শতাধিক বছর পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের এক সত্য কাহিনী অবলম্বনে


প্রিয়তমেষু,
আজ প্রভাতে তোমাকে এই পত্র লিখে উড়িয়ে দিলাম মেঘ বলাকায়।আমার বিশ্বাস,সেটি হাতে পেলে পত্রপাঠ চলে আসবে নির্দ্বিধায়।
অনেক কথাই বলার ছিল।শুধু বলি,বারো বছর তোমার নিরুদ্দেশের সংবাদে আমার পিতৃ গৃহে ও পাড়াপড়শিদের মধ্যে শুরু হয়েছিল গুঞ্জন।প্রচলিত রীতিনীতি নিয়ে কথোপকথন।আমার পৈত্রিক স্বনামধন্য গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে আমার বৈধব্য দশা অবলম্বনের আয়োজন।
নৌকাযোগে গঙ্গাসাগর যাওয়ার পথে গঙ্গাপ্রাপ্তিকে শ্রেয় মনে করে ঝাঁপ দিয়েছিলাম জলে।সেদিন আমার বন্ধন মুক্তি ঘটেনি নৌকাযাত্রী দের অতিশয় তৎপরতায়।আবারও ফিরতে হলো গৃহে।বৈধব্য দশা অবলম্বন করে আমার কাটলো ষাট বছর।
সবসময় মনে হয়েছে তুমি বেঁচে আছ।আমার কথা ভেবে নিশ্চিত ফিরবে ঘরে।আমি আজও আছি সেদিনের অপেক্ষায়।
প্র্রিয়তম!তোমার কি মনে পড়ে,সে’দিনের কথা?যেদিন তোমার নব্য বিবাহিতা কিশোরী পত্নীকে তুমি দ্বিরাগমনের উদ্দেশ্যে পালকিতে তুলে দিয়ে বললে-“এগিয়ে চলো,আমি যাচ্ছি পালকির সাথে”।
স্বীয় পত্নীর মর্যাদা রক্ষার্থে পালকির দরজার পর্দাও দিয়েছিলে টেনে।আনন্দের স্র্রোতে বলাকার মতো ভেসে পৌঁছেছিলাম পিতৃ গৃহে।কিন্তু তুমি আসোনি সেদিন।তোমাকে না দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক।শূন্যতা অনুভব করেছিলাম মনে।তখনও বুঝিনি,আমাকে সাঁতার কাটতে হবে কালা পানিতে।
তুমি আশ্বাসবাণী শুনিয়ে নিজের কিশোরী পত্নীর বিশ্বাসের দুয়ারে উপর্যুপরি আঘাত করে তাকে পালকিকে পাঠিয়ে দিলে।সেদিন বুঝিনি,“তুমি ছিলে মিথ্যাচারে ভর করে”।
দ্বিরাগমনে একাকী ফিরে আসায়,ঘরে-বাইরে শুরু হলো নানান গুঞ্জন।আমি বিচারালয়ের কাঠগড়ায়।বিচারে সর্ব ক্ষেত্রে অপরাধী আমি,সেদিনের কিশোরী।
তারপরও কখন আসো নি আমাকে ফিরিয়ে নিতে।স্বজন মারফৎ খোঁজ নিয়ে জেনেছি তুমি সন্ন্যাস ব্রত নিয়ে চলে গেছ নিরুদ্দেশে।  
তখনি অগস্ত্য যাত্রার অনুভূতি জাগলো মনে।তবুও তীর্থের কাকের মতো কাটালাম সুদীর্ঘ কাল,তোমার অপেক্ষায়।
প্রিয়তম!সন্ন্যাসী বেশে হলেও একটি বার তোমাকে দেখার প্রত্যাশায় প্রতি বছর নিয়ম করে গেছি গঙ্গাসাগর মেলায়।তোমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি সেথায়।নিরাশ হয়ে ফিরেছি বারবার।
তোমার সাক্ষাৎ না-পেয়ে কালের প্রতিকূল স্রোতে নিয়ত হাবুডুবু খেয়ে পৌঁছেছি গোধূলি বেলায়।
আজ অন্তিম শয্যায় শুয়ে তোমাকে লিখেছি এই পত্র।জানিনা,আমার পত্র খানা তোমার হাতে পৌঁছবে কিনা!সেটা হাতে পৌঁছলে পত্রপাঠ কি করবে,সেও জানিনা।
শুধু ভাবি,তুমি কি হাজির থাকবে আমার অন্তিম যাত্রায়!
                                     ইতি
                               অভাগিনী মৃণালিনী দেবী।