অলখঝোরা 4
দাদু(16-12-2018)
রণজিৎ মাইতি
--------------------
বটবৃক্ষসম নবতিপর দাদুর চালচলনে ভাবতে হয় তারুণ্যের নতুন সংজ্ঞা !
কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁসার আধসেরি গ্লাসে কড়া চিনি সহযোগে দুধ চা ও পেপার পড়া প্রাত্যহিক অভ্যাস।
কোথাও কোনও অন্যায় দেখলেই---
আগুন নেভার আগে যেভাবে দপ্ করে জ্বলে ওঠে
সেভাবেই দাদুকে জ্বলে উঠতে দেখাতাম।
আসলে তখন তো ভেজালের এতো রমরমা ছিলোনা;
খেতেন বাড়ির খাঁটি দুধ,গাওয়া ঘি,মাখন।
এখন দাদুর ফিটনেসের কথা ভাবলে মনোহর আইচের কথা মনে পড়ে;
যদিও কখনও কোনও ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে দেখিনি!
আমাদের যতো সখ্যতা আবদার সবই দাদুর কাছে;
রঙ্গরসে ভরপুর জমাটি মানুষটির কাছে
গল্প না শুনলে রাতে ঘুমই আসতো না।


ঠাকুমা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্রের বাসিন্দা;
যেখানে জনমানব নেই কিন্তু কোলাহল আছে।
পলিতকেশ,ফোকলাদাঁতে একটু বিশুদ্ধ হাওয়ার জন্যে অষ্টপ্রহর কি মরণপণ লড়াই।
আসলে হাঁপানির ব্যামোতেই এখন তখন অবস্থা,
বেডরুমটিই ছিলো তাঁর কাশিধাম বারাণসী বৃন্দাবন।


সারারাত খুক খুক করে কাশতো।
আর কাশতে কাশতে দুর্বল হয়ে গেলে চালভাজা চিবাতে দেখেছি,
নাতি নাতনির ধকল একেবারেই নিতে পারতো না।
একমাত্র দুপুরে খেতে বসলে পেছনে ঘুরঘুর করতাম;
কারণ পেল্লায় কাতলা মাছের মুড়ো ঠাকুমার জন্যই বরাদ্দ!
ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে চিবোতেন,
আর আমাদেরও জুটে যেতো ছিটেফোঁটা।


হঠাৎ একদিন দুপুরে মুড়ো চিবাতে চিবাতেই ঢলে পড়লো ভাতের থালায়।
সেদিন ছিলো পঁচিশে বৈশাখ,1983 ।
আমরা ছোটোরা পাড়ার ক্লাবে রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপনে ব্যস্ত।
দিদি হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো,-- 'ভাই,বাড়ি চল।ঠাকুমা নেই।'
কথাটি শোনা মাত্রেই আমার চিত্রকর মন আঁকতে থাকলো একটা জীর্ণ জলধি;
সুখ-দুঃখের সদ্য ধূসর দিনলিপি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে মাটি ও অনন্ত আকাশ
মৃত্যু সম্পর্কে সেই বয়সে গভীর অনুভূতি না থাকলেও জানি,ঠাকুমাকে নিয়ে যাওয়া হবে অনন্ত যাত্রায়
যে চিত্রনাট্যের কুশীলব ঠাকুমা স্বয়ং ও শোকসন্তপ্ত পরিজন
যেভাবে বড়রা বিষধর সাপ মারার পর পুড়িয়ে দেয় সেভাবেই ঠাকুমাকে - - - - - !!!


এক ছুটে বাড়ি এসে দেখি সবাই কাঁদছে,
সেই প্রথম বাবাকে ও জ্যাঠুকে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে দেখলাম।
কান্না কি সংক্রামক ব্যাধি ?
সবার কান্না দেখে আমারও ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো,
দাদু ছাড়া এখন কে সামলাবে আমার অবদমিত উতরোল !


সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে,
গোধূলির ম্লান আলোয় দাদুর ঘরের বন্ধ দরজা ঠেলতেই মনে হলো---
হরিনামের ঝোলা হাতে ভাব সমাধিস্থ হয়ে বসে আছেন কোন সে প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাচীন ভাস্কর্য।
আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে ডেকে নিলো;
মাথায় কপালে গালে হাত বোলাতে বোলাতে বললো,--- "ভাই,তোমার ঠাকুমাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় তোমরা সবাই ধুপ ও বাতি জ্বেলে প্রণাম করো;
আর বাগানের একটা তাজা লালগোলাপ তোমার ঠাকুমার পায়ের কাছে রেখো"
আমি দাদুর আদেশ মতো সবে বাগানের দিকে পা বাড়িয়েছি,
বললো শোনো,--- "তোমার বাবা ও জ্যাঠুকে একবার আমার কাছে আসতে বলো তো"
অবাক হয়ে দেখলাম,সাতাত্তর বছরের দাম্পত্যে পত্নি বিয়োগের পরও একটা মানুষ কিভাবে থাকতে পারেন এমন শান্ত সমাহিত!
আসলে এই দাদু নামক মানুষটি কি চিরকালই ছিলেন এমন নির্দয়,পাষাণ?
শুনি শালগ্রাম শিলাও ভক্তের কান্নায় নড়ে চড়ে ওঠে।


দাদুর আদেশ বাবা ও জ্যাঠুমণির কাছে পৌঁছে দেওয়ার আগেই ঘনমেঘ এসে হাজির দরজায় সামনে,
কাছে ডেকে দুই ছেলেকে দুই বাহুতে জড়িয়ে দিলেন অন্তেষ্টি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশ।
তখনও দুটি স্বাধীন দিঘির স্বচ্ছ গভীর জল উথালপাথাল ।
দুই অংশজ-র পিঠে ও মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো---"শোন্,তোরা যদি এই ভাবে ভেঙে পড়িস আমি কিভাবে নিজেকে ধরে রাখবো বল ?
সবার বাবা মাকেই একদিন না একদিন - - -।"


এবার সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম,
আলো-আঁধারিতে বোঝাই যাচ্ছে না আকাশে অন্যান্য রঙের অস্তিত্ব;
শুধুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু তারাবিন্দু। দাদু আজীবনের সঙ্গিনীর মুখটা শেষবারের মতো দেখে মা ও জ্যাঠিমাকে দিলেন পারলৌকিক কাজ সংক্রান্ত নির্দেশ।
"বৌমা,তোমার মায়ের সারা শরীরে ঘি,সিঁথিতে সিঁদুর ও পা আলতায় রাঙিয়ে দিও।"
ব্যস,কথা ওইটুকুই।তারপর ঢুকে গেলেন আপন বলয়ে ।


সেদিন আমার মনে হয়েছিলো দাদু মানুষটি কি সত্যিই পাথর!
যে মানুষটি নাতি নাতনির শরীরে একটু আঘাত লাগলে মনে করেন সে আঘাত তারই শরীরে লেগেছে
সেই মানুষই কিনা এতোদিনের সহধর্মিনীকে হারিয়ে নির্বাক!


আসলে সব কান্না কি খালি চোখে দেখা যায় ?
যখন সবাই কাঁদেন;দাদু নামক মহীরূঢ় ধারণ করেন সবার কান্না আপন হৃদয়ে!
আজ এই বয়সে এসে বুঝেছি----
কে বলে নারী শুধুই পুরুষের কাছে ভোগ্য !
এই যে আমার হাত দিয়ে সহধর্মিনীর পায়ে গোলাপের অর্ঘ্য নিবেদন করলেন;
তা কি পত্নীর প্রতি পতির গভীর প্রেমের নিদর্শন নয় ?
তেমন মানুষই তো পারেন পত্নি বিয়োগেও ধীর,স্থির, শান্ত ও সমাহিত থাকতে।

গভীর বেদনা ও অসহ যন্ত্রণাতেও যিনি জীবনের পথে অবিচল থাকেন---
তিনিই তো যথার্থ শিল্পী,আর তখনই জীবনও হয়ে ওঠে শিল্প সুষমায় প্রকৃত ভাস্বর