মানুষকে মানুষের সামনে দাঁড়াতেই হয়। তখন মুখোমুখি দুটো মানুষ পরস্পরকে কতক পড়তে পারে,কতক পারেনা।হয়তো আদতে কিছুই পারে না।অথবা যেটুকু চিনতে পেরেছে বলে দাবী করে তার পুরোটাই ভুলে ভরা । যাকে আপনি সৎ ভাবছেন হয়তো তিনি সর্বাংশে অসৎ।আবার অনেক ক্ষেত্রে এর উল্টোটাও ঘটেছে । আসলে যতোই বলি, 'মুখ মনের আয়না' বাস্তবে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষই একমাত্র জীব যারা যাপনের প্রতিটি ধাপে পরেন মুখোশ ।


তবে কি মানুষ সত্যিই দুর্বোধ্য ? যেমন আমরা সমাজে নিজেদের প্রয়োজনে পরস্পরের মুখোমুখি হই,তেমনই দিন শেষে আমরা নিজেরাই নিজেদের মুখোমুখি হই। মন সেখানে দর্পন। তা মন নামক আরশির সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজকেই বা কতটুকু চেনে ! নিজের কাছে কি সে নিজেই বোদ্ধ ?


গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধেয় কবি প্রণব মজুমদার তাঁর 'রদ্দি রদ্দি রদ্দি রদ্দি রদ্দি' কবিতায় কোনও এক দিগগজ কবির উক্তি তুলে ধরলেন। কি সেই উক্তি যা কবি মনে আলোড়ন তুললো ? বললেন---


"প্রতিটি মানুষই একটা বই".......


এবং প্রবুদ্ধ কবি প্রণব মজুমদার দিগগজ কবির উক্তিটি সমর্থন করলেন।বই মাত্রেই তার একটি মলাট থাকবে ।তেমনই মানুষের বেশবাস,সাজগোজ হলো মলাট অর্থাত্ বহিঃরাবরণ,যা কখনও মানুষের মুখ হিসেবে প্রতিভাত আবার কখনও মুখোশ । মুখ কিম্বা মুখোশ যাই হোক না কেন প্রতিটি মানুষের থাকে স্বতন্ত্র গল্প । আবার গল্পের ভেতর থাকে হাজারো গল্প । পারিপার্শ্বিক মানুষ সে গল্প জানতে না পারলেও আসল মানুষটি কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়ালে স্পষ্ট পড়তে পারেন একটার পর একটা পৃষ্ঠা । তাই তো কবি বললেন,----


"দেখনসই কিম্বা চলনসই মলাটে মোড়া
ভেতরে তার অনেক গল্প"


এই যে অনেক পৃষ্ঠা,অসংখ্যা গল্প সেখানে সুখ,দুঃখ,আনন্দ,বেদনা,স্মৃতি মিলেমিশে একাকার । আর বইয়ের পৃষ্ঠা গুলো আসলে জীবনের বিভিন্ন ফেজ বা দশা। শৈশব,কৈশোর,যৌবন,পৌঢ়ত্ব ও জরা বা বৃদ্ধ বয়স।প্রতিটি বয়সের এক একটি মৌলিক গল্প ।


"শৈশবে,--- 'ঠাকুরমার ঝুলি'
কৈশোরে,---'পথের পাঁচালী'
যৌবনে,--- 'অপুর সংসার'
আর উপসংহারে
'ভোকাট্টা পরিবারের ভালোবাসা'


এভাবেই জীবন তরণী এগিয়ে যায় নদী,মোহনা ছাড়িয়ে মহাসাগরে মিলনের প্রত্যাশায় । আর প্রতিটি ধাপের গল্প মগজে জ্বলতে থাকে স্মৃতি জোনাকির হয়ে মিটমিট করে।কিন্তু সত্যি কি খণ্ডিত গল্প গুলো একত্রিত হয়ে মহাসাগরে মিলত হতে পারে ? যেখানে কবি নিজের বিক্ষণ থেকে বললেন,--পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি নিজেই 'ভোকাট্টা'। এমন ভোকাট্টা পরিবারে ভালোবাসাই বা কতোটা স্থায়ী ? কবির এই দার্শনিক চিন্তা পাঠক হিসেবে আমাদেরও গভীর প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।


শেষে কবি বললেন,--


"ছেঁড়া বই পড়ে থাকে সংসারের তাকে"----


ছেঁড়া সমগ্র গল্প সংকলনটি জীর্ণতা নিয়ে পড়ে থাকে সংসারের অচল তাকে।জমে ধুলোর পাহাড় । কেউ হয়তো তেমন ঝাড়পোঁছও করেনা। আবার তাক অসঙ্কুল হলে অনেক পাঠিয়ে দেয় বৃদ্ধাশ্রমে।


ছোট্ট কবিতা,অথচ কি আশ্চর্য ব্যাপ্তি । সমগ্র জীবনকে নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।কি নিদারুণ পরিণতি এই মনুষ্য জীবনের ।


আলোচনা দীর্ঘ করতে চাই না,কিন্তু আর কয়েকটি কথা না বললে মনে হয় আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থাকে যায় । লক্ষ্য করলে দেখবেন কবি কবিতার নামকরণে একই শব্দ পাঁচ বার প্রয়োগ করেছেন ।শব্দটি হলো "রদ্দি"। রদ্দি শব্দের অর্থ আমরা মোটামুটি সবাই জানি। জীর্ণ,মলিন, পচা,বাসি,সাদামাটা,এতোটাই পুরনো যা ঝুরঝুর করে খসে পড়ে পুরনো বইয়ের মতো। এখানে লক্ষণীয় কবি বইকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ বা সমগ্র মানব জীবনকে তুলে ধরতে চেয়েছেন । এতো গল্পের সমাহারেও জীবন অনিত্য অর্থাৎ নশ্বর।সেখানে কি কবি ঘুরপথে মানুষের মহৎ গুণ প্রেম বা ভালোবাসার অমরত্বকে প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন না ? অর্থাৎ বলতে চাইছি কবি ভাববাদের আশ্রয় না নিয়ে আমাদের কঠিন কঠোর বাস্তবের সামনে টেনে আনলেন । পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান তো তুচ্ছ,এই বিশ্বব্রম্ভাণ্ড নিয়মের অধীন,সেখানে নিয়মের একটু ওদিক হলেই মূহুর্তে সব তছনছ । সে আমাদের সমাজ,সভ্যতা,সংসার,মানুষ সব। অর্থাৎ এই যে পূর্ণতার পেছনে আমাদের ঘোড়াদৌড় আসলে সায়াহ্নে সব অপূর্ণ।অপূর্ণতাই জীবন এবং সেটাই জীবনের পূর্ণাঙ্গ গল্প ।


পরিশেষে এমন একটি সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রবুদ্ধ কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই । আগামীতে আপনার শানিত কলমে সৃষ্টি হোক এমনই সব অমর কাব্য এই আশা পোষণ করি ।