বিজয় নিভৃতে কী কহে নিশীথে?
কি কথা শুধায় নীরজা বালায়—
     দেখেছ, দেখেছ হোথা?
ফুলপাত্র হতে ফুল তুলি হাতে
নীরজা শুনিছে, কুসুম গুণিছে,
     মুখে নাই কিছু কথা।
বিজয় শুধায়— কমলা তাহারে
গোপনে, গোপনে ভালবাসে কি রে?
তার কথা কিছু বলে কি সখীরে?
     যতন করে কি তাহার তরে।
আবার কহিল, “বলো কমলায়
বিজন কানন হইতে যে তায়
করিয়া উদ্ধার সুখের ছায়ায়
     আনিল, হেলা কি করিবে তারে?
যদি সে ভাল না বাসে আমায়
আমি কিন্তু ভালবাসিব তাহায়
     যত দিন দেহে শোণিত চলে”।
বিজয় যাইল আবাস ভবনে
নিদ্রায় সাধিতে কুসুমশয়নে।
     বালিকা পড়িল ভূমির তলে।
বিবর্ণ হইল কপোল বালার,
অবশ হইয়ে এল দেহভার—
     শোণিতের গতি থামিল যেন!
ও কথা শুনিয়া নীরজা সহসা
কেন ভূমিতলে পড়িল বিবশা?
     দেহ থর থর কাঁপিছে কেন?
ক্ষণেকের পরে লভিয়া চেতন,
বিজয়-প্রাসাদে করিল গমন,
দ্বারে ভর দিয়া চিন্তায় মগন
     দাঁড়ায়ে রহিল কেন কে জানে?
বিজয় নীরবে ঘুমায় শয্যায়,
ঝুরু ঝুরু ঝুরু বহিতেছে বায়,
নক্ষত্রনিচয় খোলা জানালায়
     উঁকি মারিতেছে মুখের পানে!
খুলিয়া মেলিয়া অসংখ্য নয়ন
উঁকি মারিতেছে যেন রে গগন,
জাগিয়া ভাবিয়া দেখিলে তখন
     অবশ্য বিজয় উঠিত কাঁপি!
ভয়ে, ভয়ে ধীরে মুদিত নয়ন
পৃথিবীর শিশু ক্ষুদ্র-প্রাণমন—
অনিমেষ আঁখি এড়াতে তখন
     অবশ্য দুয়ার ধরিত চাপি!
ধীরে, ধীরে, ধীরে খুলিল দুয়ার,
পদাঙ্গুলি ‘পরে সঁপি দেহভার
কেও বামা ডরে প্রবেশিছে ঘরে
     ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলিয়া ভয়ে!
একদৃষ্টে চাহি বিজয়ের মুখে
রহিল দাঁড়ায়ে শয্যার সমুখে,
নেত্রে বহে ধারা মরমের দুখে,
     ছবিটির মত অবাক্‌ হয়ে!
ভিন্ন ওষ্ঠ হতে বহিছে নিশ্বাস—
দেখিছে নীরজা, ফেলিতেছে শ্বাস,
সুখের স্বপন দেখিয়ে তখন
     ঘুমায় যুবক প্রফুল্লমুখে!
‘ঘুমাও বিজয়! ঘুমাও গভীরে—
দেখো না দুখিনী নয়নের নীরে
করিছে রোদন তোমারি কারণ—
     ঘুমাও বিজয় ঘুমাও সুখে!
দেখো না তোমারি তরে একজন
সারা নিশি দুখে করি জাগরণ
বিছানার পাশে করিছে রোদন—
     তুমি ঘুমাইছ ঘুমাও ধীরে!
দেখো না বিজয়! জাগি সারা নিশি
প্রাতে অন্ধকার যাইলে গো মিশি
আবাসেতে ধীরে যাইব গো ফিরে—
     তিতিয়া বিষাদে নয়ননীরে
     ঘুমাও বিজয়। ঘুমাও ধীরে!’


   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)