে সংযুক্ত সকল শ্রদ্ধেয় কবি ও সহৃদয় পাঠকবৃন্দকে জানাই শুভ বিজয়া দশমীর আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনীর শুভ আশীর্বাদ বর্ষিত হোক সবার মস্তকে। সবার জীবন সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক। মাতৃবন্দনায় জেগে উঠুক সারা বিশ্ববাসী।


দেবী দুর্গা হলেন শক্তির প্রতীক। দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন অথবা জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলে তাকে বলা হয় দুর্গা।


তিনি হিংসা, নাশকতা ও সকল অন্যায়-অপকর্মের প্রতীক সেই অসুরের নিধন সাধন করে মানব সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্বস্তি আনয়ন করেন। মানুষকে দীক্ষিত করেন অভয়মন্ত্রে। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজপুঞ্জ হইতে তাঁর জন্ম। তাই তিনি এতটা শক্তিময়ী। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী মা দুর্গা দেবাদিদেব মহাদেবের পত্নী। তাদের দুই কন্যা ও দুই পুত্র। লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক। এই চার সন্তানের সঙ্গে দুর্গার মহাশক্তির চারবর্গ তথা ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ সংশ্লিষ্ট।


মহাদেবের বাসগৃহ কৈলাস পর্বত হতে মা দুর্গা প্রতি বছর সন্তানদের সাথে লয়ে পিত্রালয় মর্ত্যে বেড়াতে আসেন। আসেন প্রতি বছর আশ্বিন মাসের পঞ্চম তিথিতে। মহাধুমধাম ও আনন্দোত্সবের মধ্যে পাঁচ দিন পার হয়ে যায়। এ বছরও দেশব্যাপী শান্তি ও সৌহার্দমূলক পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই পবিত্র ধর্মীয় উত্সব। বিজয়া দশমীর পূণ্য দিবসে সকলকে জানাই শুভ বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু


শ্রী শ্রী দুর্গাত্সব-১৪২৬ শারদীয়া পূজা-সংকলন
শ্রী শ্রী মহা দশমী – দুর্গাপূজার কবিতা- ৬
কবি- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


বিজয়া দশমী আজি পূণ্য শুভক্ষণ,
দশমীতে বিধিমতে পূজা আয়োজন।
সুগন্ধি চন্দন মধু গঙ্গাজল আর,
শঙ্খ ঘণ্টা ধূপ দীপ পূজা উপাচার।


পূজা অন্তে দশমীতে দেবী বিসর্জন,
সুমিষ্টান্ন গুঁয়াপানে দেবীর বরণ।
ঢাক বাজে কাঁসি বাজে হয় শঙ্খধ্বনি,
সিঁদুর খেলায় মাতে যতেক রমণী।


বিজয়া দশমী আজি বিজয় কারণ,
হর্ষ ভরে দেখে সবে জ্বলিছে রাবণ।
বিসর্জনের বাজনা বাজে চারিধার,
একটি বছর তরে প্রতীক্ষা আবার।


বিজয়া দশমীর কাব্য রচিল লক্ষ্মণ,
পাঠ করে সুধীজন পাঠে ভরে মন।