বিখ্যাত ইংরেজ কবি কোলরিজ গদ্য আর পদ্যের কার্যকর একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর বিবেচনায় গদ্য বা Prose হচ্ছে ‘Words in the best order’ অর্থাৎ শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই গদ্য। আর কবিতা বা Poetry হচ্ছে ‘Best words in the best order’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই কবিতা। এর মাধ্যমে কবিতা বা গদ্য কি তা বোঝা কঠিন। কিন্তু গদ্য বা কবিতা কিভাবে লিখতে হবে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।


কবিতার ক্লাসের আগের আলোচনাগুলোতে বাংলা কবিতার তিন ছন্দ নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দিতে চেষ্টা করেছি।আজকে আলোচনা করব কিভাবে ছন্দের নিয়ম মেনে কবিতা লেখা যায়।


যারা মনে করেন ছন্দ বস্তাপচা পুরানো জিনিস, আধুনিক কবিতায় ছন্দের কোনও স্থান নেই এবং তারা ইচ্ছে করলেই নতুন ছন্দ আবিষ্কার করতে পারেন, তারা অবশ্যই দূরে থাকুন।এই আলোচনা সেই কবিদের জন্য, যারা চাইছেন ছন্দ শিখতে, ছন্দ মেনে লিখতে, কিন্তু পারছেন না বা পারলেও কনফিউজড হয়ে যাচ্ছেন।


ফুলের সংগে ফুল গেঁথে যেমন মালা তৈরি হয়, ঠিক তেমন ভাবে শব্দে শব্দ গেঁথে কবিতা লেখা হয়।ভাল মালা গাঁথতে গেলে কোন ফুলটা কোন ফুলের পাশে ভাল মানাবে সেটার ধারণা থাকা দরকার। যে কোনও ফুল ইচ্ছেমত গাঁথলেই তা সুন্দর মালা হবে না কখনও।কবিতার ক্ষেত্রেও এটাই সত্য।শব্দ চিনতে হবে।শব্দের ওজন বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার করে নিতে হবে কবিতা লেখার আগেই।একই শব্দ বিভিন্ন ভাবে সাজালে তার ওজনের বিভিন্নতা দেখা দেয়।
ছন্দ শাস্ত্রে এই ব্যাপারটা মাত্রা দিয়ে মাপা হয়।


আগেই বলেছি স্বরবৃত্ত ছন্দে যত দল ( সিলেবেল) তত মাত্রা।কোনটা রুদ্ধ দল আর কোনটা মুক্তদল এসব কিচ্ছু দেখার দরকার নেই স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখার সময়ে।
তাই যেকোনো শব্দে যতগুলো দল, ঠিক তত মাত্রা হবে এই ছন্দে।উদাহরণ হিসাবে বলা যায়,  "কোন দেশেতে / তরুলতা " এই বাক্যে  কোন+ দে+শে+তে/ ত+রু+ল+তা,৪+৪ মোট আটটি দল বা সিলেবল আছে।তাই এটা আট মাত্রিক একটা বাকাংশ।


সব ছন্দেই মুক্তদল একমাত্রা।রুদ্ধদল স্বরবৃত্তে এক মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে দুই মাত্রা আর অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এক বা দুই মাত্রা পায়।
রুদ্ধদল একা থাকলে বা শব্দের শেষে থাকলে দুই মাত্রা পায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।শব্দের শুরুতে বা মাঝে রুদ্ধদল এক মাত্রা পায় অক্ষরবৃত্তে।


যেমন, "অক্ষর " শব্দটাতে অক+খর মোট দুটি দল আছে।প্রথম  রুদ্ধদলটি যেহেতু শব্দের প্রথমে আছে, তাই এক মাত্রাই পাবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।আর শেষেরটি দুই মাত্রা পাবে। তাই শব্দটা তিন (১+২)মাত্রা পাবে এই ছন্দে।
কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এটা চারমাত্রা পাবে।কারণ, দুটি রুদ্ধদল প্রত্যেকেই দুই মাত্রা পাবে মাত্রাবৃত্তে।


এবারে একটা মজা দেখা যাক।আসলে আমরা কবি হতে চাই।ছান্দসিক নই।তাই শুধুমাত্র চোখে দেখেই সহজে এই মাত্রা নির্ণয় করতে পারলে খুব ভাল হয় আমাদের জন্য।
এই জন্য নিয়ম হল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যত অক্ষর তত মাত্রা।আর মাত্রাবৃত্ত ছন্দে যুক্তাক্ষর দুই মাত্রা। তাহলে শুধু চোখে দেখেই এবারে আসুন মাত্রা গুনে নিই।
'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল' এর মাত্রা নির্ণয় করব আমরা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ৩+৪+৩+২ =১২মাত্রা পাবে লাইনটি।কারণ, ফাল্গুনে তিন অক্ষর, বিকশিত ৪ অক্ষর, কাঞ্চন তিন অক্ষর, আর ফুল দুই অক্ষরের শব্দ।
কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে যেহেতু যুক্তাক্ষর দুই মাত্রা পাবে তাই ফাল্গুনে হবে চার মাত্রার।কাঞ্চন ও চার মাত্রা পাবে এখানে।লাইনটি ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে।
দল হিসাবে পরিমাপ করেও একই রেজাল্ট পাওয়া যাবে।সুতরাং কবিতা লেখার সময়ে শুধুমাত্র শব্দটার দিকে একবার তাকালেই আমরা তার মাত্রা বের করে নিতে পারব এই ভাবে।রুদ্ধদল মুক্তদলের ঝামেলাতে না গিয়েও খুব সহজেই।


এবারে কবিতা লেখার পালা।তবে কবিতা লেখার আগে আমি অনুরোধ করব কবিতা পড়ে, কোন কবিতা কোন ছন্দে সেটা খুঁজে বের করার খেলাটা খেলতে।যতদিন না এটা করতে পারা যাচ্ছে ততদিন কবিতা লেখা সম্ভব নয় ছন্দ মেনে।


এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে বুঝব কোন কবিতা কোন ছন্দে লেখা?


এটা খুবই সহজ কাজ।যেকোনও কবিতার প্রথম দুই লাইন পড়লেই এটা ধরতে পারা উচিত। লয় টা কেমন? দ্রুত, না ধীর? ধীর হলে অক্ষরবৃত্ত হবে।আর দ্রুত হলে স্বরবৃত্ত। মাত্রাবৃত্ত মাঝারি লয়ের।
কয়েকটি কবিতার লাইন মনে রাখুন শুধু।
১ .  আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়।
বা,
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা
...- অক্ষরবৃত্ত।  


২.ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল
বা,  শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভূঁই, আর সবই গেছে ঋণে।.... মাত্রাবৃত্ত।


৩. বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই.....স্বরবৃত্ত ছন্দ।


এবারে  তুলনা করুন যে কবিতার ছন্দ ধরতে চাইছেন তার সংগে। যেটার সংগে মিলবে সেই ছন্দ হবে।


এর সংগে জেনে নিতে হবে কিছু কায়দা।যেমন বিজোড়ে বিজোড়, জোড়ে জোড় শব্দ দেখলে বুঝতে হবে অক্ষরবৃত্ত। যদি দেখা যায় দুটি তিন অক্ষরের শব্দ পাশাপাশি বসেছে একটিতে যুক্তাক্ষর আছে আর একটিতে নেই তাহলে বুঝতে হবে কনফার্ম অক্ষরবৃত্ত। কারণ মাত্রাবৃত্ত হলে যুক্তাক্ষর যুক্ত শব্দটি চার মাত্রার হয়ে যেত।একই ভাবে দুটি দু অক্ষরের শব্দ পাশাপাশি বসলেও একটিতে যুক্তাক্ষর থাকলে অক্ষরবৃত্ত হবে।  যুক্তাক্ষরটিই আপনাকে বলে দেবে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত না অক্ষরবৃত্ত। যুক্তাক্ষর দু মাত্রা পেলেই মাত্রাবৃত্ত।নইলে অক্ষরবৃত্ত।  
যেমন উপরের উদাহরণে ' অদ্ভুত আঁধার এক'  শুধু এই বাকাংশটুকুই ছন্দ নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট। 'অদ্ভুত' শব্দটিতে যেহেতু যুক্তাক্ষর আছে, আর 'আঁধার' শব্দে নেই তাই এটা মাত্রাবৃত্ত হতে পারে না।অক্ষরবৃত্তের কবিতার পর্ব বিজোড় হয় না কখনো। ওদিকে মাত্রাবৃত্ত পাঁচ মাত্রায় সবচেয়ে ভাল চলে।
চার মাত্রা চারমাত্রার তাড়াতাড়ি চাল মানেই স্বরবৃত্ত।উচ্চারণের প্রথমেই শ্বাসাঘাত আসলে বুঝতে হবে স্বরবৃত্ত। যেমন 'বাঁশ বাগানে'  বলতে গেলেই 'বাঁ' এর উপরে জোর পড়ছে। স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতি চারমাত্রার প্রথম মাত্রার উপর জোর পড়ে।
এভাবে কিছুদিন অভ্যাস করলেই ধরা যাবে কবিতার ছন্দ।যেটা কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকা একটা রহস্য।কবিতা আসলে নারীর মত,রহস্যময়ী।কিংবা পরোটার মত।পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে কত্ত কিছু --প্রতীক, চিহ্ন, উপমা,কল্পনা, ছন্দ....।