লোকে আমায় শিল্পী বলে।
আমার শিল্পের কদর তোমার দৌলতে ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে গ্রামে।
সামান্য মাটির দলাকে নিজের কল্পনা মিশিয়ে সাজিয়ে তোলাই আমার নেশা, পেশাও বটে।
হ্যাঁ, আমি কুমোর।
প্রতিবছর দূর দূর থেকে লোকে আসে আমাকে বায়না দিতে,
তোমাকে নির্মাণ করার বায়না।
চলে খানিকটা দর কষাকষি।
তারপর মনের মতো দাম পেলেই কাঠামোর উপর বিচুলি বাঁধা শুরু।


মাটির প্রলেপ দিতে দিতে, তোমার শরীর গড়তে গড়তে আমি খুঁজে পাই নিজের সন্তানকে লালন করার আনন্দ।
এক বাবা নিজের মেয়েটাকে ঠিক যতটা যত্নে বড়ো করে,
ঠিক ততটা যত্নেই আমিও নির্মাণ করতে থাকি তোমায়।


তারপর একদিন খুব ভোরে শরতের আকাশের মেঘে, কাশফুলের দোলায়,
শিশিরস্নাত শিউলির গন্ধে বেজে ওঠে আলোর বেণু।
চক্ষু দানের মাধ্যমে তোমার নির্মাণ পূর্ণতার ছোঁয়া পায়।


এবার তোমাকে সাজিয়ে তোলার পালা।
তোমাকে সাজাতে থাকি মনের রঙে।
ঠিক যেমন এক প্রেমিককের চোখে সবচেয়ে সুন্দরী হয় তার প্রেমিকা,
তার সমস্ত সময়, সমস্ত ধ্যান উজাড় করে দেয় তার মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য,
ঠিক তেমনই আমিও তোমাকে সাজিয়ে তুলি পরমা সুন্দরী রূপে।
বারবার দেখতে থাকি তোমার রূপ।
আমি যে তখন তোমার প্রেমিক।


হঠাৎ কতগুলো পদধ্বনি, বুঝতে পারি ওরা আসছে, তোমাকে নিয়ে যেতে।আমার থেকে দূরে।শুরুতে যে দামটা নির্ধারণ করে খুব খুশি হয়েছিলাম, এখন ওই সামান্য অর্থের বিনিময়ে তোমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে মন চায় না। মন চায়না তোমাকে চোখের আড়াল করতে।
কন্যাদানের সময় বাবার মন যেমন হাহাকার করে,
বুকের বাম পাশটা যেমন খালি খালি লাগে, ঠিক তেমনই হয় আমার অবস্থা।


কিন্তু কি করবো... আমি যে নিরুপায়।
আমার ঘরেও তোমার মত এক মেয়ে রয়েছে,
এক প্রেমিকা রয়েছে স্ত্রী রূপে।
ওই টাকাটুকু দিয়েই তো তাদের মুখের হাসি ফোটাতে পারি।
পুজোর সময় মেয়ের দুটো ফ্রক, বউকে দুটো সুন্দর শাড়ি,নিজের জন্য একটা সস্তার জামা প্যান্ট কিনতে যে ওই টাকাগুলোর খুব দরকার।
তাই তোমাকে মন না চাইলেও বাধ্য হয়েই তুলে দিতে হয়।
সকলের আড়ালে গিয়ে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে কেবল প্রার্থনা করি...যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।


সপ্তমীর সকালে দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের কাঠিতে ঢ্যাং  কুরাকুর শব্দ,
তোমাকে দেখার ইচ্ছা মনকে অস্থির করে তোলে।
মেয়ে, বউয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ি তোমায় দেখবো বলে।


মণ্ডপের সামনে গিয়ে দেখি তোমাকে ওরা কি বিশাল ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলেছে। কি সুন্দর লাগছে তোমায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে।
ঠিক যেন আমার মায়ের মতো দশ হাতে সংসার সামলাচ্ছ।সন্তানকে আশীর্বাদ করছো সেই দশ হাতেই।
অষ্টমীর সকালে তোমার পদতলে পুষ্পাঞ্জলী দেওয়ার সময় তাই তোমাকে হঠাৎ চিৎকার করে মা বলে ডেকে উঠি।
  নবমী পার করে দশমী উপস্থিত হয়। তোমাকে সিঁদুর রঙে রাঙিয়ে ওরা বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নেয়। মনে বেজে ওঠে বিষাদের সুর।


ধুমধাম শোভাযাত্রায় ওরা যখন তোমাকে বিসর্জন করে, ওদের যখন তোমার প্রয়োজন ফুরায়,তখন আমার চোখে জল।ওরা ভুলে গেলেও আমি তোমাকে কখনো ভুলতে পারি না। পারবো না।


মায়ের প্রয়োজন ছেলের কাছে কতটা ওরা না বুঝলেও আমি বুঝি।
শিক্ষিত ছেলেটার কাছে মায়ের প্রয়োজন ফুরালেও, নিজের সুখ আহ্লাদের জন্যে মায়ের বিসর্জন দিলেও,
আমি যে মায়ের বিসর্জন কোনদিনও চাই না।
তাই বিসর্জনের শেষে অপেক্ষায় থাকি, ঘাট শূন্য হলে কাঠামোটাকে আবার তুলে আনবো বলে। সামনের বছর আবার নতুন রূপে তোমায় সাজিয়ে তুলবো বলে।
আবার নতুন করে তোমার অন্তরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবো বলে।