শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক


এতবড়ো এ ধরণী মহাসিন্ধু-ঘেরা
        দুলিতেছে আকাশসাগরে —
দিন - দুই হেথা রহি মোরা মানবেরা
        শুধু কি, মা, যাব খেলা করে ।
তাই কি ধাইছে গঙ্গা ছাড়ি হিমগিরি ,
        অরণ্য বহিছে ফুল-ফল —
শত কোটি রবি তারা আমাদের ঘিরি
        গণিতেছে প্রতি দণ্ড পল !
  
  
শুধু কি , মা , হাসিখেলা প্রতি দিন রাত
        দিবসের প্রত্যেক প্রহর !
প্রভাতের পরে আসি নূতন প্রভাত
        লিখিছে কি একই অক্ষর !
কানাকানি হাসাহাসি কোণেতে গুটায়ে ,
        অলস নয়ননিমীলন ,
দণ্ড - দুই ধরণীর ধূলিতে লুটায়ে
         ধূলি হয়ে ধূলিতে শয়ন !
  
  
নাই কি , মা , মানবের গভীর ভাবনা ,
        হৃদয়ের সীমাহীন আশা !
জেগে নাই অন্তরেতে অনন্ত চেতনা ,
        জীবনের অনন্ত পিপাসা !
হৃদয়েতে শুষ্ক কি , মা , উৎস করুণার ,
        শুনি না কি দুখীর ক্রন্দন !
জগৎ শুধু কি , মা গো , তোমার আমার
        ঘুমাবার কুসুম - আসন !
শুনো না কাহারা ওই করে কানাকানি
        অতি তুচ্ছ ছোটো ছোটো কথা ।
পরের হৃদয় লয়ে করে টানাটানি ,
        শকুনির মতো নির্মমতা।
শুনো না করিছে কারা কথা - কাটাকাটি
        মাতিয়া জ্ঞানের অভিমানে ,
রসনায় রসনায় ঘোর লাঠালাঠি ,
        আপনার বুদ্ধিরে বাখানে ।
  
  
তুমি এস দূরে এস , পবিত্র নিভৃতে ,
        ক্ষুদ্র অভিমান যাও ভুলি ।
সযতনে ঝেড়ে ফেলো বসন হইতে
        প্রতি নিমেষের যত ধূলি !
নিমেষের ক্ষুদ্র কথা ক্ষুদ্র রেণুজাল
        আচ্ছন্ন করিছে মানবেরে ,
উদার অনন্ত তাই হতেছে আড়াল
        তিল তিল ক্ষুদ্রতার ঘেরে ।
  
  
আছে মা , তোমার মুখে স্বর্গের কিরণ ,
        হৃদয়েতে উষার আভাস ,
খুঁজিছে সরল পথ ব্যাকুল নয়ন —
        চারি দিকে মর্ত্যের প্রবাস ।
আপনার ছায়া ফেলি আমরা সকলে
        পথ তোর অন্ধকারে ঢাকি —
ক্ষুদ্র কথা , ক্ষুদ্র কাজে , ক্ষুদ্র শত ছলে ,
        কেন তোরে ভুলাইয়া রাখি ।
  
  
কেন , মা , তোমারে কেহ চাহে না জানাতে
        মানবের উচ্চ কুলশীল —
অনন্তজগৎ - ব্যাপী ঈশ্বরের সাথে
        তোমার যে সুগভীর মিল ।
কেন কেহ দেখায় না — চারি দিকে তব
        ঈশ্বরের বাহুর বিস্তার !
ঘেরি তোরে , ভোগসুখ ঢালি নব নব
        গৃহ বলি রচে কারাগার ।
  
  
অনন্তের মাঝখানে দাঁড়াও , মা আসি ,
        চেয়ে দেখো আকাশের পানে —
পড়ুক বিমলবিভা পূর্ণ রূপরাশি
        স্বর্গমুখী কমলনয়ানে ।
আনন্দে ফুটিয়া ওঠো শুভ্র সূর্যোদয়ে
        প্রভাতের কুসুমের মতো ,
দাঁড়াও সায়াহ্নমাঝে পবিত্র হৃদয়ে
        মাথাখানি করিয়া আনত ।
  
  
শোনো শোনো উঠিতেছে সুগম্ভীর বাণী ,
        ধ্বনিতেছে আকাশ পাতাল !
বিশ্ব - চরাচর গাহে কাহারে বাখানি
        আদিহীন অন্তহীন কাল !
যাত্রী সবে ছুটিয়াছে শূন্যপথ দিয়া ,
        উঠেছে সংগীতকোলাহল ,
ওই নিখিলের সাথে কণ্ঠ মিলাইয়া
        মা , আমরা যাত্রা করি চল্ ।
  
  
যাত্রা করি বৃথা যত অহংকার হতে ,
         যাত্রা করি ছাড়ি হিংসাদ্বেষ ,
যাত্রা করি স্বর্গময়ী করুণার পথে ,
        শিরে ধরি সত্যের আদেশ ।
যাত্রা করি মানবের হৃদয়ের মাঝে
        প্রাণে লয়ে প্রেমের আলোক ,
আয় , মা গো , যাত্রা করি জগতের কাজে
        তুচ্ছ করি নিজ দুঃখশোক ।
  
  
জেনো , মা , এ সুখে - দুঃখে - আকুল সংসারে
        মেটে না সকল তুচ্ছ আশ —
তা বলিয়া অভিমানে অনন্ত তাঁহারে
        কোরো না , কোরো না অবিশ্বাস ।
সুখ ব ' লে যাহা চাই সুখ তাহা নয় ,
        কী যে চাই জানি না আপনি —
আঁধারে জ্বলিছে ওই ওরে কোরো ভয় ,
        ভুজঙ্গের মাথার ও মণি ।
  
  
ক্ষুদ্র সুখ ভেঙে যায় না সহে নিশ্বাস ,
        ভাঙে বালুকার খেলাঘর —
ভেঙে গিয়ে বলে দেয় এ নহে আবাস ,
        জীবনের এ নহে নির্ভর ।
সকলে শিশুর মতো কত আবদার
        আনিছে তাঁহার সন্নিধান —
পূর্ণ যদি নাহি হল , অমনি তাহার
        ঈশ্বরে করিছে অপমান !
  
  
কিছুই চাব না , মা গো , আপনার তরে ,
        পেয়েছে যা শুধিব সে ঋণ —
পেয়েছি যে প্রেমসুধা হৃদয় - ভিতরে ,
        ঢালিয়া তা দিব নিশিদিন ।
সুখ শুধু পাওয়া যায় সুখ না চাহিলে ,
        প্রেম দিলে প্রেমে পুরে প্রাণ ,
নিশিদিশি আপনার ক্রন্দন গাহিলে
        ক্রন্দনের নাহি অবসান ।
  
  
মধুপাত্রে হতপ্রাণ পিপীলির মতো
        ভোগসুখে জীর্ণ হয়ে থাকা ,
ঝুলে থাকা বাদুড়ের মতো শির নত
        আঁকড়িয়া সংসারের শাখা ,
জগতের হিসাবেতে শূন্য হয়ে হায়
        আপনারে আপনি ভক্ষণ ,
ফুলে উঠে ফেটে যাওয়া জলবিম্ব প্রায় —
        এই কি রে সুখের লক্ষণ ।
  
  
এই অহিফেনসুখ কে চায় ইহাকে !
        মানবত্ব এ নয় এ নয় ।
রাহুর মতন সুখ গ্রাস করে রাখে
        মানবের মানবহৃদয় ।
মানবেরে বল দেয় সহস্র বিপদ ,
        প্রাণ দেয় সহস্র ভাবনা ,
দারিদ্র্যে খুঁজিয়া পাই মনের সম্পদ ,
        শোকে পাই অনন্ত সান্ত্বনা ।
  
  
চিরদিবসের সুখ রয়েছে গোপন
        আপনার আত্মার মাঝার ।
চারি দিকে সুখ খুঁজে শ্রান্ত প্রাণমন —
        হেথা আছে , কোথা নেই আর ।
বাহিরের সুখ সে , সুখের মরীচিকা —
        বাহিরেতে নিয়ে যায় ছ ' লে ,
যখন মিলায়ে যায় মায়াকুহেলিকা
        কেন কাঁদি সুখ নেই ব ' লে ।
দাঁড়াও সে অন্তরের শান্তিনিকেতনে
        চিরজ্যোতি চিরছায়াময় —
ঝড়হীন রৌদ্রহীন নিভৃত সদনে
        জীবনের অনন্ত আলয় ।
পুণ্যজ্যোতি মুখে লয়ে পুণ্য হাসিখানি ,
        অন্নপূর্ণা জননী - সমান ,
মহাসুখে সুখ দুঃখ কিছু নাহি মানি
        কর সবে সুখশান্তি দান ।
  
  
মা , আমার এই জেনো হৃদয়ের সাধ
        তুমি হও লক্ষ্মীর প্রতিমা —
মানবেরে জ্যোতি দাও , করো আশীর্বাদ ,
         অকলঙ্ক মূর্তি মধুরিমা ।
কাছে থেকে এত কথা বলা নাহি হয় ,
        হেসে খেলে দিন যায় কেটে ,
দূরে ভয় হয় পাছে না পাই সময় ,
        বলিবার সাধ নাহি মেটে ।
  
  
কত কথা বলিবারে চাহি প্রাণপণে,
        কিছুতে, মা, বলিতে না পারি —
স্নেহমুখখানি তোর পড়ে মোর মনে ,
        নয়নে উথলে অশ্রুবারি ।
সুন্দর মুখেতে তোর মগ্ন আছে ঘুমে
        একখানি পবিত্র জীবন;
ফলুক সুন্দর ফল সুন্দর কুসুমে
        আশীর্বাদ করো , মা , গ্রহণ ।



শ্রীমতী ইন্দিরা।   প্রাণাধিকাসু । নাসিক
চারি দিকে তর্ক উঠে সাঙ্গ নাহি হয় ,
        কথায় কথায় বাড়ে কথা ।
সংশয়ের উপরেতে চাপিছে সংশয় ,
        কেবলি বাড়িছে ব্যাকুলতা ।
ফেনার উপরে ফেনা , ঢেউ -' পরে ঢেউ ,
        গরজনে বধির শ্রবণ —
তীর কোন্ দিকে আছে নাহি জানে কেউ ,
        হা হা করে আকুল পবন ।
  
  
এই কল্লোলের মাঝে নিয়ে এস কেহ
        পরিপূর্ণ একটি জীবন ,
নীরবে মিটিয়া যাবে সকল সন্দেহ ,
        থেমে যাবে সহস্র বচন ।
তোমার চরণে আসি মাগিবে মরণ
        লক্ষ্যহারা শত শত মত ,
যে দিকে ফিরাবে তুমি দুখানি নয়ন
        সে দিকে হেরিবে সবে পথ ।
  
  
অন্ধকার নাহি যায় বিবাদ করিলে ,
        মানে না বাহুর আক্রমণ ।
একটি আলোকশিখা সমুখে ধরিলে
        নীরবে করে সে পলায়ন ।
এস মা , উষার আলো , অকলঙ্ক প্রাণ ,
        দাঁড়াও এ সংসার - আঁধারে ।
জাগাও জাগ্রত হৃদে আনন্দের গান ,
        কূল দাও নিদ্রার পাথারে ।
চারি দিকে নৃশংসতা করে হানাহানি ,
        মানবের পাষাণ পরান ।
শাণিত ছুরির মতো বিঁধাইয়া বাণী ,
        হৃদয়ের রক্ত করে পান ।
তৃষিত কাতর প্রাণী মাগিতেছে জল ,
        উল্কাধারা করিছে বর্ষণ —
শ্যামল আশার ক্ষেত্র করিয়া বিফল
        স্বার্থ দিয়ে করিছে কর্ষণ ।
  
  
শুধু এসে একবার দাঁড়াও কাতরে
        মেলি দুটি সকরুণ চোখ ,
পড়ুক দু - ফোঁটা অশ্রু জগতের'পরে
        যেন দুটি বাল্মীকীর শ্লোক ।
ব্যথিত করুক স্নান তোমার নয়নে ,
        করুণার অমৃতনির্ঝরে ,
তোমারে কাতর হেরি মানবের মনে
        দয়া হবে মানবের'পরে ।
  
  
সমুদয় মানবের সৌন্দর্যে ডুবিয়া
         হও তুমি অক্ষয় সুন্দর ।
ক্ষুদ্র রূপ কোথা যায় বাতাসে উবিয়া
        দুই - চারি পলকের পর ।
তোমার সৌন্দর্যে হোক মানব সুন্দর ;
        প্রেমে তব বিশ্ব হোক আলো ।
তোমারে হেরিয়া যেন মুগুধ - অন্তর
        মানুষে মানুষ বাসে ভালো ।



শ্রীমতী ইন্দিরা ।   প্রাণাধিকাসু । নাসিক ।
আমার এ গান , মা গো , শুধু কি নিমেষে
মিলাইবে হৃদয়ের কাছাকাছি এসে ?
          আমার প্রাণের কথা
          নিদ্রাহীন আকুলতা
  শুধু নিশ্বাসের মতো যাবে কি , মা , ভেসে !
  
  
এ গান তোমারে সদা ঘিরে যেন রাখে ,
সত্যের পথের'পরে নাম ধরে ডাকে ।
          সংসারের সুখে দুখে
          চেয়ে থাকে তোর মুখে ,
চির - আশীর্বাদ - সম কাছে কাছে থাকে ।
  
  
বিজনে সঙ্গীর মতো করে যেন বাস ,
অনুক্ষণ শোনে তোর হৃদয়ের আশ ।
          পড়িয়া সংসারঘোরে
          কাঁদিয়া হেরিলে তোরে
ভাগ করে নেয় যেন দুখের নিশ্বাস ।
  
  
সংসারের প্রলোভন যবে আসি হানে
মধুমাখা বিষবাণী দুর্বল পরানে ,
          এ গান আপন সুরে
          মন তোর রাখে পুরে ,
ইষ্টমন্ত্রসম সদা বাজে তোর কানে ।
আমার এ গান যেন সুদীর্ঘ জীবন
তোমার বসন হয় , তোমার ভূষণ ।
          পৃথিবীর ধূলিজাল
          করে দেয় অন্তরাল ,
তোমারে করিয়া রাখে সুন্দর শোভন ।
  
  
আমার এ গান যেন নাহি মানে মানা ,
উদার বাতাস হয়ে এলাইয়া ডানা
          সৌরভের মতো তোরে
          নিয়ে যায় চুরি করে —
খুঁজিয়া দেখাতে যায় স্বর্গের সীমানা ।
  
  
এ গান যেন রে হয় তোর ধ্রুবতারা ,
অন্ধকারে অনিমিষে নিশি করে সারা ।
          তোমার মুখের'পরে
          জেগে থাকে স্নেহভরে
অকূলে নয়ন মেলি দেখায় কিনারা ।
  
  
আমার এ গান যেন পশি তোর কানে
মিলায়ে মিশায়ে যায় সমস্ত পরানে ।
          তপ্ত শোণিতের মতো
          বহে শিরে অবিরত ,
আনন্দে নাচিয়া উঠে মহত্ত্বের গানে ।
  
  
এ গান বাঁচিয়া থাকে যেন তোর মাঝে ,
আঁখিতারা হয়ে তোর আঁখিতে বিরাজে ।
          এ যেন রে করে দান
          সতত নূতন প্রাণ ,
এ যেন জীবন পায় জীবনের কাজে ।
  
  
যদি যাই , মৃত্যু যদি নিয়ে যায় ডাকি ,
এই গানে রেখে যাব মোর স্নেহ - আঁখি ।
          যবে হায় সব গান
          হয়ে যাবে অবসান
এ গানের মাঝে আমি যেন বেঁচে থাকি ।


(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)