"নিরপেক্ষ" নিয়ে আলোচনা,
কবি সমীর প্রামাণিক
আলোচক রণজিৎ মাইতি
---------------------
কখনও কখনও এক বিশেষ সুর বিশেষ অবস্থাকে তুলে ধরে।কাছের বাড়ির রসুইখানা থেকে ভেসে আসা গন্ধ যেমন বলে যায় বিশেষ পদের কথা।তেমনই বিশেষ রূপ,রস ও রঙও মানসপটে তুলে ধরে মৌলিক স্থির চিত্র ।শ্রদ্ধেয় কবি সমীর প্রামাণিক( অম্বরীষ কবি) তাঁর "নিরপেক্ষ" কবিতায় তেমনই এক চিত্রের মাধ্যমে আমাদের মানসপটে এঁকে দিতে সক্ষম হলেন এক শাশ্বত সমাজ চিত্র । ক্যানভাস জুড়ে বহতা নদী ও ভাসমান এক দঙ্গল সবুজ কচুরিপানা।যা আমজনতার প্রতিনিধি স্বরূপ ভেসে যায় অনুকূল স্রোতে।


আসলে কবি অঙ্কিত এই স্থির চিত্র ছাপোষা নিরীহ মানুষের জীবনের রোজনামচা।এখানে কবি নিজেই আমজনতার প্রতিনিধি হয়ে দিলেন এক স্বীকারোক্তি,আমি ভাই "সাতেও নেই পাঁচেও নেই" "গা বাঁচানো নিরপেক্ষের দলে!"যেমন কচুরিপানা নদীর স্রোতের অনুকূলে বয়ে যায় নিয়ন্ত্রণহীন, সেভাবেই আমিও বয়ে যাই।


এই এক দঙ্গল সবুজ কচুরিপানা আসলে আমজনতার প্রতিনিধি । তারা কি পারেন প্রতিবাদ করতে ? ভেতরে ভেতরে গুমরে মারলেও পারেন না প্রতিরোধ গড়তে।বরং সময় ও নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন মসৃণ গতিপথে।


সমাজ সংসারের দিকে তাকিয়ে প্রিয় কবি এক চরম ও নিদারুণ বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন।আপাত সহজ সরল গ্রাম ক্যানভাস,ব্যবহার করেছেন একটু সবুজ,তির তির করে বয়ে চলা কচুরিপানা ভরা নদী ও জলের ভেতর কচুরিপানার গুচ্ছমূল যা ছোপ ছোপ কালো ও খয়েরির রঙের মিশেল।এই চিত্র শুধুই ভারতবর্ষে নয়,সারা পৃথিবীর ছাপোষা মানুষের জীবনের করুন আলেখ্য । অথচ তারাই সমাজ সংসারের ধারক ও বাহক । রোদে পুড়ে,জলে ভিজে ঘরে তোলে সোনার ফসল ।রিক্সা টানে,মোট বয়,কলকারখানার শ্রমজীবী মানুষ এরা।অথচ বঞ্চনার ইতিহাস তাদের পিছু ছাড়ে না ।বোবার মতো অন্যায় অবিচার সহ্য করেন মুখ বুজে। আসলে তারা অনেকেই সাত-পাঁচ নিয়ে ভাবতে পারেন না শিক্ষার অভাবে,যারা পারেন তারাও ভাবেন না ।কারন ভাবতে বসলে নেমে আসবে কঠোর শাসন।আমরা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়াই,অথচ বাস্তব সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে।মনে হয় কবির এই বিশেষ স্বীকারোক্তি সেদিকেই ইঙ্গিত করে গেলো ।


প্রিয় অম্বরীষ কবির কাব্যের বৈশিষ্ট্য এটাই ।তিনি সবসময় প্রকৃতি থেকে তুলে নেন সাধারণ অনুষঙ্গ যা কাব্যে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন এবং  তুলে ধরেন সাধারণের বোধগম্য সহজ সরল কোলাজ ।এমন কেউ কি আছেন এই বঙ্গভূমে যিনি দেখেননি এমন জীবন্ত মনোরম স্থির চিত্র ? কিন্তু সাধারণ কোলাজের গভীরে অসাধারণ স্থির চিত্র ফুটিয়ে তুলতে তিনি দক্ষ কারিগর।


কবি রঙ তুলি দিয়ে কেবলই সবুজ রঙে উপর উপর আঁকলেন না বহিরঙ্গ,পানকৌড়ির মতো নদীর জলে দিলেন ডুব।দেখলেন কচুরিপানার সাথে ভেসে যাচ্ছে তার কালো রঙের গুচ্ছমূল।ভেসে চলা এই বহমান মূল আসলে আবহমানকাল বয়ে চলা ক্লেদ-গ্লানি-আবর্জনার প্রতীক ! কোথায় মুখ লুকোবেন এই আমজনতা ? কার কাছে বলবেন নিজেদের গভীর দুঃখের কথা ? সবই সবার জানা,অথচ কেউ এসে দাঁড়ায় না কাছে।অতীতকাল থেকে বয়ে আসছে এভাবেই ।


কি জানি আগামীতে এই কোলাজের কোনও বদল আসবে কিনা ! কবি কি হতাশ হলেন ? কবির রেখাচিত্রেও তেমন কোনো বিশেষ রঙের প্রয়োগ দেখলাম না যা আগামী পৃথিবীকে দেখাবে আশার আলো ।


ভারি সুন্দর ও সুখপাঠ্য কবিতা । এতো কম কথায় এবং সহজ সরল ভাষায় প্রাঞ্জল কবিতা কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।