বৃত্ত  (01-08-2018)
রণজিৎ মাইতি
--------------------
তখন সবে নয় কি দশ,ক্লাস ফাইভে পড়ি
অঙ্কের টিচার মধু স্যার ক্লাসে জ্যামিতি শেখাচ্ছেন
বিন্দু,সরলরেখা,ত্রিভুজ,চতুর্ভুজ,শঙ্কু,কোণ ও বৃত্তের সংজ্ঞা
ব্ল্যাকবোর্ডে এঁকে এঁকে চেনাচ্ছেন এক একটি করে
ক্লাস শেষে স্যারের ভাবখানা এমন----
যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো


আমি তখন সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো স্যারের বাগানের আদরণীয় ছাত্র
শিখে নিয়েছি কম্পাসের রহস্য,প্রোটেকটারের ব্যবহার
পরিধির বাইরে গিয়ে আঁকছি ব্যাস ব্যাসার্ধ জ্যা
স্যার আমার উৎসাহ দেখে মাথায় রাখতেন স্নেহের হাত
বছর বছর একটা একটা সোপান টপকাতে টপকাতে---
কলেজ ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিও তখন হাতের মুঠোয়
প্রশংসার বন্যায় ভাসছি চেনা বৃত্তে

ততদিনে বাবার চুলে শুভ্রতার ছোঁয়া
চারতলায় উঠতে গেলে হাঁফ ধরে যায়
সবে চাকরির চেষ্টায় এদিক ওদিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছি
তখন কি ছাই বুঝতাম কম্পাস দিয়ে বৃত্ত আঁকা যতোটা সোজা
ঠিক ততটাই কঠিন একটা চাকরি জোগাড় করা


দিনে দিনে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট
সামনে রিটার্টমেন্ট,মাথার উপরে বেকার ছেলে ও একটি সোমত্ত মেয়ে
পাত্রপক্ষ ভুরিভোজ শেষে বলে যাচ্ছে-- 'রঙটা একটু চাপা'
কেউ এমন সব দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির যা দিতে বাবা অপারগ
যতই বাবার অসহায় মুখ দেখছি ততই ছটফট করছি  
হায়,দেশটার নাম যে ভারতবর্ষ !স্বাধীনতার বয়স কতো হলো ?
এখনও মেধা ডুকরে ডুকরে কাঁদে অন্ধকার ঘরে !


অনেক চেষ্টা চরিত্র করে জোগাড় হ'লো ছেলে,
কালো মেয়ে জন্ম দেওয়ার অপরাধে শেষ সম্বল প্রভিডেন্ড ফান্ডে পড়লো থাবা
গুণী জামাই বাবাজীবনের আবদার বলে কথা
যদিও বাবার মুখ দেখে বোঝাই যেতো না নিজস্ব বৃত্তে কতোটা ঝড় বয়ে গেছে


এক রবিবার,বাবা একটু বেশি বেলায় মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছেন
সঙ্গে সমবয়সী কাছের বাড়ির চ্যাটার্জি কাকু ও আরও কয়েকজন
আমি পেছন পেছন স্টেশনের দিকে যাচ্ছি
অনেক দূরে চাকরির একটা পরীক্ষা আছে তাই।
হঠাৎ শুনতে পেলাম চ্যাটার্জি কাকুর গলা--
'মাইতিদা আপনি একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন'
পেছনে থাকায় বাবার মুখ দেখতে না পেলেও পেলাম হাসির শব্দ
এই হাসির অর্থ আমি ঠিকই বুঝেছি


আমি তখন ফিরে গেছি মধু স্যারের ক্লাসে, ভালো করে চিনে নিচ্ছি বৃত্ত,ব্যাস,ব্যাসার্ধ ও সরলরেখা।
ঝুলে পড়ছি জ্যা ধরে !
এ জীবনে কখনও কি বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় চ্যাটার্জি কাকু ?