কাকাংক
কবি-- রহমান মুজিব
আলোচক-- রণজিৎ মাইতি
------------------------
শৈশবে স্কুলে বন্ধুরা প্রায়শই সুর করে বলতাম,
'একে গুনগুন
দুইয়ে হাট
তিনে গুঞ্জরণ
চারে লাট'
আর শিক্ষক ক্লাসে ঢুকেই বলতেন,---'ওরে, তোরা কি মাছের বাজার বসিয়েছিস?'
আমরা স্যারের মৃদু বকুনিতে চুপ করে যেতাম ।বুঝতে পারতাম আমাদের বকবকানি সরল গুনিতক হলে পড়াশোনা উঠবে লাটে।
তেমনই প্রবুদ্ধ কবি রহমান মুজিব যখন বলেন,
"একটা কাকে ডাকে কা কা
দুইটা কাকে কা কা কা কা"
তখন সরল গুনিতকের বোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু কবি 'চারে লাট'এর গল্প না শুনিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন ভিন্ন এক গল্পের জগতে।যা বাস্তবে ফলিত গণিত,যে জগত খুলে দিলো কাব্যের দরজা। কি সেই গল্প ? কবি বললেন,---
কাকের এই কর্কশ 'কা কা কা কা - - - -'য়
"ঘুরবে ঠিকই রাজার চাকা"
কবির গল্প আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় বাস্তবের মাটিতে । তখন গল্প নিছক গল্প থাকে না ।হয়ে যায় কাব্য ।


কাব্য তো আমরা তাকেই বলি,যখন শব্দের ছান্দসিক প্রয়োগে কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্যবিন্যাসে একজন কবির আবেগ,অনুভূতি,উপলব্ধি ও চিন্তন সংক্ষিপ্ত রূপে ধরা দেয় ।এবং তা অতি অবশ্যই উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের সাহায্যে রসিক পাঠক হৃদয়কে আন্দোলিত করে। কবির কা কা কা কা-এর গল্প কাকস্য পরিবেদনা নয়,বরং রূপকের কাক ধরা দেয় আমজনতা রূপে নির্বাচনের ময়দানে ভোটার হয়ে । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তিনিই সিংহাসনের দাবিদার হন অর্থাত্ রাজা হন যিনি কাক রূপী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কা কা ভোট বেশি পান । এই ভাবনা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কবি কি চমত্কার ভাবে আনলেন এক গভীর ব্যঞ্জনা।


"থাকলে কাক বর্ধমান
বাড়বে বাক মর্দ মান
হিসেব বটে গাণিতিক
আপনি আমি জানি ঠিক"


কবি একেবারে যথার্থ বলেছেন।
আমি আপনি ঠিক জানি বলেই তো সক্কাল সক্কাল দাঁড়িয়ে যাই ভোটের লাইনে পছন্দের রাজা নির্বাচনে । হয়তো কখনো কখনো রাজার আচরণে আমাদের মোহভঙ্গ ঘটে, কিন্তু প্রিয়স্বর সমাবেশে কা কা করতে কার্পণ্য করি না।বরং জানি যতো 'বর্ধমান' (অলঙ্কার হিসেবে নিপুণ প্রয়োগ) হবে কাক সমবায় ততোই বাড়বে রাজার মর্দানি। এখানে কবি 'মর্দ' শব্দটির মধ্য দিয়ে নিখুঁত ভাবে ব্যঙ্গ ও কৌতুক ভাব ফুটিয়ে তুললেন,যা ইঙ্গিত করে আমাদের বাস্তবতা ।যখন দেখি আমাদের নির্বাচিত সরকার পরিণত হয়েছে গুণ্ডারাজে তখন বলতেই হয় আরে এ তো মর্দানির নামে মস্তানি । কবির ইঙ্গিত সেদিকেই । এবং এই ভাবনা সাহিত্য রসে উত্তীর্ণ হয়ে যায় পরবর্তী লাইনে যখন কবি বলেন, 'হিসেব বটে গাণিতিক' । 'বটে' শব্দটির প্রয়োগে ব্যঙ্গ ছুঁয়ে যায় উত্তুঙ্গ শিখর।


যাইহোক কবি গল্পের ওখানেই থেমে না থেকে গণতন্ত্রের চরম বাস্তবতা দেখিয়ে দিলেন চোখে আঙুল দিয়ে ।


"কাক যদি হয় হাজার
জমবে ডাকের বাজার"


বলুন বর্তমান বাজার দেখে আমরা কি কেউ অস্বীকার করতে পারি এমন সত্য ?
বরং - - -


"বৃন্দ-ডাকে ঘুম পালাবে  
বিদঘুটে বক রাজার"


গল্পের শেষ লগ্নে আমরা পৌঁছে যাই চরম অরাজক এক রাজ্যে।নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি আমাদের কখনও উপহার দেয়নি মগের মুলুক ?


তাই গল্পের অন্তিমে এসে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি স্বরূপ কবির গলায় ঝরে পড়ে হতাশা । কবিকে বলতে শুনি,আরে
"এইটা সরল তত্ত্ব"


যদি মন না মানতে চায় প্রয়োগ করে দেখুন,
"করলে প্রয়োগ প্রমাণ সত্য"
পাবেন হাতেনাতে প্রমাণ।
অবশ্য প্রমাণের জন্যে আমাদের আর নতুন করে প্রয়োগের দরকার পড়েনা। ইতিহাস তার জ্বাজ্জ্বল্য প্রমাণ ।বরং আমরা ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘের কথা ভেবে শিউরে উঠি পুনঃরায়।


এবার নামকরণের কথায় আসি, 'কাকাংক' এমন নাম সত্যিই অভিনব । কাকের অঙ্ক হলো কাকাংক। এই আসরে কবি শ ম শহীদ আমাদের উপহার দিয়েছেন "স্বর্ণমণির ছড়াঙ্ক", এমনিতে "কাকচরিত্র,কাকশাস্ত্র" এমন শব্দের সাথে আমরা অতীতে পরিচিত । কিন্তু 'কাকাংক' শব্দটি আমি এই প্রথম শুনলাম ।


কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র কাক,যার একমাত্র জোরের জায়গা ওই গলা।গলাবাজি যতো বেশি হয় ততো জোরে ছোটে তার নির্বাচিত রাজার গাড়ির চাকা।আপাত সরল অঙ্ক হলেও সেই জোরের ফলিত গণিত হলো কাকাংক।সুতরাং বলা যায়,নামকরণ যেমন চমকপ্রদ তেমনই সার্থক।


রূপকধর্মী চমত্কার কবিতা ।ভাব,ভাষা, ব্যঞ্জনা,ছন্দ ও অলঙ্কারের যথাযথ প্রয়োগে কবিতাটি নিঃসন্দেহে ছুঁয়েছে উৎকর্ষতার শিখর।এমন একটি সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।