“ও ছকিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে
এখন আমি রিকশা চালাই ঢাহা শহরে”


এ জনপ্রিয় বাংলা গানটা মনে পড়লো কবি ও ছড়াকার ডি. হুসাইন এর ‘রোড নাম্বার চার’ ছড়াটি পাঠ করতে করতে। না, এছড়ায় কোনো নারী প্রসঙ্গ নাই। এখানে সহজ সরল ছান্দিক ব্যাঞ্জনায় টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দে শ্রমখাঁটা এক রিকশাওয়ালার চুপচাপ জীবনের খণ্ডচিত্র চিত্রিত করেছেন ছড়াকার। অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে বাস্তব কিছু চিত্র। এ বক্তব্য সামনে নিয়ে আমরা দু-চার কথা বলার প্রয়াস পাব।


একটি রচনার শুরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।সূচনাই গোটা রচনার চালক। ছড়ার ক্ষেত্রে এটিকে আমরা বলতে পারি রেলের ইঞ্জিন। ঝিকঝিক ঝিকঝিক করে টেনে নিয়ে চলে কামরাগুলো। এ ছড়াতেও এমনটি হয়েছে। যেমন:


“ছাতা মাথায় /দাঁড়িয়ে ছিলাম/ তিন রাস্তার/ মোড়ে
বৃষ্টি মাথায়/ চালক মামায়/ যাচ্ছিল খুব/ জোরে”।


এভাবেই ছড়া গল্পরে শুরু। নায়ক রিকশা চালক এলো। কিভাবে এলো- বৃষ্টি মাথায়, রিকশা চালাচ্ছিল কিভাবে - জোরে। যাত্রির মাথায় কি ছিল- ছাতা। এই যে পর্যবেক্ষণশক্তি, নাটকীয় ভঙ্গি এটিই ইঞ্জিন হয়ে ঘটনাকে টানলো । সাথে পাঠককেও। অতঃপর শেখের টেক চার নাম্বারের মাথায় চালক যাবে কিনা, ভাড়া কতো নেবে ইত্যাদি নিয়ে যাত্রি এবং চালকের মধ্যে নানান কথোপকথন হলো। কিন্তু  ছড়াকার যখন চালকের মুখ থেকে-


“রিকশা চালাই/ ভাতের লাগি /যামু না কেন/ ছার
যাওন ছাড়া/ উপায় তো নাই/ আছে মেলান /ধার!”


এমন উক্তি বের করে আনেন তখন রিকশা চালকের চলমান জীবন যে তার রিকশার মতো বেগে চলছে না,তা দিবলোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেননা খাটনি খেটেও তাকে প্রচুর কর্জ করে চলতে হয়। আবার চালক বনাম যাত্রির মাঝে নিম্নের কথাগুলো যখন চালাচালি হয়,


“দেড়শো টাকার/ কম যামু না /বৃষ্টি দিনে/ ছার
রোডডা আমার/ চেনাই আছে / গেছি হুক্র/বার।
চালক মামার/ ভাড়ার রেটে/ হলাম আমি/ অবাক
কি কও মামা;/একশো টাকায় /যায় তো দেখি /বেবাক”।


তখন বৃষ্টির কারণে রক্ত-মাংসের চালকদের দুপয়সা বাড়তি রোজগারের প্রবণতা, আর যাত্রিদের আতকে উঠা তাও চমৎকার ভাবে চলে আসে। সমাজ বাস্তবতার এ দিকটা ছড়াকার নির্মূহ দৃষ্টিতে দেখাতে পেরেছেন।কোনো পক্ষপাত ছাড়াই। এটি ছড়াকারের মুনশিয়ানা।


আবার ‘পাঠাও’ ‘উবার’ ভাড়ায় খাটা এসব মোটর যান চালু হওয়ায় রিকশা চালকদের পেশাগত চাহিদা কমে যাবার বিষয়টিও নিম্নরে উক্তিতে প্রকাশিত।যেমন-


“দুখের কথা /কি কমু ছার/ পাঠাও উবার /এসে
রিকশা চালক/ আমরা হকল /গেছি পথে/ বসে”!


          এখানে পেশাগত দ্বন্দ্বটাও ছড়াকারের দৃষ্টি এড়ায়নি।


ছড়ার শেষটা চমৎকার। ভাড়া নির্ধারিত হলো কি-না, গন্তব্যে যাওয়া হলো কিনা এসব কিছুই ছড়াতে নাই। বরং মানবিক আবেদনে তুলেছেন জনতার বিবেকের কাছে প্রশ্ন-


“সবাই চড়ে/মোটর কারে/ ভাড়াও নাকি/ কম
আমরা তো ছার/ গতর খাটি/ ঘাম ঝরে কি/ কম”?


স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত ছন্দে রচিত ছড়াটির ছন্দ নিখুঁত। পূর্ণ পর্ব চার মাত্রার। অপূর্ণ পর্ব ২/ ১ মাত্রার। “গেছি হুক্র/৪ বার ১”। এখানে হুক্রবার শব্দ মধ্য খন্ডন হয়েছে। গেছি শব্দে পর্ব পূর্ণ হয় না। তাই হুক্র দিয়ে ৪ মাত্রা পূর্ণ করা হয়েছে। আবার “কই যাইবেন” বাক্যাংশে ৪মাত্রার মূল্য দেওয়া হয়েছে। “কই+ যাই+ বেন”এখানে ৩টি রুদ্ধ দল বা রুদ্ধ সিলেবল । ৩টি রুদ্ধ সিলেবল মিলে চার মাত্রার মূল্য পায়। এটি তার ছন্দজ্ঞানের পরিচায়ক। এ ছড়ায় যাত্রি কথা বলেছেন প্রমিত বাংলায় আর চালক বলেছেন আঞ্চলিক ভাষায়। ফলে চরিত্র দুটি ফুটে উঠেছে। একটি ছড়ায় যখন এতোগুলো বিষয় শৈল্পিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এ ছড়া, ছড়াসাহিত্য এবং ছড়াকারের শক্তিমত্তা সহজেই প্রকাশিত হয়। আর আমাদের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে।প্রিয় পাঠক আপনি কি বলেন।


ছড়াকারকে আন্তরিক অভিনন্দন।


ছড়াকারের প্রতি: অবাক আর বেবাক এবং এসে এবং বসে অন্তানুপ্রাসে দুর্ববলতা লক্ষ করা যায়। প্রথমটি অ কার আন্ত শব্দের সাথে এ কার আন্ত শব্দ এবং দ্বিতীয়টি এ কার আন্ত শব্দের সাথে অ কার আন্ত শব্দের অনুপ্রাস শক্তিশালী হয় না। চমৎকার একটি ছড়ায় এটি এড়ানো গেলে দারুণ কাজ হয়। মেলান, হুক্রবার শব্দদ্বয়ের প্রমিত বাংলা ফোট নোটে দিলে ভালো হতো।


আপনাকে আজই প্রথম পড়লাম। শুভেচ্ছা।