কবিতা--বিচিত্র সুখ-(ব্যঙ্গ)
কবি--গোপাল চন্দ্র সরকার
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
---------  ------------
বিচিত্র সংসার,বিচিত্র মানুষের মন।বিচিত্র জগতে তার চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই।স্বভাবগত ভাবে সে দুঃখ-যন্ত্রণা না চাইলেও সুখ তার কাম্য।সুখের সন্ধানে সে চলে যেতে পারে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে।কঠিন জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যেতে যেতে চিনে নেয় কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত সুখ।কিন্তু এই সুখের আকাঙ্ক্ষা সবার সমান নয়।সেখানেও মানুষে মানুষে ভাবনার তারতম্য আছে।কেউ ভোগে সুখ খোঁজে,কেউ ত্যাগে।তবে ভোগের পাল্লাই সবসময় ভারি।সাধারণত আমরা সুখ চাই মানেই কিছু বস্তুকে চাই,সেই বস্তু করায়ত্ত হলেই সুখের সংবেদন হয়।যদিও এই সুখও দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়না,বস্তুটি পাওয়ার পরক্ষণেই তা চলে যায়।তখন আবার নতুন কোনও বস্তু কামনা করে।যারা এমন হয় তারা ভোগী স্বভাবের মানুষ ।


এর বাইরেও কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের হৃদয় পরের জন্যে কাঁদে,অপরের দুঃখে হন কাতর।এবং পরের জন্যে কিছু করতে পারাতেই সুখ অনুভব করেন।এঁরা ব্যতিক্রমী এবং মহান।ইতিহাসের পাতা এদের জন্য দরাজ।আসরপ্রিয় প্রবুদ্ধ কবি গোপাল চন্দ্র সরকার তাঁর "বিচিত্র সুখ"নামক ব্যঙ্গ কাব্যে বিচিত্র মানব প্রকৃতি ও তাদের সুখের বিচিত্র আস্তানার সন্ধান দিলেন।যখন তিনি বলেন,---


"সুখের আছে শ্রেণী বিভেদ
উত্তম অধম বর্গে,
অবোধের সুখ টাটকা নরক-
গুণবানের সুখ স্বর্গে।"


প্রথম স্তবক পাঠের পর পরই মনে হয় সত্যিই মানুষ স্বভাবে কি বিচিত্র তাই না!স্বভাবগুণে মানুষ সুখ খোঁজে এক একজন এক একজায়গায়!সুখ সম্পর্কে কবির বিক্ষণ আমাদের ভাবিয়ে তোলে।সেখানেও আছে শ্রেণী বিভেদ।অবোধ অজ্ঞ যেমন সুখের সন্ধানে নরকের দিকে ধাবিত হয়,তেমনই গুণবান সেই সুখের কামনায় হন স্বর্গমুখো।


ঠিক দ্বিতীয় স্তবকে দিলেন আর এক শ্রেণীর সন্ধান।


"ত্যাগে,ত্যাগীর শীতল সুখ
হৃদয় ভরা ধর্মে,
লুটের সুখ,লুটের রাজ্যে,
গদ-গদ তার কর্মে।"


দেখুন কি চমত্কার সহজ সরল সাবলীল শব্দ বিন্যাস।বুঝতে কারুরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।ত্যাগী,যার হৃদয় ধর্মে কর্মে মহিয়ান তিনিও সুখ খোঁজেন কিন্তু লুটেরার কাঙ্ক্ষিত সুখের পথ থেকে তার পথ ভিন্ন । তিনি সুখের মধ্যে খুঁজেন শীতলতা অর্থাত্ প্রশান্তি । এখানে 'শীতল সুখ' শব্দবন্ধ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রিয় প্রবুদ্ধ কবি যেমন দুই শ্রেণীর মানুষের চাহিদার তারতম্য নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনই ত্যাগের বিপরীতে আর একটা জগত আছে তারও ইঙ্গিত পেলাম যা কবির উৎকৃষ্ট শিল্প চেতনার নজির।যে জগত লুটেপুটে খাওয়াকেই মোক্ষ জ্ঞান করে।শুধু তাই নয় লুটেরা রাজ্যের ফলভোগী জনতা কেন গদগদ তাঁর কর্মে সে ইঙ্গিতও রেখে যান কবি।আর আমরা পাঠক হিসেবে বাস্তবের দিকে তাকিয়ে অবাক হই।


যদিও এই চিত্র সর্বাঙ্গীন নয়।তৃতীয় স্তবকে এসে এক শ্রেণীর সাধু পুরুষের সন্ধান দিলেন কবি।যাঁরা পরহিতায় ছাই ভষ্ম মেখেও ধুলায় জীবন কাটান।সেটাই তাঁদের কাছে সুখ।


"দেহে ভষ্মমেখে সুখে সাধুরা
ধুলায় কাটে জীবন,"


এরই ঠিক বিপরীত মেরুরও মানুষ আছেন।যারা রত্নরাজির মধ্যে ডুবে থেকে সুখে নিদ্রা দেন।ফলত তাদের সম্পদ এতোটাই প্রিয় হয়ে ওঠে কাছের কিংবা পাড়া পড়শির কথা ভাবার সময় পান না।বা সময় সুযোগ পেলেও এড়িয়ে যান আত্মসুখে।


"ধনী,রত্নরাজি সিন্দুক ভরে,
সুখে আগলে ধন।"


কি বিচিত্র এই জগত সংসার।কবির আনুবিক্ষণিক নজরে কিছুই এড়িয়ে যায়না।কবির ম্যাগনিফাইং চোখে একে একে ধরা পড়ে নিন্দুকের সুখের উৎস,একই ভাবে উদার বান্ধব,যাদের সুখ কেবলই সহাস্য বদনে সবারে ভাই জ্ঞানে কাছে টেনে নেওয়াতেই।


"নিন্দুক,পর নিন্দায় পঞ্চমুখ
সুখের সীমা নাই,
সে উদার বন্ধুর,সহাস্য মন
সবারে মানে ভাই।"


কবির গভীর পর্যবক্ষেণ জনিত বিবৃতি একে একে সমাজের প্রতিটি স্তর চিনিয়ে দেয় গভীর মমতায়।যদিও এর থেকে আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কবি কোন শ্রেণীর পক্ষে।বরং আমাদের ভাবনার আবেশে আবিষ্ট করে কবির পথচলা।এগিয়ে যেতে যেতে পরিচয় হয় আর শ্রেণীর সুখী মানুষের সঙ্গে।


"হিংসী,দুর্যোগেও মনের সুখে
পরের ক্ষতি চায়,"


যারা স্বভাবে হিংসুটে,সাধারণ মানুষের চরম দুর্যোগের দিনেও ক্ষতি সাধনেই যাদের সুখ।মনের সুখে নিজের বন্ধ দরজার ভেতর চিবান কাতলা মাছের মুড়ো।যদিও এদের মুখ চেয়ে সমাজ থেমে থাকে না।


"প্রকৃত সুখীরা সংকট কালে
রত মঙ্গল প্রার্থনায়।"


কবির নজরে ধরা পড়ে হিতাকাঙ্ক্ষী সুবোধ হৈতষীর।যারা মানুষের সংকট কালে মানুষের পাশে থেকে তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়।সেখানে তারা কষ্ট পেলেও সুখ ভেবে আঁকড়ে ধরেন।


সত্যিই কি বিচিত্র সমাজ সংসার ।তেমনই বিচিত্র মানুষের মন। তবে আমরা চাইবো অশুভ সুখকাঙ্খীর বিনাশ হোক,জাগ্রত হোক মানুষের মাঝে শুভ চেতনা ।যারা মনে করবেন,কবি কামিনী রায়ের কথায় বলি--


"পরের কারণে মরণেও সুখ
সুখ সুখ করে কেঁদো না আর
যতোই কাঁদিবে যতোই ভাবিবে
ততোই বাড়িবে হৃদয় ভার"


আমরাও হৃদয় ভার না বাড়িয়ে আসুন সাধু জীবন যাপনে অভ্যস্ত হই।বৈচিত্র্যময় সুখ সন্ধানীর আখ্যান হৃদয়ঙ্গম করতে করতে কবির নিরুচ্চারিত মহান কর্ম সুখে ব্রতী হয়।


চমত্কার নামকরণ।যেখানে কেবল সুখ সন্ধানীর একমুখী  বর্ণনা নেই,বরং বিচিত্র কলস্বরের মধ্য দিয়ে কবি তার প্রিয় পাঠক কুলকে নীরবে বেছে নিতে বলেছেন মহৎ পথ।কবিতার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তেমনই বিচিত্র মণিমুক্তো ।সুতরাং নামকরণটিও যথার্থ বলে মনে করি।


তবে গঠনগত ভাবে দু-একটি কথা বলবো,


"হিংসী,দুর্যোগে ও মনের সুখে"


এখানে মনে হলো "দুর্যোগেও" হওয়া উচিত । কারণ এখানে 'আমি ও তুমি' এমন অর্থ কবি প্রকাশ করতে চাননি।


দ্বিতীয়ত--
"দেহে ভষ্মমেখে সুখে সাধুরা
ধুলায় কাটে জীবন,"


এই দুটি লাইনে মনে হলো হয় 'সাধুর' হবে।নতুবা সাধুরা রাখতে চাইলে 'কাটায় জীবন' হলে বাক্যটি ব্যকরণ গত সঠিক হবে মনে হলো।প্রিয় প্রবুদ্ধ কবির প্রতি বিষয়টি ভাবার অনুরোধ রইলো ।


খুবই সুন্দর সাবলীল ছন্দময় প্রকাশ।যা কবিতাটির প্রাণভোমরা স্বরূপ।এমন একটি সুন্দর,সুখপাঠ্য,নান্দনিক ও অর্থবহ কবিতা আসরকে উপহার দেওয়ার জন্যে শ্রদ্ধেয় প্রিয় কবিকে ধন্যবাদসহ অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই এবং আগামীতে কলম আরও সমৃদ্ধ হোক এই কামনা করি।