কবিতা লিখতে হলে(রম্য)
(দ্বিতীয় পর্ব)(17-05-2019)
রণজিৎ মাইতি
--------------------
আপনি কি চৈতন্য টিকি কামিয়ে ফেলেছেন ? পরম ব্রহ্মের আরাধনায় নিমগ্ন ? জানবেন কাম ক্রোধ লোভ মদ মোহ ও মাৎসর্য জলাঞ্জলি দিয়ে কখনওই কবিতা হয়না । মানে ষড়রিপুর কথা বলছি।বাস্তব জগতে রসেবসে থেকে মহত্তর জীবন ও জগতে উত্তোরণের সাধনাই কবিতা।অর্থাৎ সত্য শিব ও সুন্দরের আরাধনা । পথ ও মত হতে হবে রৈখিক। ধরি মাছ না ছুঁই পানি অথবা আমড়াগাছি এখানে চরম ভাবে বর্জনীয় । গীতাঞ্জলির কবি কি আজীবন অকৃতদ্বার ছিলেন ? খোঁজ নিয়ে দেখুন বচনাঞ্জলী কতোটা ফ্লপ।গবেষণা করলেই পেয়ে যাবেন ফ্লপের কারণ । আসলে মায়া প্রপঞ্চে আপনাকে জড়াতেই হবে।তা না হলে ঋদ্ধ হবেন কিভাবে ? সাথে কি আর কবিকে বলেন বিদগ্ধ মানুষ । এসি ঘরে শুয়ে ফুলদানিতে থাকা গোলাপের সৌন্দর্য উপভোগ করতেই পারেন ।কিন্তু গোলাপের দুঃখ যন্ত্রণা কিভাবে বুঝবেন ? স্বতঃই আপনার কলম "কুলি-মজুর"এর দুঃখে ও কষ্টে হবেনা কাতর,চোখ ফেটে নামবে না অমোঘ ঝরণা।যদি আনতে চান তা হবে কুম্ভীরাশ্রু । চায়ের দোকানে কাপ না ধুলে এমন কবিতা আপনি কস্মিনকালেও লিখতে পারবেন না ।ধরুন আপনি লিখলেন,---
"ঠান্ডা ঘরে নাকে সর্ষে তেল দিয়ে ঘুমাই নিঝুম ;
উফঃ কি আরাম,কি আরাম !
কেবল সুখ আরাধ্য ধন,দুঃখ হারাম !"
এটাকে কি কবিতা বলা যায় ? না আছে কোনও মানবিক আবেদন,না আছে কোনও রসকষ।আপন সুখের সদম্ভ বিবৃতি মাত্র ।


তাই যে কথা বলছিলাম,চৈতন্য টিকি আপনার চাই,চাই-ই।বরং সুন্দর ও সুসজ্জিত কেশবিন্যাস আপনার কবিতা সৃষ্টির প্রথম সোপান । সাধে কি আর রবিবাবু পেল্লায় গোঁফ,লম্বা দাঁড়ি ও এক মাথা দেবদর্শন চুল রেখেছিলেন ! এমনিতেই কবি মাত্রেই ভোলেভালা।এই সুযোগে মাথায় বাঁসা বাঁধবে ঝাঁকে ঝাঁকে উঁকুন।যতো কামড় দেবে ততোই আপনি ঋদ্ধ হবেন । ব্যথির ব্যথা ফুটে উঠবে কাব্যে শতদলের মতো ।বিছানায় ছারপোকা,ভাতের থালায় কাঁকর আপনাকে খুঁচিয়ে তুলবে । সে সবেরই প্রতিফলন ঘটবে আপনার সোনা ঝরা কলমে । আপনার নাড়ির স্পন্দন,শ্বাস-প্রশ্বাস অন্যের বুকে বাজবে দীর্ঘশ্বাস হয়ে।ধীরে ধীরে আপনি হয়ে উঠবেন সবাকার, প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক ।বিদ্রোহী কবির ভয়ে শাসক হবেন ত্রস্ত।আপনাকে চেয়ারের লোভ দেখিয়ে কিনে নেওয়ার ফান্দা আঁটবে ।আপনি স্থির সঙ্কল্প,মৃত্যু আপনার কাছে অমৃত সমান। বৃহত্তর সমাজের দুঃখ কষ্ট আপন দুঃখ-কষ্ট ভেবে কলম হাতে জীবন করবেন প্রণিপাত। যেমন ক্ষুধা তাড়িত করে উপার্জনে,তেমনই উঁকুন,ছারপোকার কামড় কবিতা সৃষ্টিতে করবে প্রণোদিত ।


ধরুন আপনি সংসার আশ্রম থেকে বেরিয়ে বেছে নিয়েছেন মাধুকরী জীবন।দিন শেষে সংগৃহীত শস্যকণায় ক্ষুন্নিবৃত্তি সেরে রাতে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। সকালে পুনরায় বেরিয়ে পড়লেন সেই মাধুকরীতে বিগত দিনের মতো।এমন জীবন হলে কবিতা ফুরুৎ ।আসলে পলায়নী মনোবৃত্তিই সৃষ্টির অন্তরায় । সন্তানের আধো আধো বাকসুধা, অর্ধদন্তবিনর্গত স্নেহমধু,গিন্নির মধুর প্রেমসুধা,চাওয়া পাওয়া অথবা না পাওয়াই কবিতা সৃষ্টির প্রধান অনুঘটক ।


ধরুন আমি বললাম,- - -
"মানুষটির বিয়ে হয়েছে কিন্তু সম্পর্ক হয়নি,
উফঃ তার মানে আজও বেডরুমে সূর্য ওঠেনি!
আসলে ডিভোর্সের অন্য নাম ঘন অমানিশা।"
কথাটি শুনে কেউ হাসলো।কেউ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটির দিকে । এই যে হাসি অথবা কৌতুহলের উদ্রেক এটাই তো কবিতা । আরে বিয়েটাই তো সম্পর্ক সেখানে আবার সম্পর্ক হলোনা কিভাবে ! এই যে সম্পর্কের টানাপোড়েন,যৌনতার ইঙ্গিত, যে কারণে কাছের মানুষটি হেসেছিলো সেই লুক্কায়িত ইঙ্গিতই তো কবিতা ।


সেভাবেই কুঁড়ি কবিতা,ফুল কবিতা,বীজও কবিতা । শাখাপ্রশাখায় পাতার মর্মর ধ্বনিও নান্দনিক কাব্য ।আকাশ বাতাস মেঘ অর্থাত্ পঞ্চভূতেই কবিতার সুপ্ত ও গুপ্ত অঙ্কুর ।কিন্তু কৃষ্ণ কবিতা নয়,কবিতা হলো বাঁশি হাতে শ্রীকৃষ্ণ।বাঁকেবিহারী, রাখালরাজাও কবি।যখন তিনি রমণীরমণ অথবা মদনমোহন তখনও তিনি কবি।শাসক দ্বারকানাথ কি কবি ছিলেন ? বিলাস ব্যাসনে অভ্যস্ত মানুষ কখনও কবি হতেই পারেন না । যিনি মৃগয়ায় যান কিভাবে বুঝবেন শরবিদ্ধ ক্রৌঞ্চীর আত্মবিলাপ ? শাসক মানেই শোষক। তিনি যতো বড়ো নাথই হউন শ্রমজীবীর শ্রম চুরি করে রাজকোষ ভরানোই তাঁর মূখ্য নেশা। খাঁচাবন্দি ময়না তাঁর বড়ো প্রিয় ।কিভাবে গাইবে বলো মুক্তির গান? বরং আপন পশুশালার শোভা বাড়ান বন্য চিড়িয়ায়! তিনি কখনও কি হতে পারেন সমৃদ্ধ কবি ?


অর্থাৎ সংসার আশ্রমে থেকে মানুষের সুখ-দুঃখের যথার্থ অনুধাবন এবং তা কাব্যে সঠিক রূপদান হলো কবির কর্ম।তবে সত্য ও সুন্দরের আরাধনার জন্যে প্রয়োজন উর্বর মাটি । মগজই সেই উৎকৃষ্ট মাটির নমুনা। যেখানে অঙ্কুরিত চারাগাছ শেকড় ছড়ায় গভীরে গভীরে । শুষে নেয় জল ও খনিজ।আর চাই কল্পনার মুক্ত আকাশ।হোক সে আকাশকুসুম,আসলে চেতনা স্পর্শধন্য রামধনু রঙে ।তাই চৈতন্য টিকির গাই জয়োগান।যা কবিতার এন্টেনা,ডিসপ্লে কাগজ কলম।সৃষ্ট বাকসুধা কৃষ্ণের মোহন বাঁশির মতো মিষ্টি মধুর ।তুমি তা কবিতা বলো আমি বলি অমৃত বানী।