শ্মশান


গভীর আঁধার রাত্রি শ্মশান ভীষণ!
ভয় যেন পাতিয়াছে আপনার আঁধার আসন!
সর সর মরমরে সুধীরে তটিনী বহে যায়।
প্রাণ আকুলিয়া বহে ধূমময় শ্মশানের বায়!


গাছপালা নাই কোথা প্রান্তর গম্ভীর!
শাখাপত্রহীন বৃক্ষ, শুষ্ক, দগ্ধ, উঁচু করি শির
দাঁড়াইয়া দূরে— দূরে নিরখিয়া চারি দিক-পান
পৃথিবীর ধ্বংসরাশি, রহিয়াছে হোয়ে ম্রিয়মাণ?


শ্মশানের নাই প্রাণ যেন আপনার,
শুষ্ক তৃণরাজি তার ঢাকিয়াছে বিশাল বিস্তার!
তৃণের শিশির চুমি বহে নাকো প্রভাতের বায়
কুসুমের পরিমল ছড়াইয়া হেথায় হোথায়।


শ্মশানে আঁধার ঘোর ঢালিয়াছে বুক!
হেথা হোথা অস্থিরাশি ভস্মমাঝে লুকাইয়া মুখ!
পরশিয়া অস্থিমালা তটিনী আবার সরি যায়
ভস্মরাশি ধুয়ে ধুয়ে, নিভাইয়া অঙ্গারশিখায়!


বিকট দশন মেলি মানবকপাল—
ধ্বংসের স্মরণস্তূপ, ছড়াছড়ি দেখিতে ভয়াল!
গভীর আঁখিকোটর আঁধারেরে দিয়েছে আবাস,
মেলিয়া দশনপাঁতি পৃথিবীরে করে উপহাস!


মানবকঙ্কাল শুয়ে ভসেমর শয্যায়—
কাণের কাছেতে গিয়া বায়ু কত কথা ফুসলায়!
তটিনী কহিছে কাণে ‘উঠ! উঠ! উঠ নিদ্রা হোতে’
ঠেলিয়া শরীর তার ফিরে ফিরে তরঙ্গ-আঘাতে!


উঠ গো কঙ্কাল! কত ঘুমাইবে আর!
পৃথিবীর বায়ু এই বহিতেছে উঠ আরবার!
উঠ গো কঙ্কাল! দেখ স্রোতস্বিনী ডাকিছে তোমায়
ঘুমাইবে কত আর বিসর্জ্জন দিয়া চেতনায়!


বল না, বল না তুমি ঘুমাও কি বোলে?
কাল যে প্রেমের মালা পরাইয়াছিল এই গলে
তরুণী ষোড়শী বালা! আজ তুমি ঘুমাও কি বলে!
অনাথারে একাকিনী সঁপিয়া এ পৃথিবীর কোলে!


উঠ গো— উঠ গো— পুনঃ করিনু আহ্বান!
শুন, রজনীর কাণে ওই সে করিছে খেদ গান!
সময় তোমার আজো ঘুমাবার হয় নাই ত রে!
কোল বাড়াইয়া আছে পৃথিবীর সুখ তোমা-তরে!


তুমি গো ঘুমাও, আমি বলি না তোমারে!
জীবনের রাত্রি তব ফুরায়েছে নেত্রধারে-ধারে!
এক বিন্দু অশ্রুজল বরষিতে কেহ নাই তোর,
জীবনের নিশা আহা এত দিনে হইয়াছে ভোর!


ভয় দেখাইয়া আহা নিশার তামসে—
একটি জ্বলিছে চিতা, গাঢ় ঘোর ধূমরাশি শ্বসে!
একটি অনলশিখা জ্বলিতেছে বিশাল প্রান্তরে,
অসংখ্য স্ফুলিঙ্গকণা নিক্ষেপিয়া আকাশের পরে।


কার চিতা জ্বলিতেছে কাহার কে জানে?
কমলা! কেন গো তুমি তাকাইয়া চিতাগ্নির পানে?
একাকিনী অন্ধকারে ভীষণ এ শ্মশানপ্রদেশে
ভূষণবিহীনদেহে, শুষ্কমুখে, এলোথেলো কেশে?


কার চিতা জান কি গো কমলে জিজ্ঞাসি!
দেখিতেছ কার চিতা শ্মশানেতে একাকিনী আসি?
নীরদের চিতা? নীরদের দেহ অগ্নিমাঝে জ্বলে?
নিবায়ে ফেলিবে অগ্নি, কমলে, কি নয়নের জলে?


নীরব নিস্তব্ধ ভাবে কমলা দাঁড়ায়ে!
     গভীর নিশ্বাসবায়ু উচ্ছ্বাসিয়া উঠে!
ধূমময় নিশীথের শ্মশানের বায়ে
     এলোথেলো কেশরাশি চারি দিকে ছুটে!


ভেদি অমা নিশীথের গাঢ় অন্ধকার
     চিতার অনলোত্থিত অস্ফুট আলোক
পড়িয়াছে ঘোর মলান মুখে কমলার,
     পরিস্ফুট করিতেছে সুগভীর শোক!


নিশীথে শ্মশানে আর নাই জন প্রাণী,
     মেঘান্ধ অমান্ধকারে মগ্ন চরাচর!
বিশাল শ্মশানক্ষেত্রে শুধু একাকিনী
     বিষাদপ্রতিমা বামা বিলীন-অন্তর!


তটিনী চলিয়া যায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
     নিশীথশ্মশানবায়ু স্বনিছে উচ্ছ্বাসে!
আলেয়া ছুটিছে হোথা আঁধার ভেদিয়া!
     অস্থির বিকট শব্দ নিশার নিশ্বাসে!


শৃগাল চলিয়া গেল সমুচ্চে কাঁদিয়া
     নীরব শ্মশানময় তুলি প্রতিধ্বনি!
মাথার উপর দিয়া পাখা ঝাপটিয়া
     বাদুড় চলিয়া গেল করি ঘোরধ্বনি!


এ-হেন ভীষণ স্থানে দাঁড়ায়ে কমলা!
     কাঁপে নাই কমলার একটিও কেশ!
শূন্যনেত্রে শূন্যহৃদে চাহি আছে বালা
     চিতার অনলে করি নয়ননিবেশ!


কমলা চিতায় নাকি করিবে প্রবেশ?
     বালিকা কমলা নাকি পশিবে চিতায়?
অনলে সংসারলীলা করিবি কি শেষ?
     অনলে পুড়াবি নাকি সুকুমার কায়?


সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম হায়—
     ছুটিতিস্‌ ফুল তুলে কাননে কাননে
ফুলে ফুল সাজাইয়া ফুলসম কায়—
     দেখাতিস্‌ সাজসজ্জা পিতার সদনে!


দিতিস হরিণশৃঙ্গে মালা জড়াইয়া!
     হরিণশিশুরে আহা বুকে লয়ে তুলি
সুদূর কাননভাগে যেতিস্‌ ছুটিয়া,
     ভ্রমিতিস্‌ হেথা হোথা পথ গিয়া ভুলি!


সুধাময়ী বীণাখানি লোয়ে কোল-পরে
     সমুচ্চ হিমাদ্রিশিরে বসি শিলাসনে
বীণার ঝঙ্কার দিয়া মধুময় স্বরে
     গাহিতিস্‌ কত গান আপনার মনে!


হরিণেরা বন হোতে শুনিয়া সে স্বর
     শিখরে আসিত ছুটি তৃণাহার ভুলি!
শুনিত,ঘিরিয়া বসি ঘাসের উপর
     বড় বড় আঁখিদুটি মুখ-পানে তুলি!


সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম বনে
     চিতার অনলে আজ হবে তোর শেষ?
সুখের যৌবন হায় পোড়াবি আগুনে?
     সুকুমার দেহ হবে ভস্ম-অবশেষ!


না, না, না, সরলা বালা, ফিরে যাই চল্‌
     এসেছিলি যেথা হোতে সেই সে কুটীরে!
আবার ফুলের গাছে ঢালিবি লো জল!
     আবার ছুটিবি গিয়ে পর্ব্বতের শিরে!


পৃথিবীর যাহা কিছু ভুলে যা লো সব,
     নিরাশযন্ত্রণাময় পৃথ্বীর প্রণয়!
নিদারুণ সংসারে ঘোর কলরব,
     নিদারুণ সংসারের জ্বালা বিষ্ময়।


তুই স্বরগের পাখী পৃথিবীতে কেন!
     সংসারকণ্টকবনে পারিজাত ফুল!
নন্দনের বনে গিয়া গাইবি খুলিয়া হিয়া,
     নন্দনমলয়বায়ু করিবি আকুল।


আয় তবে ফিরে যাই বিজন শিখরে—
     নির্ঝর ঢালিছে যেথা স্ফটিকের জল,
তটিনী বহিছে যথা কলকলস্বরে,
     সুবাস নিশ্বাস ফেলে বনফুলদল!


বন-ফুল ফুটেছিলি ছায়াময় বনে,
     শুকাইলি মানবের নিশ্বাসের বায়ে!
দয়াবয়ী বনদেবী শিশিরসেচনে
     আবার জীবন তোরে দিবেন ফিরায়ে।


এখনো কমলা ওই রয়েছে দাঁড়িয়ে
     জ্বলন্ত চিতার পরে মেলিয়ে নয়ন!
ওই রে সহসা ওই মূর্চ্ছিয়ে পড়িয়ে
     ভসেমর শয্যার পরে করিল শয়ন!


এলায়ে পড়িল ভসেম সুনিবিড় কেশ!
     অঞ্চলবসন ভসেম পড়িল এলায়ে!
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আলুথালু বেশ
     কমলার বক্ষ হোতে, শ্মশানের বায়ে!


নিবে গেল ধীরে ধীরে চিতার অনল!
     এখনো কমলা বালা মূর্চ্ছায় মগন!
শুকতারা উজলিল গগনের তল,
     এখনো কমলা বালা স্তব্ধ অচেতন!


ওই রে কুমারী উষা বিলোল চরণে
উঁকি মারি পূর্ব্বাশার সুবর্ণ তোরণে
রক্তিম অধরখানি হাসিতে ছাইয়া
সিঁদুর প্রকৃতিভালে দিল পরাইয়া।


এখনো কমলা বালা ঘোর অচেতন,
কমলা-কপোল চুমে অরুণকিরণ!
গণিছে কুন্তলগুলি প্রভাতের বায়,
চরণে তটিনী বালা তরঙ্গ দুলায়!


কপোলে, আঁখির পাতে পড়েছে শিশির!
নিস্তেজ সুবর্ণকরে পিতেছে মিহির!
শিথিল অঞ্চলখানি লোয়ে ঊর্ম্মিমালা
কত কি— কত কি কোরে করিতেছে খেলা!


ক্রমশঃ বালিকা ওই পাইছে চেতন!
ক্রমশঃ বালিকা ওই মেলিছে নয়ন!
বক্ষোদেশ আবরিয়া অঞ্চলবসনে
নেহারিল চারি দিক বিস্মিত নয়নে।


ভস্মরাশিসমাকুল শ্মশানপ্রদেশ!
     মলিনা কমলা ছাড়া যেদিকে নেহারি
বিশাল শ্মশানে নাই সৌন্দর্য্যের লেশ,
     জন প্রাণী নাই আর কমলারে ছাড়ি!


সূর্য্যকর পড়িয়াছে শুষ্কমলানপ্রায়,
ভস্মমাখা ছুটিতেছে প্রভাতের বায়!
কোথাও নাই রে যেন আঁখির বিশ্রাম,
তটিনী ঢালিছে কাণে বিষাদের গান!


বালিকা কমলা ক্রমে করিল উত্থান
ফিরাইল চারি দিকে নিস্তেজ নয়ান।
শ্মশানের-ভস্ম-মাখা অঞ্চল তুলিয়া
যেদিকে চরণ চলে যাইল চলিয়া!


   (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)