রমেন আচার্যর নিজের কথা, কবিতার কথা


আত্মজৈবনিক গদ্য লেখার অনুরোধ, কিন্তু ভাবতে হচ্ছে – ভাল-মন্দ মেশানো দীর্ঘ জীবনপ্রবাহ থেকে প্রকাশ্য আলোয় মেলে ধরার মতো আমার এমন কী আছে, যা পাঠকমনে বিরক্তি আনবে না! এরকম রচনায় ‘আমি’ আসবে বার বার, সতর্ক থেকেও তা এড়ানো কঠিন, তবু লিখতে হবে। হতে পারে লেখাটি পাঠকের  কাছে উপেক্ষিত এক কবির বিনম্র নিবেদন, কিন্তু তাতেও তো মিশে থাকে কবির সামান্য অহঙ্কার, যাকে লাঠির মতো ব্যবহার করেই কবি আজও দাঁড়িয়ে আছেন, তাই পাঠকের মার্জনা প্রার্থনা করেই লেখা শুরু করতে চাই।
উদ্বাস্তু জীবনে খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য সংগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত ও ঘর্মাক্ত যে পরিবার, সেখানেও আমাকে কিছুটা স্বস্তি ও শান্তি দিয়েছিল যে শিল্প-সাহিত্যের নান্দনিক পরিমন্ডল, তা আঁকড়ে থেকেই আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকা। এখনও নানা দুর্যোগ ও শোকের দিনগুলি ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই আমার ভাবনা আবর্তিত হয়েছে নান্দনিক ওই ভুবনেই। লিখছি না, কিন্তু ভাবছি, কবিতাকে বোঝার চেষ্টা করছি। সে যেন রহস্যময়ী এক প্রেয়সী, যাকে চিনেও মনে হয় ঠিক চিনি না। তাই আমার সমগ্র কবিতা ও সেই সঙ্গে কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধগুলিই আমার আত্মজৈবনিক রচনা বলে মনে করা ভালো। কিন্তু পাঠক সেসব জানবেন কীভাবে? আমি তো আমার ‘কবিতাসংগ্রহ’-র ভূমিকাতেই জানিয়েছি – ‘আমার এমন কোনো আলোকিত জায়গা ছিল না যেখানে পাঠক বইয়ের পাতা উলটে দেখার সুযোগ পাবেন।’ এই দুর্ভাগ্যের জন্যই আমি বহু পাঠকের কাছে যেতে পারিনি। আজ কবিতায় নয়, গদ্যে লিখতে বসেছি, তাই বক্তব্যের সত্যতা বিচারের প্রয়োজনে সাক্ষী হিসেবে হয়তো কবিতার কিছু কিছু পঙ্‌ক্তিকে ডেকে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। কাব্যগ্রন্থ স্পর্শ করে ‘যাহা বলিব, সত্য বলিব’ এরকম শপথবাক্য উচ্চারণ করে সাক্ষ্য দিতে হবে আমার রচিত কবিতাগুলিকেই।
শৈশবে কবিজীবনের কোনো লক্ষণ কি দেখা গেছে কখনো? না, শুধু ছিল একটি স্ফুলিঙ্গের মতো এক কণা অনুভব, যা একসময় নিভে যাওয়ার কথা, অথচ তা ছিল মনের গভীরে কোথাও। আশ্চর্য হয়ে ভাবি, স্কুল জীবনে তো কবিতার প্রতি কোনো আকর্ষণই ছিল না। অথচ কবি ও কবিতার প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম  নিজেরই  অজ্ঞাতে  বীজের শক্ত  খোলসে আবৃত হয়ে ছিল।  হয়তো পেছনে ছিল শৈশবেরই একটি অভিজ্ঞতা। একদিন বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুনছি এক বন্ধুকে ‘প্রশ্ন’ কবিতার প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের অর্থ বুঝিয়ে বলছেন বাবা। ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে’ ...।  গভীর ভাবে বোঝার বয়স নয় তখন, তবু আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি – এক একটা কথার ভিতর লুকিয়ে থাকতে পারে এতো সব না-বলা কথা! তাহলে কবিতা কি একটা জাদুবিদ্যা, আর কবি মস্ত এক জাদুকর? না, এমন গভীরে তলিয়ে ভাবার বয়স নয় তখন, ভাবিওনি এরকম ভাবে, কিন্তু বিস্ময়টা ছিল হুবহু এরকমই। কিন্তু তাতে কী? আমি কি সেদিন থেকে কবিতাকে ভালোবেসে কবিতা পড়তে বা লিখতে শুরু করলাম? না, তেমন হয়নি। দেশত্যাগের সময় কেউ সব প্রিয় জিনিস সঙ্গে আনতে পারে না। তবু বাবার জিনিসপত্রের ভিতরে পেয়েছি ‘গীতালি’-র প্রথম সংস্করণে মোটা লাল  পেন্সিলে চিহ্নিত করা কবিতার এক একটি প্রিয় পঙ্‌ক্তি। তা দেখেই হঠাৎ শৈশবে বাবার মুখে শোনা কবিতার স্মৃতি মনে এসেছিল। হয়তো সেই বিস্ময় ও অনুরাগ সংক্রামিত হয়ে বহু দিন ঘুমিয়েছিল আমার রক্তপ্রবাহে, কিন্তু তা কোনো দিনই বুঝতে পারিনি।
কবিতা নয়, গল্পের প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরী হচ্ছিল ছোট বয়সে। দেশে পাড়ার গ্রন্থাগার বন্ধ থাকায় বইয়ের আলমারিটি ছিল আমাদের বাইরের ঘরে দাদার কাছে। সাহিত্যপাঠের শুরু এভাবেই। ফরিদপুর রেলস্টেশন থেকে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে আমাদের লক্ষ্মীপুরের বাড়ি, আর সেখান থেকে আধ ঘন্টা দূরত্বে যে মামাবাড়ি, সেখান থেকে প্রকাশিত হতো হাতে লেখা পত্রিকা ‘উদয়ের পথে’। শিল্প-সাহিত্যের এই পরিমন্ডলে তখন আমি শুধুই এক দর্শক হয়ে ছিলাম।
কলকাতায় আসার পরে অভাবের সংসারে কীভাবে যে গল্প লেখা শুরু হল, আর তা কোন্‌ সময়ে তা সঠিক ভাবে মনে করতে পারি না। এর পেছনে একই ক্লাসে মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে রচনা লেখায় প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার অলিখিত প্রতিযোগিতার প্রভাব থাকতে পারে। আর একটি কারণ, বয় স্কাউটের ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা লেখার প্রতিযোগিতায় আমার লেখা প্রথম হওয়া ও স্কুলের ম্যাগাজিনে তা মুদ্রিত হওয়ার ঘটনা। আমার জীবনে ওটাই প্রথম মুদ্রিত রচনা।
সে সময়ে কবি ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন দাদার বন্ধু আবুল কাশেম রহিমুদ্দিন। তাঁকে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম – ‘আমি আপনার কবিতা বুঝি না’। প্রায় ধমক দিয়ে উনি বলেছিলেন – ‘রবীন্দ্রনাথকে বোঝো?’ এটা যেন একটা ধাক্কা, মনে হল – সত্যিই তো বুঝি না! তাহলে কি এই না-বোঝাটা আমারই অক্ষমতার জন্য? ঘটনাটি কবিতার প্রতি আমাকে কিছুটা মনোযোগী করলেও, যখন আমার বোন ও তার বন্ধুদের কবিতা নিয়ে মাতামাতি দেখতাম, তখন ভাবতাম – কবিতা-টবিতা  ওসব মেয়েদের প্রিয় হতে পারে, কিন্তু পু্রুষ হিসেবে গল্পই আমার প্রিয় হওয়া উচিত। কবিতা এক লাইনও লিখতাম না, লেখার ইচ্ছেও হয়নি। অথচ বেলেঘাটার সি আই টি বিল্ডিং-এ থাকার সময় আমরা যখন ‘উন্মেষ’ নামে বড় মাপের দেয়াল-পত্রিকা প্রকাশ করতাম, তখন মুদ্রিত ‘উন্মেষ’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত হল। আর আশ্চর্য, যে এক লাইনও কবিতা লেখেনি, সেই আমাকে উপদেষ্টামন্ডলী থেকে নির্দেশ দেওয়া হল কবিতা লিখতে হবে মুদ্রিত রবীন্দ্র সংখ্যার জন্য।
কবিতা কি এমন, যা অন্যের নির্দেশে অনভ্যস্ত হাতেও রচিত হতে পারে! আপত্তি জানিয়েও এই আদেশ বহাল থেকেছে। এরপর শুধু ভাবছি আর ঘামছি। নিজের ভিতরে পড়ে থাকা সেই কবেকার কবিতার প্রতি মুগ্ধতার শক্ত বীজ, যার কথা এতো দিন একবারও মনে হয়নি, সেখানে যেন মৃদু আলোড়ন! বুঝলাম নিজের ভিতরে ‘মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা / লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা’। সেই শক্ত বীজের ভিতর থেকে পাখার ঝাপটানি নিয়ে এলো যে কবিতা, সেই নবজাতক ছিল কেমন? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হল – রবীন্দ্রনাথ যেন সূর্য, আর আমি এক সূর্যমুখী ফুল। এই কবিতাকে তো কোনো কাব্যগ্রন্থেই রাখিনি, তাহলে কেন আজ তার কথা তুলছি? কারণ, আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখছি, সেই পরিত্যক্ত উপেক্ষিত ও বিস্মৃত কবিতার ভিতরে আমার পরিণত মনের কাব্যবোধ ও প্রবণতা কীভাবে কোনো রকম চর্চা ছাড়াই অপটু হাতে যুক্ত হয়েছিল! কেন এই বিস্ময়, তা নিয়ে আলোচনা হলে আমার কবিতার বোধ ও ভাবনাকে চেনা যাবে।


সূর্যমুখী
( রবি কবির উদ্দেশে )


আমি এক সূর্যমুখী, কামনার গতি বুকে নিয়ে
রাত্রির তন্দ্রায় দেখা প্রভাতের খুঁজি স্বপ্নছবি।
অবাধ্য হাওয়ার রাত্রে বারে বারে নিজেকে হারিয়ে
ভুলে গেছি জীবনকে, যে জীবনে সূর্য তুমি কবি।


চিমনির কালো ধোঁয়া পৃথিবীতে অন্ধকার আনে
হাসিহীন এ জীবন কত ছোট, ছোট মনে হয়।
কালিমা লেগেছে কবে সারা দেহে, সোনালি বয়ানে
মৃত্যুর গলিত চিন্তা স্পর্শ করে কবোষ্ণ হৃদয়।


এ পৃথিবী আকাশের মাঝখানে মেঘের পাহাড়
তবুও উদ্দাম বেগে কত বার কত না প্রয়াসে
নিশ্বাসের আকাঙ্ক্ষায় দুই হাতে ঠেলেছি আঁধার
ভাসিয়া উঠিতে গেছি সপ্তরাঙা দিনের আকাশে।


তবু আমি সূর্যমুখী, আগামীর এ দৃঢ় বিশ্বাস
সূর্য-খোঁজা চেতনায় দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে
শত শত সূর্যমুখী জীবনের ছুঁইবে আকাশ
মৃত এই পৃথিবীর হিম রক্তে উষ্ণ স্রোত এলে।


মে, ১৯৫৭


    কবিতার সঙ্গে সম্পর্কহীন আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রের প্রথম কবিতা। তবে তার আগে একটা কথা বলা দরকার, যা আমার কাছেও স্পষ্ট নয়, তা হল – কবিতার আকর্ষণে তবে কেন আর্ট কলেজের কিছু আগে গিয়েছিলাম সিনেট হলের সেই বিখ্যাত কবিসম্মেলনে, কেন অচেনা কলকাতার বসন্ত রায় রোডের একটা বাড়ি খুঁজে হাজির হয়েছিলাম একটি সভায়, যেখানে দেখলাম বুদ্ধদেব বসুকে আর তার বিপক্ষে সুনীল, শক্তি সহ তরুণ কবিদের তর্ক-যুদ্ধ! তাহলে কি সত্যিই একটা তৃষ্ণা ছিল কবিতার জন্য?
এবার প্রথম লেখা কবিতা প্রসঙ্গে আসি। ‘সূর্যমুখী’ কবিতার শরীরে একটা প্রাচীন গন্ধ। তাছাড়া ‘আমি এক সূর্যমুখী’ এ যেন স্কুলের ‘সূর্যমুখীর আত্মকথা’ নামক রচনা, শেষ পঙ্‌ক্তিগুলিতেও সুকান্ত প্রভাব, এসব খারাপ লেগেছে। আর ছন্দ-মিলে লিখতে গিয়ে এসেছে যে ‘বয়ানে’ শব্দটি, তা আমার পছন্দ হয়নি। তবু বলি, আজ এই সময়ে বসে কোনো তরুণ কবির লেখায় যদি পড়ি – ‘কামনার গতি বুকে নিয়ে’, ‘অবাধ্য হাওয়ার রাত্রে বারে বারে নিজেকে হারিয়ে’ বা ‘মৃত্যুর গলিত চিন্তা’ অথবা ‘নিঃশ্বাসের আকাঙ্ক্ষায় দুই হাতে ঠেলেছি আঁধার’ – তাহলে কি তাকে খুব সম্ভাবনাময় বলে মনে হবে না? একথা সব পাঠকের মনে না হতেও পারে, কারণ এর ভিতর যে চিত্ররূপময়তা ও অনুভবচিত্র আছে, এবং যা ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ দেয়, সেই আনন্দের সঙ্গে তো রবীন্দ্রনাথ বলার পরেও সকলের পরিচয় ঘটেনি। ‘চিত্ররূপময়’ শব্দটিকে চিনেছি রবীন্দ্রনাথের এই কথাটি থেকে – ‘কথার দ্বারা যাহা বলা চলে না ছবির দ্বারা তাহা বলিতে হয়। সাহিত্যে এই ছবি আঁকার সীমা নাই।’ যা দেখা যায়, তা ‘চিত্ররূপময়’, কিন্তু যা দেখা যায় না, অর্থাৎ দেহ নেই যাদের, পাঠক শুধু মাত্র মনশ্চক্ষে অনুভবে যাদের ছবি দেখেন, সেই ছবিকে আমি বলি ‘অনুভবচিত্র’। এরকমই ‘কামনার গতি’, ‘অবাধ্য হাওয়া’ বা ‘মৃত্যুর গলিত চিন্তা’ এই সব দেহহীনের ছবি ফুটে ওঠে অনুভবে। যেমন সূর্যমুখীর ভিতরে  যে  সূর্যের  স্পর্শ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা কামনা, সেই কামনাই তার মুখটি  
ঘুরিয়ে দেয় সূর্যের দিকে – এই ঘুরিয়ে দেওয়া গতিই কামনার গতি। ‘কামনা’-কে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করি তার গতিকে। ‘অবাধ্য হাওয়ার রাত্রে বারে বারে নিজেকে হারিয়ে’... যে হাওয়া শান্ত বা ধীরে প্রবাহিত হয় না, যে অবাধ্য, মাতাল  বা স্বেচ্ছাচারী, সে একটি স্থির ও ছোট বৃন্তে লগ্ন এক সূর্যমুখীকে বার বার অন্ধকারে স্থানচ্যুত করে দিচ্ছে। ফলে সূর্যমুখী নিজের জায়গাটি খুঁজে না পেয়ে গৃহচ্যুত হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে বার বার। এসবই তো ছবি বা চলচ্চিত্র, যাকে দেখি অনুভবচিত্রে। ‘আঁধার’-এর শরীর নেই, তবু যখন বলা হয় –‘দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে’ তখন কল্পনাই অনুভবচিত্র হয়ে মনশ্চক্ষে ছবিটি তুলে ধরে। সূর্যমুখীর সামনে যখন চিমনির কালো ধোঁয়া অন্ধকার আনে, তখন তার শ্বাসকষ্ট হয় আর আড়ালে চলে যায় তার আকাঙ্ক্ষিত জ্যোতির্ময় সূর্য। তাই সূর্যমুখীকে দুই হাতে সেই অন্ধকার ঠেলে ভেসে উঠতে হয় সূর্যদর্শনের জন্য। সূর্যমুখীর সঙ্গে কবি তার আত্মা বদল করেছেন বলে কবির এই অনুভব তখন মানবিক ও সর্বজনীন অনুভব হয়ে ওঠে। তরল প্রবাহকে রোধ করা যায় না, তাই ‘মৃত্যুর গলিত চিন্তা’। ভাষাতীতকে প্রকাশ করা যদি কবিতার সর্বোচ্চ সাফল্য হয়, তাহলে এই সব শব্দে আঁকা ছবি, যাকে চিত্ররূপময় ও অনুভবচিত্র বলি, তা তখন কবি ও কবিতার খুব বড় সম্পদ হয়ে ওঠে। কবিতার মধ্যে এমন শব্দ বা বাক্য থাকে যা কবির না-বলা ভাবনাকে ধারণ করে, তাকে আবিষ্কার করে বাক্যে প্রসারিত করতে গদ্যে অনেক কথার প্রয়োজন হয় – কবিতার এটাই অহঙ্কার। সংবেদী পাঠক কল্পনায় কবির ভাবনা নিজের মতো করে সৃজন করার সুযোগ ও আনন্দ পান কবিতায়। তাই কবিতা একবার পড়লে পড়া শেষ হয় না, তার মোহময় আকর্ষণ এমনই তীব্র।
আমি যে কবিতাকে কোনো কাব্যগ্রন্থেই রাখিনি, তাকে নিয়ে এতো বেশী কথা কেন? আসলে আত্মজৈবনিক লেখায় নিজের কথা বেশী আসে বলে লিখতে চাইনি। পরে মনে হল যে কবিতা নিয়ে আমার বিশ্বাস ও ভাবনা, যাকে আমি এখনও নির্ভুল মনে করি, তার পক্ষ নিয়ে কিছু বলার সুযোগ হবে এবার। জীবনে অনেক উজ্জ্বল স্মৃতি আছে যা আমাকে অহঙ্কারী করে, কষ্ট হলেও তাকে সরিয়ে রাখলাম, কারণ এটা জীবনস্মৃতি নয়। বরং কবিতা নিয়ে কবির কাছে যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও জরুরী ভাবনা, তা হলো কাব্যভাবনা। কারণ কবিতার সম্পদকে সঠিক ভাবে চিনে, তাকে লক্ষ্যভেদে অমোঘ করার সাধনাই তো কাব্যচর্চা।
এবার শিল্প নিয়ে একটা বোধের জন্মকথা বলি, যা চিত্রশিল্পের পাশাপাশি সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ও অন্যান্য সব শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেই জরুরী। আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষে যখন ছাত্ররা একা বা দলবদ্ধ ভাবে নানা দিকে ছবি আঁকতে বেরিয়েছি, তখন কেউ ইডেন গার্ডেন, চিড়িয়াখানা বা রেল স্টেশনে, তখন আমি এসে দাঁড়ালাম এন্টালির  খোলার  চালের একটি ন্যুব্জ বস্তির সামনে। বেছে নিলাম সেই ভগ্নদশা। আর আঁকতে গিয়ে এমন একটি জায়গায় বসতে হল যেখানে সামনে পড়ে গেল বস্তির পায়খানা, যার নিচের মল-মুত্র নিয়ে বিশাল চারিটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত কুৎসিত দৃশ্য। অথচ সেই দৃশ্যটি বর্জন না করে, সেই পায়খানাকে সামনে রেখেই যা আঁকলাম, তা যেন কুঁজো হয়ে হেলে পড়া এক বৃদ্ধ। রঙ দিয়ে নয়, কালি-কলমে এঁকে, আলো-ছায়াকে ধরতে হালকা কালো রঙের প্রলেপ দেওয়া ছবি। একদিন দেখি ছবিটি স্থান পেয়েছে কলেজের বার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনীতে, যে ছবিকে চারপাশের সুন্দর ছবিগুলির মধ্যে সব চেয়ে কুৎসিত ও অচ্ছুৎ এক ঘৃণ্য দৃশ্য বলে মনে হয়। ধনীদের গৃহসজ্জায় লাগে এমন দৃষ্টিনন্দন ছবির ভিড়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রের আঁকা অশোভন চিত্র! অথচ তা প্রদর্শনীতে স্থান পেয়ে বিক্রি হল, আর কিনলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তর বংশধর এন সি ডাটন!
ঘটনাটির সঙ্গে অহঙ্কার মিশে আছে, তবু উল্লেখ করলাম নন্দনতত্ত্বের একটা দিক উদ্ভাসিত হল বলে। নিউ টাউনের বিশাল ও সুন্দর অট্টালিকা ও ন্যুব্জ বস্তির নান্দনিক মূল্যায়ন হয় তার শিল্পমূল্যে। চীনের প্রবাদেও আছে – অসুর ও দেবতার আঁকা দুটি চিত্রের মূল্যায়ন তাদের পরিচয়ে নয়, শিল্পকর্মের উৎকর্ষ বিচারে। কথাগুলি থেকে যে শিক্ষা পাই, তার সঙ্গে মিলে যায় রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাটি – ‘বিষয়ের বাস্তবতা উপলব্ধি ছাড়া কাব্যের আর-একটা দিক আছে সে তার শিল্পকলা।’ অথচ কবিতা লিখতে বসে আমরা কতটা সচেতন এই শিল্পকলা নিয়ে? গুণীজন বলেন ‘কবিতার ইতিহাস, তার আঙ্গিকের ইতিহাস।’ অথচ দেখি, কবিতার সমালোচনার ক্ষেত্রে কবি কী বলছেন, তা নিয়ে আলোচনা যত, কবির আঙ্গিক ও শিল্পকলা নিয়ে আলোচকের নীরবতা ততটাই বেশি।
      ছবি আঁকার প্রসঙ্গ যখন এলো, তখন এ নিয়ে আরও কিছু কথা বলা যায়।  পাঁচ বছরের পাঠক্রম শেষ করেও দেখলাম চিত্রশিল্পের গভীরে যেতে পারিনি। তখন তেমন পাঠ্যবই বা সে বিষয়ে পাঠগ্রহণের ব্যবস্থা ছিল না। কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্বত্তাবধানে সিনেট হলে পড়ানো হতো আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েসন কোর্স। সেখানে ভর্তি হয়ে সহপাঠী ও বন্ধু হিসেবে পেলাম বিখ্যাত শিল্পী রবীন মন্ডলকে।  কিন্তু সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ মিটবে কীভাবে? তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটবে বলে চাকরি করতে করতে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশকালীন রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠক্রমে ভর্তি হলাম। ‘দেশ’ পত্রিকায় আগেও লিখেছি, কিন্তু রবীন্দ্র ভারতীতে  পড়ার সময় আর একটি লেখা ‘দেশ’-এ প্রকাশ হওয়ায় কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলাম। ওখানে রবীন্দ্রমূর্তির নীচে ঘাসে বসে কয়েকজন মিলে শুরু করলাম প্রতি পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় নিজের বা অন্য কবির কবিতাপাঠ ও গানের অনুষ্ঠান।
      উল্টোডাঙায় আমাদের বিল্ডিঙের চারতলায় ইন্দু গুপ্তের ঘরে প্রতি শনিবারের সাহিত্যসভায় ও উল্টোডাঙ্গা  থেকে  প্রকাশিত ‘নবাহ’ পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে গেলাম। স্ত্রী গোপারও প্রুফ দেখার অভ্যেস ছিল ওর বাবার বই প্রকাশের সময় থেকেই। আমরা রাত জেগে প্রুফ দেখায় বিরক্তির পরিবর্তে তৃপ্তি পেতাম। পরে আমি যুগ্ম সম্পাদক থাকার সময় সকলকে বুঝিয়ে যে পদ্ধতি চালু করতে পেরেছিলাম, তা সম্পাদক বন্ধুরা ভেবে দেখতে পারেন। যেমন –
১) পত্রিকার লেখকদের লেখার জন্য সম্মানদক্ষিণা দেওয়া উচিত, কিন্তু তা দিতে পারি না, শুধু সৌজন্য সংখ্যা দেওয়া হয়। তাই আমরা তো তাঁদের প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করাতে পারি, কোনো লেখার নীচে ছোট হরফে দৃষ্টিনন্দন ভাবে লেখকের বই ও লেখকের পরিচয় দিয়ে।
২) প্রচুর পত্রিকা, অথচ এক পত্রিকার পাঠক অন্য পত্রিকার খবর জানি না। তাই, যদি অন্য পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরস্পরের বিজ্ঞাপন বিনিময় হয় নাম, ঠিকানা ও পত্রিকার পরিচয় দিয়ে, তাহলে পাঠক ও পত্রিকার উপকার হয়।
৩) ‘নবাহ’ নিয়ে আর একটা ভাল কাজ হল সে সময়ের সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে পত্রিকার পাঠকদের পরিচয় ঘটানো। তাই সেই সময়ে চলা ‘এই দশক’ নামের আন্দোলনে যুক্ত লেখকদের নতুন ধারার একটি করে গল্প প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে। শেষে এই ধারার গল্পের পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি আলোচনা ‘নবাহ’-র একই সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছিল।
এছাড়া যেগুলি চালু ছিল তা বহাল রাখা হয়। যেমন ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রত্যেক সংখ্যায় আগামী তিন মাসের সাহিত্যসভার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও সাহিত্য প্রতিযোগিতার ঘোষনা ও পুরস্কার দেওয়ার কাজ।
এই প্রসঙ্গে একটি মজার কথা বলি – ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার সম্পাদক অনিল আচার্য একদিন আমাকে বললেন, ‘রমেনবাবু, আপনাদের পত্রিকার পুরস্কার আনতে যে পুরস্কারপ্রাপকের সঙ্গে গিয়েছিলাম, তিনি এখন আমার স্ত্রী।’ খুব ভালো লেগেছিল শুনে। তবে বেশি পরিচয় থাকলে মুশকিল এই যে সেখানে না চাইলে লেখা পাঠানো যায় না বলে পাঠাইনি কখনো। তবে ‘অনুষ্টুপ’-এর  একটি সংখ্যার আমন্ত্রিত সম্পাদক আমার লেখা চেয়ে সেখানে ছেপেছিলেন। একবার বইমেলায় ‘প্রতিভাস’-এর স্টলে ওদের প্রকাশিত দুটি বই উদ্বোধন হয়েছিল জয় গোস্বামী ও আমার হাত দিয়ে। সেখানে ক্যামেরা ও ক্রেতার ভিড় স্বাভাবিক ভাবেই জয় গোস্বামীর জন্য, তাই আমি চুপ করে ছিলাম। জয় বলেছিলেন –‘আপনি চিরকালই লাজুক থেকে গেলেন।’ পরে একবার বলেন –‘আমি এতদিন ‘দেশ’-এ ছিলাম, আপনি কখনো আমার হাতে লেখা দেননি তো!’ কী বলবো, এই অসুখের জন্যই তো চিরকাল আড়ালেই থেকে গেলাম।
এবার  আমার  প্রথম বই প্রকাশের কথা বলি। তার আগে বলি প্রথম কবিতা ‘সূর্যমুখী’  সমাদৃত হওয়ার পরে যখন  নিজের ভিতর থেকেই কবিতার ভিতরের  নানা সম্পদকে খোঁজা ও জানার ইচ্ছে তীব্র হয়ে উঠছিল, আর চলছিল নিয়মিত লেখালেখি, তখন শুরু হল ‘উন্মেষ’ পত্রিকার চারজনকে নিয়ে প্রতি শনিবারের সাহিত্যসভা। সেখানে  প্রবেশপত্র ছিল – নতুন কোনো গল্প বা কবিতা।
পত্র-পত্রিকায় এভাবেই লেখার শুরু। যে লেখাগুলি দেশ, পরিচয়, কৃত্তিবাস, উত্তরসূরি ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি নিয়ে তৈরী করেছিলাম একটি পান্ডুলিপি, কী ভাবে তা প্রকাশ পাবে সে সম্পর্কে কোনো পরিকল্পনা  ছাড়াই। অভাবিত ভাবে তা প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে খ্যাতনামা প্রকাশক সৈয়দ মোহাম্মদ শফী-র ‘বইঘর’ থেকে ‘সেই উন্মোচন’ নামের কাব্যগ্রন্থটি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদে পৌষ ১৩৭৯-তে প্রকাশিত হল। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হল তা বলতে আগের কিছু ঘটনা বলতে হবে।
একসময় পশ্চিমবঙ্গ যুব উৎসব কমিটির উদ্যোগে নানা জেলায় আঞ্চলিক ভাবে নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের পরে মূল অনুষ্ঠান হতো রঞ্জি স্টেডিয়ামে। সেই প্রতিযোগিতায় আমার গল্প প্রথম হয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় হেলিসিঙ্কিতে গিয়েছিল। আর ছড়া বিভাগে যে প্রথম স্থান পেয়েছিল সে কিশোর সভার এখ্‌লাস উদ্দিন আহ্‌মেদ। এই ঘটনার পরে এখ্‌লাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর হয়ে ওঠে। কিন্তু একসময় এখ্‌লাসদেরও মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়। বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পরে সেখানে বিখ্যাত ‘বইঘর’ কলকাতার লেখকদের সঙ্গে বৈধ ভাবে বই প্রকাশের চুক্তি করতে আসেন, তখন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন এখ্‌লাস। প্রকাশক জানান তাঁদের নির্বাচকদের  অনুমোদন পেলে নতুনদের বইও প্রকাশের জন্য বিবেচিত হবে। পান্ডুলিপি জমা দিয়ে অনেক দিন উৎকন্ঠা নিয়ে কাটাই, তারপর আসে বই প্রকাশের খবর।
অভাবিত আর একটি প্রাপ্তির কথা জানিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাবো। কবি-লেখকদের সঙ্গে আমার তেমন মেলামেশা ছিল না গুটিয়ে থাকা স্বভাবের জন্য। তবু  প্রতি বছর শুনতে পেতাম অমুক কবি এবার  জাতীয় কবি হয়েছেন। সেটা যে কীরকম গৌরব তা জানলাম যখন কলকাতার আকাশবাণীর পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। জানলাম প্রতি বছর ভারতের প্রত্যেক ভাষা থেকে একজন কবির কবিতা নির্বাচন করে সেই কবিকে ‘সর্বভাষা কবিসম্মেলন’-এ আমন্ত্রণ করা হয়। সেখানে মঞ্চে কবি মাতৃভাষায় নিজের কবিতা পাঠ করার পরে অনুবাদকের কন্ঠে তার হিন্দি অনুবাদ শোনানো হয়। পরে ভারতের প্রতিটি রাজ্যে স্থানীয় ভাষায় মূল অনুষ্ঠানমঞ্চে পঠিত সব ভাষার কবিতাগুলির অনুবাদ শোনানো হয়ে থাকে। ১৯৯৭-এ এই সম্মান প্রাপ্তির সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, যা আমি কখনও কল্পনা করিনি। আর না, এবার অন্য প্রসঙ্গ।
        আলোচনা শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইলেও দেখি, নানা দিক থেকে নানা ঘটনা এসে ভিড় করে। তবু অনেক উল্লেখযোগ্য স্মৃতি সরিয়ে রেখে বলি শিল্পের আর একটি শাখা চলচ্চিত্রের কথা। চলচ্চিত্রের দিকে আগ্রহ ছিল বলে  সিনে ক্লাব ও পরে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হয়ে নানা দেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র দেখেছি। সে সময়ে তালতলা অঞ্চল থেকে প্রকাশিত ‘পয়গম’ পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিভাগে চলচ্চিত্র সমালোচনার দায়িত্ব পেলাম। চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণার সঙ্গে যুক্ত হল ‘আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েসন’-এর বিদ্যে। সেখানে পার্থপ্রতিম চৌধুরী পরিচালিত ‘ছায়াসূর্য’ ও সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’-এর আলোচনা লিখে বিশেষ তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
প্রায় সকলের কাছে অফিস মানেই কর্মক্ষেত্র, আমারও তাই, তবে পাশাপাশি তা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রও হয়ে উঠেছিল। এক সময় টিফিনে তাস খেললেও, পরে সেই অবসরকে কবিতা পড়া বা লেখার সময় করে নিয়েছিলাম – এই কারণে অফিসকে ‘সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র’ বলিনি। কলকাতায় আমাদের অনেকগুলি অফিস ও কয়েক হাজার কর্মী। যেমন যাদুঘরের একটু পর থেকে জীবনদীপ পর্যন্ত যে এলাকা সেখানে মোট সাতটি অফিস, অন্য অফিসগুলি নানা অঞ্চলে। অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাবের রজত জয়ন্তী বর্ষে পত্রিকা প্রকাশ, গ্রন্থাগার, মাসিক সাহিত্য- সভা সহ নানা দায়িত্ব নিতে হয়েছিল আমাকে। ক্লাব কমিটির নির্বাচনে যখন ভোটের দীর্ঘ লাইন, তখন বাম ও দক্ষিণ পন্থী দুটি প্রার্থী তালিকায়ই আমার নাম থাকায় পরাজয়ের লজ্জা এড়াতে পেরেছিলাম, কারণ আমি তখন প্রায় নবাগত ও অপরিচিত। কী ভাবে এটা হয়েছিল তা জানি না, তবে যা অনুমান করি তার সূত্রটুকু বলা যায়। দোতলা বাসে উপরের নির্জনতায় বই খুলে বসতাম, একদিন পাশের একজন বললেন, কী বই পড়ছেন? বললাম ‘সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত’। উনি বললেন কবি ছাড়া কেউ তো কবিতা পড়েন না, আপনি কি লেখেন? কথাবার্তায় জানলাম উনি অনিরুদ্ধ কর, যাঁর গল্প মাঝে মাঝেই আনন্দবাজারের রবিবারের পাতায় পড়ি, আর উনি জি এস আই অফিসেরই কর্মী। পরে অফিসের পত্রিকা ‘সমীক্ষা’ প্রকাশের সময় আমাকে বলেছিলেন যাঁরা লেখেন না, তেমন বহু গুণীজনদেরও কীভাবে পত্রিকায় নানা বিষয়ে নানা বিভাগের লেখায় যুক্ত করা যায়।  প্রতি মাসে ‘আলাপ’ নামে যে সাহিত্যসভা নিয়মিত চলতো, হঠাৎ একদিন সেখানে সতরঞ্চির আসনে এসে বসলেন জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সর্বময় কর্তা জি সি চ্যাটার্জী, যিনি অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের বাবা।
আত্মজৈবনিক গদ্য লিখতে বসে দেখছি এমন অনেক ঘটনা এই লেখায় ঢুকতে চাইছে, যার সঙ্গে গল্পের স্বাদ মিশে আছে, আর যা মিশেছে তা আমার কিঞ্চিৎ অহঙ্কার।  ফলে বাতিল করতে হল সে সব। কবিতার বৃত্তেই যদি সীমাবদ্ধ রাখি  লেখাটি,  তাহলেও  কবিতা নিয়ে বলার কথাও অনেক। তাই ভাবছি আমার কবিতা-ভাবনা ও লেখার ব্যর্থতা-সফলতা জড়িয়ে কী ভাবে তা পাঠকের সামনে এসেছে, তা যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। সাহিত্যকে সময়ের দর্পণ বলা হয়, আর কবিতা যেন এমন একটি আয়না যেখানে কবির আত্মাকে দেখি। তাই কবির মানসিকতা ও প্রবৃত্তি কী ভাবে শব্দের ভিতরে মিশে যায়, তা আবিষ্কার করেন পাঠক। গল্প ও ছবি আঁকার কাজ ছেড়ে কবিতাকে বেছে নেওয়ার আগে নিজের বোধে কবিতাকে কীভাবে চিনেছি তা জানানো জরুরী। কবিতা যদি আমার প্রকাশ-মাধ্যম হয়, তাহলে তা যেন কবিতার ধর্ম চিনেই হয়। দেখেছি কবিতা দু’রকম – ভালোলাগা কবিতা ও ভালো কবিতা। ধাঁধার মতো মনে হলেও কথাটা ঠিক। মঞ্চসফল কবিতা যেমন একবার মাত্র শুনে বা পাঠ করে আমরা আলোড়িত হই, সভাঘরেও তা করতালিতে অভিনন্দিত হয় – সে রকম কবিতাকে বলি ভালোলাগা কবিতা। আর যে কবিতা গভীর ও সূক্ষ্ম, আর সেই কারণেই তা কিছুটা জটিল বলে তাকে বুঝতে বার বার তার কাছে যেতে হয়, একটু একটু করে প্রকাশিত হয় তার ভিতরের সূক্ষ্ম ও গভীর সম্পদ – সেরকম কবিতাই ভালো কবিতা। এই জন্যই কবিতাকে বলা হয় সূক্ষ্মতম শিল্পমাধ্যম। সূক্ষ্ম ও ভাষাতীত অনুভব বা অধরা মাধুরীকে শব্দবন্ধনে ধরা কবির সর্বোচ্চ সাফল্য – একথা কবিকে ভুললে চলে না।
আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে অফিসের আর একটি ভূমিকা আছে। যখন নানান কারণে দীর্ঘদিন লেখা বন্ধ ছিল, তখন দু’বছরের জন্য ভূটানে বদলির আদেশ এলো। ভূটান যেন এক অন্য পৃথিবী। সুন্দর পাহাড়ি টিলার উপরে কিছুটা দূরে দূরে এক একটা কোয়ার্টারে গায়ে লাগা দুই পরিবারের জন্য পৃথক দুটি আস্থানা।
স্ত্রী, শিশুপুত্র ও প্রিয়জনদের ফেলে এসে নিঃসঙ্গ নির্জন জীবনে বিচিত্র সব অনুভব আলোড়িত করছিল আমাকে, ফলে কবিতার আশ্রয়ে ফিরতে হল আবার। নিঃসঙ্গ নির্জনতায় কবিতাই তখন একমাত্র সঙ্গী। ওখানে বসে লেখা কবিতাগুলি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘নোঙরের জন্য ভূমি’ ও ‘আতঙ্ক ও অন্যমনস্কতা’ বই দুটি।  এখানে একটি কথা না জানালে অন্যায় হবে, তা হল আমার বাড়ির পরিবেশ                  
আমার সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেছে। স্ত্রী ও পুত্র দু’জনেই কবিতা লেখে, পুত্রের বাসুদেব-এর ৭ থেকে ১৪ বছরের লেখা নিয়ে ‘আমার কবিতাগুলি’ বইটি রায়গঞ্জে কৃষ্ণা বসুর সঙ্গে যুগ্মভাবে পুরস্কৃত হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিচারে। কিন্তু বাসুদেব এখন এমন পেশায়, যা তাকে কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তবে রোবট-সভ্যতা আসার আগে আশার আলো দেখি, যখন আমার ১৩ বছরের নাতনি পতত্রী বলে –‘তোমার এই কবিতায় চিত্ররূপময়তার চেয়ে অনুভবচিত্রই বেশি।’  
    এবার সেই ভূটানের কথা, যা আমাকে কবিতায় ফিরিয়ে এনে নতুন এক পৃথিবীকে  চিনিয়েছে।  প্রিয়জনদের  ছেড়ে  যাওয়ার  যন্ত্রণার  মুহূর্ত  নিয়ে  রচিত  ‘বিদায়’ নামের কবিতা নিয়ে প্রকাশ্যে, অর্থাৎ ‘কবিসম্মেলন’-এ প্রকাশিত আমার সাক্ষাৎকারে যে  প্রশ্ন করা হয়েছিল, তার কয়েক পঙ্‌ক্তি – ‘প্ল্যাটফর্ম ও ট্রেনের কামরার মধ্যে ঝুলছে জানালা। নাকি / ছবির দু’পিঠ খোলা ফ্রেম! … পলক না-পড়া চোখ দুটিই এখন পর্দা তোলা জানালা। / শেষ মুহূর্তে দেখতে দিচ্ছে তার অন্তঃপুর, তার / ঝাঁট না-পড়া ঘর ও শূন্যতা। …মোষের মতো কালো কুচ্কুচে ইঞ্জিনটা নড়ে উঠতেই / কেঁপে ওঠে ঘর সংসার। ইঞ্জিনের গরম গা বেয়ে / কয়েক ফোঁটা জল আঁচল উড়িয়ে নামতে নামতে বলে – / ধ্যাৎ, লোহা ছাড়া এ শরীরে আর কিচ্ছু নেই।’ সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়েছিল – ‘কয়েক ফোঁটা জল আঁচল উড়িয়ে নামতে নামতে ...’ নিয়ে। আমি মনে করি না যে আমার কবিতা দুর্বোধ্য। আমার অনেক কবিতায় যে ‘চিত্ররূপময়তা’ থাকে তার দিকে তাকিয়ে ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ পাওয়ার মতো চোখ জেগে না উঠলে তাকে দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। শুধু আমার নয়, সব চিত্ররূপময় কবিতাই এরকম। যেমন ‘চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা’ পড়ে কেউ ভাবতে পারেন – তরল জল কী করে বাঁকা হয়? এটা তার কাছে দুর্বোধ্য। তাকিয়ে দেখে আনন্দ পাওয়ার চোখ থাকলে দেখা যাবে – তরল জল  বাঁকলেই তা হয়ে যাচ্ছে – ঢেউ। এভাবেই যখন জলের ফোঁটা অর্ধবৃত্তাকার ষ্টিমইঞ্জিনের গরম গা বেয়ে গড়িয়ে নামে, তখন সামনের জলের ফোঁটাকে স্পষ্ট দেখা গেলেও পেছনে জলের ঝাপসা রেখাটিকে জলের উড়ন্ত আঁচল মনে হয়। এরকম শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করি, যেমন না-বলা কথা নিয়ে একটি ছবি –  ‘ভালোবাসার যুদ্ধে জয়ী হয়েও বিষণ্ণ ঘাস নত হয়ে বলল – / তলোয়ারের মতো আকৃতি নিয়েই তো আমাদের জন্ম, কিন্তু / আমরা তাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে নিয়েছি / নিচু হয়ে শিশুর কপালে ঠোঁট রাখবো বলে।’ রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে লিখেছিলেন –‘তোমার লেখায়...তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়ন সকলের কাছে স্পষ্ট নয় বলে এই নিয়ে কোনো আলোচনা কোথাও দেখি না। কবিতার শব্দ ও বাক্যের মধ্যে যদি দৃশ্য ফুটে  ওঠে, তবে সেই চিত্ররূপমতার দিকে তাকিয়ে পাঠক যদি আনন্দ পান তবে সেই আনন্দ তো নান্দনিক সব আনন্দকেই ছাপিয়ে যাবে। অনেকের কাছে বিষয়টি দুর্বোধ্য মনে হতে পারে, তবু খুব অল্প সংখ্যক পাঠকও তো থাকেন যাঁরা নিজের মনশ্চক্ষে দৃশ্যটি দেখে আনন্দ পাবেন। যে কবি জনপ্রিয় নন, তাঁর কাছে তখন অল্প কিছু পাঠকের ওই প্রাপ্তি ও তৃপ্তিই হয়ে ওঠে সান্ত্বনা পুরস্কার। কিছুদিন আগে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় আমার ‘কবিতাসংগ্রহ’ ও ‘কবিতার শিল্পকলা’ বই দুটির সমালোচনার শিরোনাম ছিল – ‘চিত্ররূপময় কবিতা রচনায় মগ্ন এক কবি’।
ভূটানে বদলির আদেশ আমাকে কবিতায় একাগ্র ও মগ্ন থাকার সু্যোগ করে দিয়েছিল  বলেই  নয়, তা যেন আমাকে অন্য এক পৃথিবী চেনালো। যেখানে মাসে মাত্র একবার বিমান-বাহিনীর হেলিকপ্টার অফিসের খনিজ সম্পদের খোঁজে যুক্ত কর্মী ও প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেয় দুর্গম স্থানে, সেখানে অসময়ে পাহাড়ের পর পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই ভেঙে পায়ের ফোস্কা নিয়ে দুদিনের যাত্রা-পথে দুঃসহ যন্ত্রণাই শুধু নয়, পেয়েছিলাম জনহীন আদিম অরণ্যের ভিন্ন এক পরিচয়। আজ সেই যন্ত্রণা হয়েছে সুখস্মৃতি। নানা লেখায় সেই আদিম অরণ্য এসেছে। তার কথা শুধু ভূটানে বসে লেখায় নয়, আজও কবিতায় বারবার আসে। সেসব একটু বলি, যাতে আমার কবিতাকেও চেনা যাবে –‘তিন লাইনের ঠিকানা থেকে বেরিয়ে আজ পরিচয়হীন আমি / এই পাহাড়িদেশে অতিথি। ‘আসুন’ বলেই / টিলা তার মাথা ঈষৎ নত করল। চটি খুলতেই / একদল ঘাসশিশু কচি কচি হাত পেতে দিল একসঙ্গে!’ এবার জনহীন পাহাড়ের চিত্র – ‘অনেক অচেনা ফুল শুকিয়ে রয়েছে গাছে গাছে। যেন কেউ / ইহাদের বিবাহ করেনি! যে রকম স্রোতে / পোড়া কাঠ ভেসে এলে হঠাৎ চমকে সরে যাই, সে রকম / পুষ্প তার কঙ্কাল দেখাল।’ আর একটি কবিতা ‘পর্যটক’-এর কয়েক পঙ্‌ক্তি – ‘পাহাড় ও ঝরনার পাশে নির্জন পাহাড়ি কুটিরে বসে ভাবি / এইখানে আমি খুব বেমানান নাকি? মেঘ যেতে যেতে এই লাল / টিনের চালাকে ছুঁয়ে চমকে বুকের আঁচল / ঠিক করে। বোঝে, এ জিনিস প্রকৃতি গড়েনি। এতে / মানুষের স্পর্শ ও ঘামের গন্ধ আছে।’ এই মায়াবী জগতের সঙ্গে একসময় আংটি বদল হয়ে যায় এক মোহময় মুহূর্তে – ‘দেখা হবে’ বলেছিলাম। অস্ফুট সে প্রতিশ্রুতি / কার কাছে? ...... মুখোমুখি তুমি এক দুঃখী হ্রদ / বিষন্ন ও একা। তোমার গভীর গাঢ় শুশ্রুষার চোখ / জেগে ওঠে জ্যোৎস্নায়, অকস্মাৎ তুমি / বুকের আঁচল তুলে অলৌকিক স্বচ্ছতা দেখালে! / ... ‘ভুলবো না, দেখা হবে, সাক্ষী থাক বনভূমি / আকাশ, পর্বত।’ ভুলবো না বলেছিলাম, অথচ নগর জীবনে এসে দুষ্মন্তের মতো সব ভুলে বসে আছি। এখানে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অংশে কবিতাটির  স্বাদ  পাওয়া  যাবে না,  সাহিত্য অকাডেমির ‘বাংলা কবিতা সমুচ্চয়,’ সংকলনের দ্বিতীয় খন্ডে এই ‘মগ্ন গৃহস্থালী’ নামের কবিতাটি আছে।
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাই প্রেমের কবিতা। যে কবিতাটি ‘এশিয়া’ প্রকাশনের ‘চিরকালীন ভালবাসা’ কবিতা সংকলনে গৃহীত হয়েছিল, তা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রথম কবিতা। কবিতার শুরু এরকম –‘ উদাসীন হতে হ’লে কিছু প্রেম বুক থেকে খুলে রাখতে হয়, / অথচ আমার মধ্যে তুমি এক শব্দিত নুপূর‌ / যমজ আত্মার মতো একাকার হয়ে শুয়ে আছো। / শিকড় ছাড়িয়ে নিতে বড় কষ্ট, বড়ো বেশী রক্তপাত হয়।’ আর একটি কবিতা –‘সন্ধ্যাবেলা সিঁড়ির বাঁকে শেষ যে কথা বলা হয়নি / বছর বছর তাদের নিয়ে অলৌকিক এক বাক্য গঠন / শেষ হল না। খসে পড়ছে পুরোনো ইট, / সিঁড়ির সে ঘর ভাঙা হচ্ছে!’
দেশ  ভাগের  ফলে  পশ্চিমবঙ্গে  এসেছি,  কিন্তু  নিজের ভিতর এক কণাও সাম্প্রদায়িক বিরূপতা নেই। নিচু ক্লাস থেকে খ্রিস্টান বন্ধু স্টিফেন আলফ্রেড মুন্সী, আর এপারে এসে এখ্‌লাস উদ্দিন আহ্‌মেদ সহ অন্য ধর্মের অনেকে, মাঝখানে কোনো বিরুপতার দেয়াল ছিল না। তাই কবিতাও তেমনি – ‘ভালোবাসা নেই, তাই সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় তার / যাবতীয় সৌন্দর্য হারিয়ে / দাঙ্গার উঠোন হয়ে আছে।’ আর একটি –‘শীত রাত্রে এক জলসায় একটি মাত্র শাল / টেনে নিয়েছিল ভিন্ন প্রান্তের, ভিন্ন ধর্মের দুটি মানুষকে। / সেই শালটি এখন কোথায়? / ওই কারুকার্যময় শাল থেকেই তৈরী হতে পারে একটা মানচিত্র / এই ভারতবর্ষের। / শালের নিচে পাঁজর ঘেঁষা কনুইকে তখন আর / লুকোনো ছোরা মনে হবে না।’
দাঙ্গা ছাড়াও তো সন্ত্রাস, পাড়ায় পাড়ায় এক এক রকম পতাকা ও মতবাদের বিভেদ থেকে। তেমনি যন্ত্রণা থেকে –‘ একটা জ্যান্ত দেশলাই হাতে নিয়ে ভয় দেখাচ্ছো, যেন / আগুন তোমার আদেশের অপেক্ষায় আছে। / একটা নিরীহ দেশলাইকে তোমরা ভাড়াটে খুনি বানিয়েছো! / অথচ গোলাঘর বা সুগন্ধি ধূপ কোনোটাই সে স্বেচ্ছায় বেছে নিতে পারে না।’ আরেকটি –‘অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল না –বলে / যে ক্রুদ্ধ আঙুল তুলেছো, সে আঙুলে / পেট্রোলের গন্ধ লেগে আছে। / সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে যারা নিজের ভিতরে রাখো বিদ্বেষ-বারুদ / আর পেট্রোল মিশিয়ে রাখো রক্তপ্রবাহে, তারা / চা খাচ্ছো, আড্ডা দিচ্ছো রোবট ভঙ্গিতে। / চায়ের গলিত আগুনে ঠোঁট রেখে বুকের ভিতরে পোষা / পেট্রোল ও বারুদের কথা ভুলে গেলে!’
নিজের কবিতার প্রচারে নয়, কবিতা নিয়ে আমার বিশ্বাসকে পাঠকের সামনে মেলে ধরার প্রয়োজনে এতটা নির্লজ্জ হতে হল। আমার বইগুলির আলোচনায় বারবার ‘উপেক্ষিত’ কথাটা এসেছে। এরকম সর্বশেষ সংযোজন ‘কবিসম্মেলন’-এ প্রকাশিত আমার শেষ বই দুটির আলোচনার শিরোনাম – ‘উপেক্ষিত কবির আশ্চর্য সৃষ্টিসম্ভার’। আর আমার প্রবন্ধের বইটি পড়ে শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ বললেন –‘বইটি খুব ভাল।’ যে কবির মুখে শুধু ‘ভাল’ কথাটাই অনেক বড় প্রাপ্তি, সেখানে ‘খুব ভাল’! ভাবা যায় না। অনেক সমালোচক আমাকে ‘প্রচার বিমুখ’ বলার পরেও যে এতো বেশী কবিতাকে পাঠকের সামনে আনতে হল, তার কারণ আমি মনে করি কবিতা এরকমই, অর্থাৎ কবিতা শুধু বিষয় বা বক্তব্যের শক্তিতেই কবিতা হয়ে ওঠে না, তাকে নির্মাণের শিল্পকলায় উচ্চতা অর্জন করতে হয়। শুধুমাত্র ছন্দ-মিলের রম্যতায় আনন্দিত হয়ে কাব্যরস ও শিল্পকলাকে উপেক্ষা করলে সেই লেখা কবিতা হয়ে ওঠে না। দেখেছি ছন্দ-মিল-এ লেখার পরে যে প্রসন্নতা, তা অনেক সময় কবিতার সূক্ষ্ম ও গভীর সম্পদগুলির কথা ভুলিয়ে দেয়। কবিতার ক্ষেত্রে এটাকে বড় বিপর্যয় মনে হয় আমার। এই লেখায় কবিতার  যেসব উদ্ধৃতি  দেওয়া  হয়েছে,  তা  আমার  কবিতার সমৃদ্ধ পঙ্‌ক্তি হিসেবে নয়। প্রকৃতি, প্রেম, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক হানাহানি নিয়ে যে ভাবনাগুলি আমাকে আলোড়িত করে, এসব তারই কিছু উদ্ধৃতি। কারণ কবির ভিতরের একান্ত আপন  যে বিষয়, তার সঙ্গে ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে’ দাঁড়িয়ে যে অনুভব, তাকেও কবিতায় তুলে ধরার প্রবল তাগিদ কবিকে আলোড়িত করে।
এই আলোচনায় অনেক প্রসঙ্গ বাদ দিতে হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুতেই বাতিল করা যাচ্ছে না বাগুইআটি কৃষ্টি সংসদের কথা, যে সংগঠন জন্মকাল থেকেই সাহিত্যের পাশাপাশি চিত্রশিল্প, নাটক, চলচ্চিত্র নিয়ে প্রতি মাসে নিয়মিত আলোচনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ একুশ বছর সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করে চলেছে। আমি  তার সঙ্গে জড়িয়ে আছি বলে গর্ব বোধ করি।
     এবার যা আমাকে চিন্তিত ও বিচলিত করে, তা নিবেদন করেই লেখাটি শেষ  করতে চাই। ‘সাহিত্য’ পত্রিকার আমার একটি আলোচনা শুরু হয়েছিল এইভাবে –‘রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ প্রমুখ কয়েকজন কবির ভিতর দিয়ে, কবিতার যে সূক্ষ্ম ও গভীর ধারাটি বাংলা কবিতাকে উচ্চতা দিয়েছে, সেই ধারাটি এখন কেমন? যেতে যেতে সেই ধারাটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে প্রায় বিপরীত দুটি দিকে বাঁক নেয়নি তো?’ এই আশঙ্কার কারণ, কবিদের এখন যে মঞ্চে বেশী দেখা যায়, সেখানে একবার মাত্র পড়ে শ্রোতাদের আলোড়িত করা যায়, তেমন কবিতাই নির্বাচন করতে হয়। ফলে কী হয়? সূক্ষ্ম ও গভীর কবিতার পরিবর্তে কবি লিখতে চান এমন কবিতা, যা পড়া বা শোনা মাত্র শ্রোতা বা পাঠক আলোড়িত হবেন। অথচ সূক্ষ্ম ও গভীর কবিতায় তা হয় না। এবার ‘সাহিত্য’ পত্রিকা থেকেই উদ্ধৃতি –‘অনেক সময়ই পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হওয়ার পরে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না, অথচ কবিসম্মেলনে কবিতাপাঠের তৃপ্তি অন্যরকম। এই তৃপ্তি কি কবিকে প্রভাবিত করে বদলে দিচ্ছে তার লেখার ধরন ও গতিপথ? যে সূক্ষ্ম ও গভীর কবিতা পাঠ করার পরে সভাস্থলে কোনো আলোড়নই ঘটলো না, কবির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে ফিরিয়ে দিল যে উদাসীন নির্বিকার মুখগুলি, তা থেকে কবি যে শিক্ষা নিলেন, তাতে কি বদলে গেল তার কবিতাও? কবিতা লিখতে বসলেই কেন তাঁর মনে অবচেতনে বারবার ভেসে ওঠে শ্রোতাদের করতালি? এভাবেই অনিশ্চিত অচেনা মহাকালের কথা না ভেবে কি কবির কাছে বর্তমানের এই তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিই অধিকতর আকাঙ্ক্ষিত মনে হয় তখন? ... এই প্রশ্নটির সামনে নীরবে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ। করতালির চেয়েও ছাপার হরফের আয়ু বেশি, একথা জেনেও যদি কবিতা লিখতে বসে বার বার শ্রোতার মুখ ভেসে ওঠে, সে ক্ষেত্রে এই সংকট শুধু ব্যক্তির থাকে না, বাংলা কবিতার উচ্চতাকেও তা বিপন্ন করে।
০০০


‘কবিতানগর’ পত্রিকায় প্রকাশিত