পূজো পর্ব শেষ হলো। চলছে বিজয়া।
আলিঙ্গন, প্রণাম. আর আনন্দচ্ছায়া -
না ফুরোতেই রুজির জন্য হন্যে হয়ে
ফেরা।পূজোয় হয়নি জামা,গেছে সয়ে
সপ্তমী  কালীরও। তার  বাবা  সতার -
চিন্তাশুধু কোনোমতে যোগানো আহার।


সতা মানে  সনাতন। জাতেতে  ধীবর,
সনাতন  ধর্মে  যার  পূর্ণ  আজি  ঘর -
চারমেয়ে পাঁচছেলে নিয়ে। ছোট ছেলে
কালি, খালিগায়ে ঠাকুর দেখতে গেলে
কষ্ট  হয় তার ।  কিন্তু  তবুও , অভাব
সাথে ভাব করে ওরা, সংসারে সদ্ভাব
রাখে দারিদ্র্য মোচনে।সকলেই জানে,
বাবা ওদের  সারাদিন  খাদ্য  সন্ধানে
চেষ্টা করে কতো!
                  আজো বাপ বেটা মিলে
রুজির সন্ধানে নৌকো ভাসিয়েছে জলে।
টাকা যদি কিছু  মেলে, আশা বুক ভরা।
মনে পরে,যেন ক্ষ্যাপার সে খুঁজে ফেরা
পরশ  পাথর।  আকাশে  পূর্ণিমা  চাঁদ -
ঝলসানো রুটি! নাঃ, ওরা আজ বিষাদ
ভুলে, চলে ভাগীরথী কুলে।বাতাসেতে
আর্দ্রভাব  ব্যাপ্ত   চারিধার,  পরিচিতে
শারদ  আকাশ।  মৃদুমন্দ  বায়ু  বয়,
ঠাণ্ডাভাব আছে, সময়টা ভাল নয়।
কিন্তু হায়!ভেজাভাতও জোঠে না যার
শীতের কাঁপুনি, বিলাস কী নয় তার?


নৌকা চলে কূল বরাবর। দোলা খায়।
তালে তালে কখনোবা সতা গান গায়
ভাটীয়ালি  সুরে।  সুর  বহু  পুরাতন,
তবু  কথার  বাঁধনে  এসেছে  নুতন
নয়াসমাজের ডাকে। ব্যথার আঁচড়ে
সুর বয়ে চলে আর প্রতিধ্বনি ফেরে।


হঠাৎ  বিরতি।
              'হেই  বাপ ! দেখ্  দেখ্
বিরাট কাঠাম। '
               'তাই তোরে!লৌকো রাখ
উটার  গায়েতে, উজানে  বাইয়ে  চল্
জলদি উদিকে। '
                    বেটা  মতির  উজ্জল
চোখ।  দুগ্গা  মাঈ  বুঝি  মাগ্গি  দেখে
নিজিই এয়েচে।
                   মনে মনে স্বপ্ন এঁকে
সতা ভাবে কাল,ছোট জামাগায়ে দেবে,
চাল  ডাল  কিনে  বুঝি লুঙ্গিটাও  হবে,
বিশাল কাঠাম!    
                  লম্বা বৈঠা নিয়ে হাতে
ছেলে  তার ব্যস্ত বড় উজানে বাহিতে,
মনের আবেগ বয় স্রোতকে ছাপিয়ে।
কতদিন পরে চুলা নিয়ে মায়েঝিয়ে
ঝগড়া হবে কাল। হূক্কারডান্ডি নেড়ে
মজা লুঠবে সতা।
                    ' রশিটা আঁট করে
ফাঁস মার।হাল ধরি আছি আমি,তুই
হিঁচকে টানডা মার।বাঃ দেখদেখ ঐ
দুগগি মার  আপন  দয়াতে, কাঠাম
এটিছে ফাঁসে।ধিরি আয়। '
                            মাথার ঘাম
পায়ে ফেলা সার্থক ক'রে দেবী কঙ্কাল
ধরা দেয়।বারেক নৌকা দোলে উত্তাল
দোলে।বাঁধা পরে  ঠাকুরের লাশখান।
হেলেদুলে নৌকা চলে।
                         ভাঁটিয়ালী গান,
নতুন উদ্যমে ফের  মুক্তি পায় সেথা।
কোমোল রাগিনী এক অভাবের কথা
আর দুঃখেরব্যাখ্যান।আাশা ছিলোযতো
ফুটে  ওঠে  একেএকে , ছায়াছবি মত
গানের কলিতে।
                  'ওঠ মতি, ঘাট এলো,
চল বাবা, কাঠামটা তোল। '
                             বাঁশ নিলো
বাপবেটা দুজনায় কাঁধে। বেঁধেছেদে
কাঠামটা তায়,ভালো করে এঁটে,সিধে
রওনা দিল ওরা,  লক্ষ্য কুমোর পাড়া,
মোটে একক্রোশ,তারজন্য ভ্যানভাড়া!
সে অসম্ভব। কাঁধে ওঠে ঠাকুর মড়া।
মাঝখানে বদ্ধ কাঠামটা রেখে ওরা
পালকি চলে তালে দুলকি চালে চলে।
মাঝমাঝে ঠান্ডাতেও ঘাম ঝেড়ে ফেলে,
তবু চলে।
           বসাবসা  চোখ,  ঘোলাদৃষ্টি,
পাঁজর  নজর  বুক,  সমাজের  সৃষ্টি
এ এক বিচিত্র গড়ন,  কাঁধেতে দেবী
অধিষ্ঠিতা, কঙ্কাল রূপিনী। যদি ছবি
আঁকাযেতো,পুরস্কার মিলেযেতো ঠিক,
ছবি মিউজিয়মের এক নির্মম নির্ভিক
প্রতিশ্রুতি রূপে।কোন কোটিপতি হাতে
বিক্রি হত ছবিখানা আর্ট গ্যালারিতে
মাধুর্য্য বাড়াতে !
                    কুমোরপাড়ায় আসে
বাপবেটা মিলে।কাঠামটা রেখে,শ্বাসে
বুক  ভরে  নেয়।  পথ  চলা শেষ হয়
বাপবেটা  দুজনেই  এখন  নির্ভয়।
' হেই দুখীর বাপ, আয় দেখবি আয়,
কাঠাম এনেছি এক; সামলানো দায়-
ইত্তো বড় সিটা। ঠাকুর বানাতি গেলি
পেথ্থম মশল্লা খান  বড়সর  হলি
তবেই না খাসা! কি বলিস? দে দে
দামটা চুকায় দে,বাজার করবো গে।
দরজা  খুলে  দুখীর  বাপ  শুনছিল,
খোঁচাদাড়ি চাঁছামাথা কাঁছাবেঁধে নিলো
কাঠামটা দেখে আনমনে বলে "বটে!
কাঠামটা বেশ বড়ো! "
                        আনন্দের চোটে
সতা লাফ দিয়ে ওঠে।'ভালই মিলবে
খুড়ো তাই লয়? কিগো? কত দিবে?'
সতার  গলায়  বেশ  উৎকন্ঠা ভাব,
ভাল করে লখে খুড়ো জুড়লো জবাব,
"ওমা!একি? এযে ঘুনেধরা!আরকুনো
লুতন ঠাকুর হবে না ইটাতে। শুনো,
কাঠামটা  বদলাতি হবে। জুত সই
লয় একদম।
                নীরব  প্রতিক্ষা।  অথৈ
সাগরথেকে তোলাঝিনুক মুক্তোছাড়া
জেনে,ডুবুরির ক্লান্তিভরা মনে, ফেরা।


বেশ  কলরব।  একদল  চাটুকার
নিয়ে, ফুলবাবু চলেছেন বিজয়ার
শুভাশীষ দিতে।কাঁধেশাল কোঁচাধুতি
গিলেকরা পান্জাবী,উচ্ছল তার গতি।
বাতাস আতর গন্ধে বেশ মাতোয়ারা।
পথের  দুধার  জুড়ে  শীর্ণ  মানুষেরা
কানাকানি করে।তাদের হটাতে ব্যস্ত
লেঠেলের দল।ডান্ডা নিয়ে সেকি মস্ত
হাঁকাহাঁকি,হেই  হট..  ফুলবাবু যাবে।


সতা ভাবে - কাঠামটা বদলাতি হবে।


                 তাং : ১৯/০৪/১৯৭৪      
           গিরিবালা ঘাট, আগড়পাড়া