গল্প ভালোবাসে না এমন মানুষ মনে হয় পৃথিবীতে বিরল।আবার সেই গল্পের ভেতর যদি লুকিয়ে থাকে আর একটা গল্প তখন মূল গল্পটি হয়ে ওঠে অনেক বেশি আকর্ষণীয় । তেমনই একটি গল্প শোনালেন কবি জসীম উদ্দীন মুহম্মদ (বোদ্ধা কবি) তাঁর লেখা কবিতা "ইদানিং বড়ো ভয় পাই" কবিতায়। অবশ্য গল্পের আকর্ষণী ক্ষমতা শুধু গল্পের ভেতর গল্প নয়,সেই গল্পের বিষয়, প্রকাশভঙ্গি,সাবলীলতা,শ্রোতার চাহিদা ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে । এই কবিতায় মূলত কবি গল্পকার হিসেবে গল্পের বক্তব্য বিষয় ও সাবলীলতায় উত্তীর্ণ ।


কি সেই গল্পের বিষয় যা আমার মতো নিরস মানুষকেও মুগ্ধ করলো ? কবির সহজ সরল স্বীকারোক্তি ---


"ছোটবেলায় জোঁক ও সাপকে যেমনি ভয় পেতাম
ইদানিং কবিতা লিখতে আমি তেমনি ভয় পাই !"


বলুন এর চেয়ে সহজ সরল স্বীকারোক্তি আর কি হতে পারে ? এবং লক্ষ্য করে দেখুন কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে গেলো । শৈশবের জুজুর ভয় এখনও তিনি পান তবে সে জুজু কবিতা। এখানেই গল্পপাখি এক আকাশ ছেড়ে বেরিয়ে আর এক আকাশে মিশে যাচ্ছে । স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে,কবিতার মতো নিরীহ বিষয় সে নিজে তো কাউকে কাঁমড়ায় না, তবে সেখানে আবার কবি ভয় পান কেন ? যাঁর স্রষ্টা কবি নিজেই। শুরু হয়ে যায় আর এক গল্প । এখানেই গল্পকার হিসেবে কবির কৃতিত্ব ।


স্বতঃই তাকাতে হয় সমাজের দিকে। আসলে কবিতা মানেই সত্য ও সুন্দরের সাধনা । কবি কালোকে কালোই দেখেন আর সাদাকে বলেন সাদা । চাটুকারিতা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ । তিনি বিদ্রোহী ভৃগু হয়ে ভগবান বুকে যেমন পদচিহ্ন এঁকে দিতে পারেন,তেমনি রাজাকে প্রশ্ন করতে পারেন হে "রাজা তোর কাপড় কোথায় ?"


আসল সমস্যা শুরু হয় সেখানেই।শাসক শ্রেণী কখনও প্রশ্ন পছন্দ করেন না,পছন্দ করেন না কেউ দিক তাঁর পাকা ফসলে মই।
তাই কবিও বললেন,---


"কে জানে আমার কবিতা বেড়া ভেঙে কার না কার
ফসলি জমির ধান খায় !!! "


যেভাবে গবাদি পশু বেড়া ভেঙে ফসলি জমি নষ্ট করলে খোঁয়াড়ে বন্দী রাখা হয় তেমনই শাসক বিরোধী কিছু লিখলেই শুরু হয়ে যায় দমন পীড়ন । আটকে রাখেন ফাটকে বছরের পর বছর,যুগের পর যুগ । সেটাই কবির চিন্তা ও ভয়ের কারণ ।
অর্থাত্ এটা কবির বিক্ষণ।এবং এটাই কবিতার মূল গল্পের নেপথ্যে মূখ্য গল্প।


আমারা যদি পৃথিবীর ইতিহাসে চোখ রাখি দেখতে পাবো এমন হাজারো দৃষ্টান্ত,সত্য কথা বলার অপরাধে বা সুন্দরের আরাধনা করার কারণে নেমে এসেছে নির্মম শাস্তি এমনকি মৃত্যুদণ্ড ।


কোপারনিকাস ? ভরো ফাটকে
সক্রেটিস ? হেমলক বিষে নীল করে দাও দেহ
গ্যালিলিও গ্যালিলি ? ভরো অন্ধকার ঘরে
ন্যালসন ম্যান্ডেলা ? কারাগারে ভরো
খনা ? কেটে নাও জিভ আলজিভ ঠেসিয়ে


না,শাসকের কাছে শিল্প ও শিল্পীর কোনও স্বাধীনতা থাকতে নেই । প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে এই আধুনিক যুগেও সেই একই চিত্র । শুধু মুখেই বড়াই আমরা আধুনিক আধুনিক। আসলে সমাজ সংসার পড়ে আছে যেই তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই । এটাই কবির মুখ্যতঃ ভয়ের কারণ ।এবং গল্পের ভেতর আর এক আকর্ষণীয় গল্প।সুতরাং কবির ভয় কি অমূলক ?


আসলে সমাজ সচেতন কবি এই কবিতাটির মধ্য দিয়ে সময় ও সমাজকে সঠিক ভাবে তুলে ধরেছেন ।কবির শৈশব রূপকে প্রাচীন কাল ও কবির বর্তমান আধুনিক সমাজের প্রতিভূ । যেখানে অতীত ও বর্তমানে কোনও পার্থক্য কবি দেখতে পাচ্ছেন না । সাবেক কালেও যেমন মানুষ সত্য কথা বলতে ভয় পেতো রাজশাস্তির ভয়ে,অধুনাও সেই একই ভয়।সুতরাং ভাবায় কবিতাটি,এর থেকে কি আমাদের কোনও দিন নিষ্কৃতি মিলবে না ?


নিস্তার পাই আর না পাই এটাও সত্য যে, সত্যের আগুন কখনও নেভেনা।জ্বলে ধিকিধিকি । কিন্তু যখন জ্বলে তখন সমাজের বুকে যতো রকমের অচলায়তন জমে আছে সবকিছুই ছারখার করে দেয় তার লেলিহান শিখা। এমন ভুরিভুরি নজিরও পাবেন ইতিহাসের পাতায় ।প্রকৃত সাধক ভয় কে জয় করে অবিচল থাকেন লক্ষ্যে,এমনকি মৃত্যুও তাঁর কাছে তুচ্ছ ।


তাই কবি সমীপে আমার আবেদন,সত্য ও সুন্দরের পথে থাকুন,অযথা ভয় না পেয়ে এগিয়ে চলুন অত্যুচ্চ শিখরে, দেখবেন একদিন সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে আপনার হাতের মুঠোয় । এভাবেই লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়েছেন রামমোহন,বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনিষী।


পরিশেষে সুন্দর ও মনোজ্ঞ কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় প্রবুদ্ধ কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই ।