‘আমি যাকে আনতে গেলাম
                তাকে দেখেই ফিরে এলাম
                সে যখন চলে গেল
               তাকেই আবার আনতে গেলাম’।


এটি একটি লোকজ ধাঁধা। মনে এলো ‘আছে, তবু নেই’ শিরোনামটি দেখেই। পড়লাম কবি শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্যের কবিতাটি। না, এটি ধাঁধা নয়; একটা সমাজের চালচিত্র তুলে আনার কৌশলী উপস্হাপন।প্রিয় পাঠক ধাঁধার জবাব আপনারা দেবেন । আগে চলুন  ‘আছে, তবু নেই’ কবিতায় কবির রাডারে কী ধরা পড়েছে দেখে আসি। তিনি কি আছে আর কি নাই বলতে চেয়েছেন। কবি বলেছেন–


“হাত আছে।/ কাজ আছে।/ ভাত আছে”।


সাদামাটা কথা। কবি এমন একটা সমাজ দেখেন, যেখানে কাজ করতে পারলে ভাতের অভাব হয় না। এবার বাংলার লোকজ প্রবচন, “হাত থাকলে ভাতের অভাব হয় না” এর আশ্রয় নিয়ে বলতে পারি, এ আর এমন কি! এতো অগেই জানা। কিন্তু কবি যখন উপরের বক্তব্য চাঁদের এক পিঠে রেখে–তবু, দিয়ে অপর পিঠ দেখিয়ে দেন, তখনি আমাদের নব্বই ডিগ্রি ঘুরে শিরদাড়া খাড়া করে দাঁড়াতে হয়। যেমন


“তবু,
চোখ চেয়ে থাকে বিষণ্নতার পানে
কান শোনে বাঁশির করুন সুর
…প্রদীপের শেষ আলো কবে শেষ হয়ে গেছে
…খবরের কাগজের পাতায় লেখা সন্ধান চাই;
সফলতা আজ নিরুদ্দেশ!”


এবার বুঝুন ঠেলা! কাজ করতে পারছে, পেটভরে খেতে পারছে তবু তাঁর চোখ সুখ দেখতে পারছে না, অনুভূতিপ্রবণ নানান অঙ্গ কোরাস করে জানিয়ে দিচ্ছে, নাই শান্তি নাই।হারিয়ে গেছে সফলতা । হাজার বিজ্ঞপ্তিতেও সে নিরুদ্দেশ। কি কাণ্ড! ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’ যাকে বলে!


কেন নেই, কি কি নেই, কি কি থাকলে সফল হওয়া যেত তার ফিরিস্তি কবি দেন নি। পাঠকের অনুভূতিকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছেন। পাঠক নিজের জীবন তথা আশেপাশের জীবনগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখুক কতটা সফল এখন জীবন।


স্হান কাল পাত্র কবিতা বুঝবার জন্য বেশ কাজে লাগে। গ্রাম কিংবা তৃতীয়বিশ্ব থেকে যথাক্রমে শহর ও  উন্নতবিশ্বে শ্রমের মূল্য বেশি। বাহ্যিক জীবনমানও উন্নত। তথাপি স্হানান্তরের ফলে পেট স্ফিত হলেও দেখা দেয় সাংস্কৃতিক সংঘাত।নিম্ন আয়ের শ্রমিক, অভিবাসী জনতা, প্রবাসী শ্রমিকদের অবস্হা, বাস্তুচ্যুত মানুষ, স্হানীয় ও অন্তর্জাতিক রাজনীতির হালচাল, পুঁজিবাদ, ধনি গরীবের ব্যবধান-দৃষ্টিভঙ্গি এসব সামনে এনে বিচারে গেলে কবির এ কবিতা বৈশ্বিক সমস্যবলীর দিকে অঙুলী নির্দেশ করে।


কবির অনুভূতি তীক্ষ্ণ। তিনি সমস্ত সত্তা দিয়ে দেখেন, বলদর্পীদের বগলের নীচ থেকে বেরিয়ে স্বাধীন অস্তিত্বে দাঁড়াতে গেলেই সাধারণকে অধিকার হারাতে হয়। নেমে আসে নিবর্তন।জীবনমান উন্নতির নামে বন্ধক রাখতে হয় বাকস্বধীনতা সহ রীতিসিদ্ধ নানান অধিকার। ভয়, বিভাজন, অবিশ্বাস রাজ করে সমাজে।গ্রাস-মুখে সয়ে যেতে হয় ঠোকর। তাই কবির এমন ক্ষরণ । এ ক্ষরণ এসে সংক্রমিত হয় আমাদেরও মনে।  ভাবতে শিখায়, অর্থনেতিক উন্নয়নই মানুষের সফলতার একমাত্র মাপকাঠি নয়। আরো কিছু চাই।


কবির সচল অনুভূতি আমাদের যেমনতর জীবন দেখালেন, তেমন জীবন কি সফল? জাগ্রত বিবেক বলবে, মোটেও নয়। চাই মানবিক মুক্তি। ভয়হীন, বৈষম্যহীন স্বভাবিক জীবন।


এভাবে বুঝে নিয়েই আনন্দ পেতে চাই। মনন বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাক কষ্টাগ্নির দাপট। চমৎকার বোধ, মিতবাক, কৌশলী উপস্হাপনের এ কবিতাটির জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।