কবিচরিত(01-07-2020)
রণজিৎ মাইতি
--------------------
হে সহনাগরিকবৃন্দ,আপনারা কবি কথা শুনতে চান ? কিন্তু কোন ব্যক্তি কিংবা বস্তুর ব্যাপ্তি যখন আকাশ সমান,স্বভাবে বাতাসের মতো প্রবল,গভীরতায় সাগর সমান অতল,তেমন ব্যক্তি কিংবা বস্তু সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া এই অধীনের অসাধ্য।তবু আপনাদের ঔৎসুক্য প্রশমনের চেষ্টায় আমার দিক থেকে যথাসম্ভব বলার চেষ্টা করছি।আসুন শীতলপাটিতে বসে ফাঁকফোকর ভরাটের দায়িত্ব যে যার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে উভয় তরফে কিছুটা নির্ভার হই।


হাঁ ঠিকই ধরেছেন,কবি কোনও ভিন গ্রহের জীব নন,তিনি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ ।তাঁরও ক্ষুধা-তেষ্টা আছে,বাহ্যে পায়।দুখে কাঁদেন, বরং একটু বেশিই কাঁদেন। উদাত্ত কণ্ঠে হাসেন মহাসুখের দিনে।কিন্তু যিনি অমৃত সন্ধানী,যা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ সন্ধান করেন না এবং যাহার হৃদয় বিহঙ্গবৎ তিনিই কবি।যিনি কল্পনার রঙ তুলি দিয়ে মরুতে ফুল ফোটান,অনাবাদি জমিতে ফলান শস্য কিংবা যিনি ঝিঙেফুল নাকছাবি জ্ঞান করেন ও হিজলফুলে বানান পায়ের নুপুর তিনিই কবি।যিনি নিঃস্ব হয়েও মননে কুবের,কুবের হয়েও নিঃস্ব তিনিই কবি।যিনি গভীর সাগরে ডুব দিয়ে একই সঙ্গে মুক্তো ও মুক্তির সন্ধান দেন তিনিই কবি।


হে সুধীজন,কবিদের জগৎ এতোটাই ব্যাপৃত আমি তার কতটুকু বর্ণনা করতে পারি।আগেই বলেছি,ফাঁকি না দিলেও ঠিকই ফাঁক থেকে যায়!যার ভাসাভাসা চোখে ভাষাহীন ক্রন্দন,যিনি শুনতে পান আপামরের অতল ও গহীন হৃদয়ের লাবডুব তিনিই কবি।যাঁর শরীর শীর্ণ হলেও শিরদাঁড়া ইস্পাত কঠিন এবং স্বভাবশান্ত হলেও মননে অস্থির তিনিই যথার্থ কবি।যাঁর কাছে ঋতু মানেই বসন্ত,বছরভর হাতে কৃষ্ণের মতো মোহনবাঁশি থুড়ি কলম তিনিই কবি।যিনি গাছের সাথে মিশে গাছ হয়ে যান,বাতাসের সাথে বাতাস,ঝড়ের সাথে মিশে ঝড় হয়ে যান এবং আগুন দেখলেই দাবানল জ্ঞানে পূজা করেন তিনিই কবি।যিনি কখনও জীব-জড়ের ভেদাভেদ করেন না,অথচ বোঝেন পাথর ও শালগ্রাম শিলার পার্থক্য তিনিই কবি।


হে সুধী সহনাগরিকবৃন্দ,কবিদের সম্পর্কে বলতে বসলে মহাভারতও বড্ড খাটো মনে হয়।বাল্মীকি যার স্রষ্টা সেই রামায়ণও কণিকাবৎ স্বয়ং আদিকবির কাছে।সুতরাং যাঁর সম্পর্কে দিন-রাত এক করে শুনলেও যে গল্পের শেষ হয়না বরং পিত্তাতিসারে ভুগিবার সম্ভাবনা বাড়ে তিনিই কবি।এরা স্বভাব নিশাচর,তাই অমাবস্যা আঁকতে ভীষণ ভালোবাসেন।শিক্ষক যেমন চক্ দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে আঁক কাটেন ও পোছেন ডাস্টার দিয়ে,পুনরায় আঁক কাটেন।এরাও তেমনই অমানিশার আকাশে আঁকেন তারাবাজি,পোড়ায় রংবেরঙের রংমশাল।যদিও একটা ফুলকিও পড়তে দেন না মাটিতে।এদের কাছে মাটি মানে 'মা'।আজীবন মায়ের ব্যথা ধারণ করেন হৃদয়ে।রাত পেঁচার কর্কশ মায়াবী ডাক শুনে চিনে নেন 'মায়া'।পৌঁছে যান শঙ্কর-রামানুজে,"ব্রহ্ম সত্য,জগৎ মিথ্যা" এই বোধে।এবং এই সত্য থেকে উত্তোরণের চেষ্টা করতে গিয়ে ঢুকে পড়েন আর এক ভিন্ন জ্যোতির্বলয়ে।তখন শ্রী চৈতন্যের মতো নিজেকে তৃণ জ্ঞান করেন।সবুজের সাথে মিশে সবুজ হয়ে যান,অবুঝের সাথে অবুঝ।যদিও সেই সবুজের হরেক সেড।কোনটা জলপাই সবুজ,আবার কোনটা কচি কলাপাতা।যদিও কোথাও কোনও অভিমান-অভিযোগ নেই।নেই আত্মাভীমানের অত্যুচ্চ শিখর।আকাশ জুড়ে শুধু অনুরাগ।তখন সানুনাসিক সুরে গায় বেতালপঞ্চবিংশতি।প্রেমে-অপ্রেমে,জলে-স্থলে,স্থলে-আকাশে ও অন্তরীক্ষে শুধুই উথালপাথাল ঢেউ আর ঢেউ।যদিও এসব কবির কাছে প্রপঞ্চ নয়,যার পুরোটাই সুনীল আকাশ।নীলের কি লিঙ্গ হয় কিংবা নীলার ? সুতরাং এই নীলাকাশের কোথাও কোনও লিঙ্গভেদ নেই।স্ফটিকস্বচ্ছ আকাশ জুড়ে দিনে চারুময় রামধনু ও রাতে নির্লিপ্ত
কারুময় নিহারীকা। আবার ক্লিব ভাবতেও রাজী নয় এরা।আকাশ মানে শিব,সত্য-সুন্দর।সত্য ও সুন্দরেরও কি আছে স্বাধীন লিঙ্গ ? সুুতরাং এদের চোখে নারী ও পুরুষ দুই-ই সমান।আসলে এদের হৃদয়টাই শ্রীমৎভগবতগীতা।তাই,হাতি ও ইঁদুরের অন্তরীক্ষে দেখতে পান স্বয়ং নারায়ণকে,তেমনই পিঁপড়ের অন্তরে দেখেন সাক্ষাৎ অনন্তকে।এবং জানেন,নিজেরা নিছক সাক্ষীগোপাল নন,তাই কলমে তার সাক্ষ্য রেখে যেতে চান,রেখে জানও।


হে প্রিয় পুরজন,আপনারা ভাবছেন জীবন-মৃত্যু নিয়ে কি তবে এই আজব কবিকুলের কোনও ভাবনা নেই!আমি বলবো অবাক হবেন না,ধৈর্য্য ধরুণ।আগেই বলেছি এদের জীবন রামায়ণ-মহাভারতের চেয়েও বৃহৎ।সুতরাং 'যথা ধৈর্য্যং,তথা বলং।' জি.বি. দিয়ে যা পরিমাপ যোগ্য নয়,তা জানতে প্রয়োজন যোগাযোগ ও মনোসংযোগ।শুধু এটুকু বিশ্বাস রাখুন আমি গল্পের গরু গাছে চড়ানোর মানুষ নই।তবে অবাক হওয়া বা আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব যে যার নিজস্ব ব্যপার।ঠিক যেমন মালের দায়িত্ব আরোহীর।আমি নিমিত্ত মাত্র,না না আরোহক মাত্র।এই তো এই সেদিনের কথা,এক কবিই তো নিজের আবেগকে সামলাতে না পেরে আগ বাড়িয়ে বলে ফেললেন,--"জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন।"একবার ভেবেও দেখলেন না
এমন কথার কথা ও বাস্তবের কতোটা ফারাক।কিন্তু কি আর করা যাবে,কবিরা চিরকালই এমন,আপাত সৃষ্টিছাড়া কথায় উদার দৃষ্টি,চোখ সুদূরে।জীবন ও মৃত্যুর মাঝে পেল্লায় বপুটাকে এক পাল্লায় তুলে পায়ের ভৃত্য বানানোর দুঃসাহস কি আপনি কিংবা আমি দেখাতে পারবো কখনো ?


জানবেন,যিনি হাতের কাছে যা-ই পান অমৃত ভেবে খান চেটেপুটে,আবার না পেলে পবনপুত্রের মতো বায়ু সেবন করেন তিনিই কবি।যিনি গোস ও শুয়ারে এক কড়াইতে চড়ান,রাম-রহিমে মনে করেন রক্ত-মাংসের মানুষ,ভাই ভাই,তিনিই যথার্থ কবি।যাঁর চোখ নরকে কিন্তু গমন স্বর্গে,যিনি হনুর মতো কলাপ্রিয় ও সুররিয়ালিস্ট এবং যিনি বসন্ত অর্থে বোঝেন কোকিলের কুহুকুহু,ব্যাঙের গ্যাঁঙর গ্যাঁঙরের মধ্যে শোনেন বৃষ্টির রিমঝিম তিনিই কবি।যিনি নিশিথে 'শিশিরের শব্দ' শুনতে পান,গনগনে দুপুরে 'পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে' শোনান মিষ্টি 'মিড়' তিনিই কবি।যিনি আত্মবোধে মগ্ন থাকেন এবং স্বীকারও করেন এটা তাঁর একান্ত নিজস্ব 'মুদ্রাদোষ' তিনিই কবি।কিংবা যিনি নিজেই স্বদম্ভে ঘোষণা করেন যে তিনি আইনের উর্দ্ধে,টর্পেডোর মতো ভয়ঙ্কর,সময়ে সময়ে শিবের মতো রুদ্র ও নটোরাজ অথবা ভৃগুর মতো স্বঘোষিত 'বিদ্রোহী' তিনিই কবি।


যারা বলছেন হে প্রিয়,এখন কবিদের সুখ-দুখের বারোমাস্যা কিছু শোনান।আপাত লালন সাঁই,বড়ুচণ্ডিদাস,মুকুন্দরাম,
তুলসীদাস, গীতগোবিন্দের স্রষ্টা জয়দেবের কথা কিছু বলুন।আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলি প্লিজ,দূর নক্ষত্রের দিকে তাকাবেন না।ভেসে যাবেন দুখের সাগরে,দুখের সপ্তসিন্ধু পাড়ি দেওয়া আমাদের মতো দুর্বলের কম্ম নয়।সুতরাং সামনে তাকান।যাদের দেখে মানুষ আড়ালে বলেন,'ও হো গোবেচারা।' কিন্তু সামনে পেলে কৌতুহলে দুদণ্ড কাছে বসে সম্মান বোধ করেন তাদের সুখ-দুখের কথা আর কতোটুকু বলা যায় ! ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে বিষ্ণুর ন্যায় এরাও অবতাররূপে যুগে যুগে এসেছেন এই ধরাধামে,আবার অভিষ্ট কর্ম সম্পন্ন হলে প্রপঞ্চের মায়া ত্যাগ করে চলেও গেছেন।রাষ্ট্রশক্তি ও রক্তচক্ষু সর্বকালে এদের পেছনে পেছনে,যদিও এসব উপেক্ষা করে ঝরিয়েছেন রক্ত ও ঘাম।আপনি কি দেখতে চান সেই রক্তনদী ? শুনতে চান সেই লবনাম্বুধীর বেদনাক্লিষ্ট কল্লোল ও চাপা আর্তনাদ ? বরং ভেসে যাই সেই অমৃতবাণীতে।যিনি সমগ্র জগতের সমস্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে বলতে পারেন, "এরা কিছুই বোঝে না,কিছুই জানেনা। হে প্রভু,তুমি এদের ক্ষমা করো।" কিংবা কণ্ঠে কর্কট ধারণ করেও প্রিয় শিষ্যকে দিতে পারেন "শিব জ্ঞানে জীব সেবা"র নির্দেশ।রাষ্ট্র তথা রাজাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাঁরা বলতে পারেন "রাজা তোর কাপড় কোথায়?" তাদের সুখ-দুখের ভেতর না ঢুকে বরং আসুন ভেসে যাই সেই অমৃত কথায়।উচ্চ কণ্ঠে বলি,"চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য,উচ্চ সেথায় শির"।কিংবা বলি,"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"।আসলে মরা মরা থেকেই তো উচ্চারিত হয় রামনাম।সুতরাং যাঁরা এমন কথা বলেন তাঁরাই তো যথার্থ কবি,তপ্তকাঞ্চন।তাই তো কবি মাত্রেই বিদগ্ধ,ঋদ্ধপুরুষ। মহাদেবের মতো তৃতীয় নয়নে বিচ্ছুরিত হয় অগ্নি,ব্রহ্মতালুতে উৎসারিত  হয় মন্দাকিনী।বরং আসুন দুখের প্রস্রবণে না ভেসে ছিন্নমূল শালতরুর মতো মুগ্ধ হই কবি নামক তপ্তসুবর্ণের উজ্জ্বল দ্যুতিতে।তবেই হয়তো আমাদের কবিকথন শ্রবণ সার্থক হবে,সার্থক হবে এই মহামর্ত্যধামে মহাভারতীর বরপুত্রের যথার্থ বন্দনা।