সাহিত্য জীবনের কথা বলে। জীবন স্রোতেল করতে লাগে জ্ঞান আর নির্মল আনন্দ। এ আনন্দ অর্জনের অন্যতম মাধ্যম সাহিত্য। নানা শাখার সাহিত্য নদী। কবিতাকে এর প্রধানশাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সৃষ্টিশীল মানুষ কবিতা নিয়ে সাধনা করতে করতে তাঁদের কেউ কেউ এক একটি ধারা সৃষ্টি করেন। তৈরি হয় সতন্ত্র বৈশিষ্টের সতন্ত্র উপশাখা। যেমন সনেট, লিমেরিক, ব্যালাড, তানকা, হাইকু, রুবাই ইত্যাদি। তেমনি একটি উপশাখা ক্লেরিহিউ (Clerihew) । এটি ইরেজি সাহিত্যের অবদান। লন্ডনে জন্ম নেয়া ইংরেজ কবি ও উপন্যাসিক এডমান্ড ক্লেরিহিউ বেন্টলি (Edmund Clerihew Bentley (1875-1956) এর উদ্ভাবক। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে তিনি এ ধারার কাব্য রচনা করনে।
অক্সফোর্ড এডভান্সড লারনারর্স ডিকশনারিতে ক্লেরিহিউ সম্পের্ক বলা আছে, “ A light verse form, usually consisting of two couplets, with lines of uneven length and irregular meter, the first line usually containing the name of a well-known person.’’

উইকিপিডিয়াতে  ক্লেরিহিউর আরেকটু বিস্তারিত পরিচিতি রয়েছে, “ A clerihew is a whimsical, four-line biographical poem invented by Edmund Clerihew Bentley. The first line is the name of the poem's subject, usually a famous person put in an absurd light, or revealing something unknown or spurious about them. The rhyme scheme is AABB, and the rhymes are often forced. The line length and metre are irregular. Bentley invented the clerihew in school and then popularized it in books.”


উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে আমরা বলতে পারি, " ক্লেরিহিউ হচ্ছে চার চরণের কৌতুক ধর্মী হালকা চলের জীবনী নির্ভর কবিতা বা ছড়া যা সাধারণতঃ কোন প্রসিদ্ধ ব্যাক্তির নাম এবং তার জীবনের কিছু অংশ বা অজানা ও অদ্ভুত কিছু তথ্য প্রকাশ করে। এর প্রতি জোড়া চরণে একই ধরণের অন্ত্যানুপ্রাস থাকে। মিল বিন্যাস ককখখ। এর চরণ দৈর্ঘ্য এবং মাত্রা সংখ্যা সুনির্ধারিত থাকে না।" এডমন্ড ক্লেরিহিউ বেন্টলি মোট তিনটি ক্লেরিহিউ গ্রন্হ রচনা করেন। এগুলো হচ্ছে Biography for Beginners (1905), More Biography (1929);  Baseless Biography (1939)। নিচে বেন্টলি রচিত তিনিটি মজার ক্লেরিহিউ দেয়া হলো।


Sir Humphrey Davy
Abominated gravy.
He lived in the odium
Of having discovered sodium.



George the Third
Ought never to have occurred.
One can only wonder
At so grotesque a blunder.



The Art of Biography
Is different from Geography.
Geography is about Maps,
But Biography is about Chaps.


বাংলা ভাষায় শ্রীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর রায় সর্বপ্রথম ক্লেরিহিউ রচনা করেন বলে জানা যায়। তাঁর মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত একটি অনন্য ক্লেরিহিউ নিম্নে উদ্ধৃত হলো।


মিস্‌টার জাসটিস সেন
রায় যত উলটিয়ে দেন
ছোট ছোট জজ তাই দেখে
রায় ছেড়ে ক্লেরিহিউ লেখে।


রায় মহাশয়রে ছড়া গ্রন্থ পড়া থেকেই ক্লরিহিউ সম্পর্কে এ প্রাবন্ধিক এর আগ্রহ তৈরী হয়। কিছু লিখাও হয়, যা তেলসমাতি (২০০৪) গ্রন্থে প্রকাশ হয়। এর মধ্যথেকে দুটি নিম্নরূপ:
             ১
       সুকুমার রায়
       রাত একটায়
       বসে বসে পড়ি
       আর হেসে মরি!


             ২
      সুকুমার বড়ুয়া
      নন তিনি নড়ুয়া
     ছড়া লিখে রসালো
     পেয়েছেন যশ-আলো ।


ক্লেরিহিউর বৈশিষ্ট: উপরের আলোচনা এবং উদ্ধৃত ক্লেরিহিউগুলো থেকে আমরা এর রূপ, রস সমন্ধে একটা প্রাথমিক ধারণা পেলাম। সাধারণ চিন্তায় কেউ হয়তো বলতে পারে চার লাইনের ককখখ মিলের কবিতা, এ আর নতুন কি? না, চার লাইনের বর্ণিত মিলের সব কবিতাই ক্লেরেহিউ নয়। অনুসন্ধানী  দৃষ্টিতে দেখলে ব্যপারটা মোটেও সহজ নয়। মাত্র চার লাইনে সহজ কথায় একজন মানুষের বা সংঘের জীবনালেখ্য  তোলে আনা তাও আবার কৌতুক রসে সিক্ত করে বলা একী কম কথা! আর এটিই একে অনান্য কবিতা থেকে বিশিষ্টতা দান করেছে। এবার এর আরো কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেমন :


ক) এটি অন্ত্যমিলযুক্ত চার লাইনো অনুকাব্য যাকে অনেক গবেষক ছড়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।


খ) এর ১ম ও ২য় লাইনে এক ধরণের মিল কক, ৩য় ও ৪র্থ অন্য রকম মিল খখ থাকবে।


গ) লাইনের দৈর্ঘ ও মাত্রা সংখ্যা অনিয়মিত।বাংলায় ভাল ক্লেরিহিউ লিখতে হলে ছন্দ মেনে পর্ব হ্রাস বৃদ্ধি কিংবা উপপর্ব, অতিপর্ব যুক্ত বিযুক্ত করে করা যায়।


ঘ) প্রথম লাইনে কবিতার বিষয় হিসেবে কোন বিখ্যাত ব্যাক্তি, সংঘঠন, কিংবা যাদেরকে শুনানো হবে তাদের কোরো নাম থাকবে।


ঙ) পরবর্তী তিন লাইনে বর্ণিত ব্যক্তির জীবনের কোন অংশে আলো ফেলে মজা-কৌতুকের মাধ্যমে রসঘন ভাবে সমাপ্তি টানতে হবে।


চ) প্রকৃত ক্লরিহিউ  হচ্ছে সেগুলো যা র প্রথম চরণের শেষে নাম থাকে।


ছ) ক্লরিহিউতে মজা বা কৌতুক করা যায়। কিন্তু মিথ্যে আরোপ, গালাগাল, দোষারোপ বা হেয় করা যায় না। বরং ধারণা করি একজন মানুষকে ক্লেরিহিউতে স্হান দেয়ার অর্থ তাকে বিখ্যাত বা বিশেষ বলে ধরে নেয়া। ক্লরিহিউতে শিরোনাম থাকে।


দেখুনতো নিচের কবিতাগুলোতে বর্ণিত বৈশিষ্টের কিছু খুঁজে পান কিনা। পেলে জানাবেন কিন্তু।


১০.৫.২০১৮ তারিখে লিখা রহমান মুজিবের দশটি ক্লেরিহিউ



জীবনানন্দ দাস
প্রকৃতি থেকে তুলে নিয়েছেন কবিতার নির্যাস
রূপসী বাংলা দেখেছেন
কলম তুলিতে এঁকেছেন।



আল মাহমুদ
বলেছেন ক্ষুদ
কবির কপালে থাকে দুঃখ
কবি হতে সাধনাটা মুখ্য।



সাকিব আল হাসান
ব্যাট বল হাতে পেলে পাবলিক নাচান।
গ্যালারিতে ভেসে উঠে চার ছয় ছবি
বাংলার এই বীর ক্রিকেটের কবি।



বলুন সমীর প্রামাণিক
কাব্য লিখে পেলেনটা কী? তা মানিক?
কাব্য করে জীবন যাবে আশার গুড়ে বালি
কবির ভাগ্যে জুটতে দেখি হাততালি আর গালি!



কবি রণজিৎ মাইতি
কলম করুন গাঁইতি
এই কলমে শান দিন
অসূর মুলে টান দিন।



জসীম উদ্দিন বোদ্ধা কবি
খাঁটি কলমযোদ্ধা কবি।
এই অধমের বোধ নাই
তাঁর কবিতা পড়ি, যদি বোধ পাই।



অনিরুদ্ধ বুলবুল
কবিতার দুলদুল
ঘোড়াতে ছুটছেন
পাঠকেরা পড়ে মধু লুটছেন।



বিহারিলাল
এসেছিলেন কাল
দেননি কাব্য শিক্ষা
হাত পেতে চান ভিক্ষা!



কবি তমাল ব্যানার্জি
এই বয়সে রাখেন কতো এনার্জি!
পারেন কাব্য গড়তে
তাঁকে রেখে ইচ্ছে করে পঞ্চকবি পড়তে।


১০
সঞ্জয় কর্মকার
নাই কাজ কর্ম তাঁর!
ফেলে রেখে ক্যামুমিলা
কবিতায় করে লীলা!


         একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় অর্থের গভীরতা এতে হয়তো অতটা নাই । দারুণ এক মজা আছে। সহজাত সারল্যে এ মজা উপভোগ্য।  আসুন এ মজায় মত্ত হই।


যশোর
১০/৫/২০১৮
তথ্যসূত্র : ক) আধুনিক বাংলা ছন্দ: নীলরতন সেন।
            খ) অন্তরজাল।