অনুভব 37
কবি--তাপস গুহঠাকুরতা
আলোচক---রণজিৎ মাইতি
-------------------
আমরা যখনই কোনও বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তখন বক্তব্যের সপক্ষে দিই যথাযথ যুক্তি,বিনা যুক্তিতে সব বক্তব্যই অন্তঃসার শূন্য ।যেমন যদি A=B এবং B=C হয় তখনই উপোরিউক্ত দুটি সমীকরণ থেকে অনায়াসে বলতে পারি A=C হবে।কবি তাপস গুহঠাকুরতা তেমনই তাঁর "অনুভব 37" নামক কবিতায় নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সমাজ সংসার থেকে তুলে আনলেন অকাট্য চিত্রনাট্য । কি সেই চিত্রনাট্য ? পাঠ করা যাক কবির কবিতাটি। শুরুতেই প্রবুদ্ধ কবি বললেন--


"প্রেম হোক কিংবা ভালোবাসায়,
মানুষ বড়োই দীর্ণ।"


স্বতঃই প্রশ্ন ওঠে কেন মানুষ দীর্ণ ? যে কারনে কবির এমন অনুভব।তা কি সমাজের কোনও বিশেষ অবক্ষয়ের চিত্র?যা প্রিয় কবিকে এমন সিদ্ধান্ত টানতে বাধ্য করেছে । বিশেষ করে প্রেম-ভালবাসা মানুষের এক বিশেষ মানবিক গুণ,যা এক মানুষকে আর এক মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের সুতোয় বেঁধে রাখে।সেখানেই কি ধরেছে ঘুন? যদি তাই হয়ে থাকে তবে তো অবশ্যই বলতে হয় মানুষ তথা সমগ্র সমাজ সত্যিই দীর্ণ অর্থাত্ ভঙ্গুর। কবি তার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যে কথাটি বললেন সেই কথাটি কি ফেলে দেওয়া যায়? একটু তলিয়ে দেখে নিই কবি কি বললেন,---


"এখন শহর সাজাতে
বৃদ্ধাশ্রমকেও মাথায় রাখতে হয়!"


আসলে এমন সামাজিক অবস্থাই কবিকে উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত টানতে বাধ্য করেছে।
কবি বিস্ময় প্রকাশ করেন এহেন পরিস্থিতির জন্যে।পিতা-মাতা ও গুরুজন স্থানীয় যাদের শেষ বয়স কাটার কথা ছেলে-মেয়ে,কিংবা নাতি নাতনির সান্নিধ্যে,অথবা পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানে যাঁদের সান্নিধ্যে শৈশব কৈশোর হবে সমৃদ্ধ তাদেরই জন্যে কিনা শহরে গড়তে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম।সমাজে এর চেয়ে চরমতম অবক্ষয় আর কি হতে পারে ! তবে কি আমরা বলতে পারিনা,"প্রেম হোক কিংবা ভালোবাসায় মানুষ বড়োই দীর্ণ" ? এবং এই বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণ হচ্ছে আর পাঁচটা প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন গড়ি ঠিক সেভাবেই।


"ঠিক
স্কুল কলেজ হাসপাতালের মতো"


হায় রে সাধের সভ্যতা,হায় রে মহান প্রেম,
অবাক না হয়ে উপায় আছে ! কবি যখন এমন কথা বলেন,তখন পাঠক হিসেবে আমাদেরও ছুঁয়ে যায় সেই অনুভব।পড়তে হয় অস্তিত্ব সংকটে। ভাবি স্কুল কলেজ হাসপাতালের মতো বৃদ্ধাশ্রমও হয়ে যাচ্ছে তেমনই অবশ্য প্রয়োজনীয় নির্মাণ ।নতুন করে ভাবতে হয় এই যে, প্রেম- ভালোবাসা ও সম্পর্কের আগল কি সত্যিই এতোটাই ঠুনকো ! তখন সভ্যতার ইতিহাস বড়োই অসহায় বোধ করে,তথা মানুষ ।


চমত্কার কবিতা,এর জন্যে অবশ্যই কবির প্রশংসা প্রাপ্য।কবিতাটির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি টানে তা হল নির্মাণ শৈলী । বাস্তব সত্য কবি তুলে ধরেছেন গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে ।কোথাও কবি নিজে থেকে বলেননি সমাজিক এই অবক্ষয়ের কথা।কিন্তু তাঁর অঙ্কিত চিত্র পাঠককে ভাবিয়ে তোলে ।দাঁড় করিয়ে দেয় মানুষ তথা সমগ্র সমাজকে গভীর গিরিখাতের সামনে।এখানেই কবির অনন্যতা। যেখানে কবির গল্প শেষ হচ্ছে সেখান থেকেই পাঠক মনে শুরু হচ্ছে পরিণাম ধর্মী আর এক গল্প । কেউই জানিনা এই অন্ধকার গলিপথের শেষ কোথায় !


তবে একটি কথা না বললে মনে হয় আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে,বুঝলাম না কেনো কবি প্রথম লাইনের শেষে কমা দিয়েছেন। এই কমার কি সত্যিই প্রয়োজন ছিলো ? প্রেম এবং ভালোবাসা দুটি শব্দই Abstract Noun । এবং অর্থগত ভাবে কাছাকাছি হলেও একটা সুক্ষ ভেদরেখা আছে । ধরেই নিলাম কবি সেই সুক্ষ ভেদরেখাটি পরিস্ফুট করার জন্যে প্রেম ও ভালোবাসা শব্দ দুটি সুকৌশলে প্রয়োগ করেছেন । যখন কবি শুরুই করলেন প্রেম হোক" তখন "কিংবা ভালোবাসা" শব্দটিই হয় বাক্যের দাবি । কিন্তু কবি "ভালোবাসা" শব্দটির সাথে জুড়ে দিলেন বিভক্তি ।এই বিভক্তি যুক্ত শব্দের কারণে প্রথম লাইনে কমা দেওয়ার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না । কারণ পরের লাইন "মানুষ বড়োই দীর্ণ"তে এসে কবির বক্তব্য সম্পূর্ণ হচ্ছে।প্রবুদ্ধ প্রিয় কবিকে এই দিকটা ভেবে দেখতে বলবো।


বাদবাকি সুন্দর ও সমৃদ্ধ কবিতা ।কবির সৃষ্টিশীল জীবন ফুলে ফলে ভরে উঠুক এই আশাবাদ পোষণ করি। ধন্যবাদসহ অশেষ শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।