প্রভাত ফেরির আওয়াজেই ঘুমের বারোটা।
স্মরণীয় দিনগুলোর এক‌টি পরিচয় থাকে।
এই যেমন ধরুন না কেন -
কোন এক শারদ প্রভাতে যখন শুনতে পাই,
'শুরু হচ্ছে আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান,
চারশো সাতচল্লিশ দশমিক আট মিটারে'।
শিউলি ফোটা সেই সকালে,
মনের মধ্যে ঢাকের আওয়াজ,
আর কেমন যেন পুজোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে,
নয় কি?


তেমনই করে শ্রাবণ আকাশে,
স্বাধীন মেঘের  আনাগোনায় প্রভাত ফেরি-
ক্যালেন্ডারের পাতা না উল্টেও,
ঠিকই বোঝা যায়।
আর তার মধ্যে যেটি সুবর্ণরঞ্জিত,
অবশ্যই তা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী-
এ কী আর কোনো বলার অপেক্ষা রাখে?


প্রাইমারি স্কুলের গনিত শিক্ষক ভুবনবাবু -
একসময়ে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক,
তাঁর উদাত্তকণ্ঠের ভাষণ,
শ্রদ্ধেয় শহীদদের আত্মত্যাগের বর্ণনা,
আমাদের চেতনা উদ্দীপ্ত করে তুলতো,
                     সেই স্বাধীনতার সকালে।
"Give me blood, I shall give you freedom "
কথাগুলি তাঁর নান্দনিক সুগম্ভীর আওয়াজে,
মনে হতো নেতাজির কণ্ঠনিঃসৃত বাণী।


বিনয়,বাদল, দীনেশের আত্মবলিদান,
বাঘাযতীন বা ক্ষুদিরামের দেশপ্রেমের সম্পর্কে,
তাঁর বর্ণনা -
আমাদের চোখে ছবি আঁকতো,
এক স্বপ্নের পুরুষের।
মনে হতো, ওরাই ছিলো যেন,
স্বাধীনতার এক একটি উৎস সোপান।


বৃত্তি পাশ করার পরে,
মাস্টারমশাইকে গেলাম প্রণাম জানাতে,
দেখলাম,
সজল নয়নে তিনি রতনকে বলেছেন,
"ওরে! তোর মধ্যে আগুন আছে,
সেই তাপ হারাস নে কক্ষনো,
আমরা তো শেষ পারাণির কড়ি গুনছি,
তোদের সামনে তেপান্তর,
সত্যকে সঙ্গী করে এগিয়ে চল,
দেখবি কোন বাধাই বাধা নয়,
চরৈবেতি...."


হিংসে হচ্ছিল আমার,
হতে পারে রতন ক্লাশের ফার্স্ট বয়,
হতে পারে অনেক কিছুতেই ও এগিয়ে,
গান,আঁকা, আবৃত্তি এমনকি
খেলাধুলায়ও ওর জুড়ি মেলা ভার,
তা ...বলে ...


"মনি! কিরে? দূরে কেন? আয়,
কাছে আয়"


সম্বিত ফেরে তাঁর  আত্মিক স্পর্শে,
ভুল ভেঙে যায়,
ওর কাছে আমাদের একমাত্র পরিচয়,
আমরা এই দেশের সন্তান।
লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে গেল।


হাইস্কুলে কেউ কারো খোঁজ রাখে না,
তাই, এরপর থেকে,
স্বাধীনতার সকাল কাটতো
ক্লাব প্রাঙ্গণে, বেশ আনন্দে, হুল্লোড়ে...


এমনই এক স্বাধীনতার সকালে,
মাস্টারমশাই চলে গেলেন ভোরের আলোর টানে,
নক্ষত্রের পতন আকস্মিক,
যেন স্বাধীন বুলবুলির উড়ে যাওয়া-
শেষবারের মতো স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে।
স্বজনহারানোর ব্যথায় সে বার,
রুদ্ধ হয়ে আসছিল বক্তাদের কণ্ঠ,
আশ্চর্য! তিনি যেন এক নতুন শহীদ।
বিপত্নীক মাস্টারমশাইকে ঘিরে ছিলো,
তাঁর অসংখ্য সন্তান,
শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলো আপন পিতৃবোধে।
আমিও ভাবছিলাম বারবার,
সেই অমোঘ বাণী,
সত্যকে সংগী করে এগিয়ে চল...।


স্বাধীনতার পঁচিশ বছর!
শ্রাবণের আকাশ থমথমে,
যেন সমাজজীবনকে ঢেকে রেখেছে,
এক বিভীষিকার চরম অন্ধকারে,
নিদ্রিত এক আগ্নেয়গিরির ক্রমাগত উদ্গিরণ,
জৌলুস হারিয়েছে রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠান,
বক্তব্য রাখছে তৎকালিন ক্লাব সম্পাদক।


"ভাইয়া...খোচড়....কেটে পড়ো..
   জলদি ভেগে যাও..."


সুতীব্র চিৎকারে বন্ধ অনুষ্ঠান।
পলক না ফেলতেই,
স্টেজ থে‌কে রতন উধাও,
পালিয়ে বাঁচলো সাবধান করা ছেলেটিও।
কেউ ধরা পড়লো না।


ভাবতে অবাক লাগে,
কেমন করে হারিয়ে গেল,
ভুবনবাবুর সেই আগুন ঝরা ছেলে,
নাঃ! আর ফেরেনি রতন।
জানিনা, আজো সে বেঁচে আছে কি না,
মাস্টারমশাইয়ের কথামতো
সত্যের পথ অবলম্বন করে।
শুধু এইটুকুই জানি,
স্বাধীন হলো রতন,
স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে।


বিভীষিকাময় দিন চিরস্থায়ী হয়না,
মেঘ কাটবেই একদিন,
তেমন করেই এলো পরের দশক।


সন্ত্রস্ত মানুষেরা শান্তি ফিরে পেলো,
সংঘাতের দিনে ফেরা - আর নয়,
ঘরমুখী জীবন হলো শুরু,
ফায়দা লুটলো অনেকেই,
ক্লাবমুখী জীবনেও ঘাটতির পালা।
ফলবশতঃ সেই দুঃসময়ে
ক্লাবের ভার নিলাম মুষ্টিমেয় কয়েকজন।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক বছর না কাটতেই,
আবারও মৌচাকে মৌমাছির ভীড়।
আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
সত্যের পথ থে‌কে বিচ্যুতি
হয়তো কিছুটা হলো
হয়তোবা আপোসনীতির রক্ষার্থে
বেশকিছুটা ভ্রষ্ট হলাম
চলার পথ থেকে,


তবুও বলব
মনেপ্রাণে তখনই বেশ বুঝেছিলাম,
সামাজিক অবস্থানের নতুন ধারায়,
আমি ছিলাম নিতান্তই বেমানান।


এরপর থেকে
দৃশ্যবদলের পালা বেশ দ্রুতই এগোচ্ছিলো।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ হারিয়ে,
ধীরে ধীরে,
ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন মূল্য পেল।


রতনের বোন মালা স্বাধীন হলো,
অনেক পথে অনেক কাদাঘেঁটে,
আজ তার ওঠা বসা মন্ত্রীমহলে,
বিনিময়ে সংসার বেঁচেছে,
মেয়ের আনা টাকার প্রাচুর্য,
ছেলে হারানোর ব্যাথায় প্রলেপ দিয়েছে।


আজ আর মালার ভাবতেও ইচ্ছে করেনা,
সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো!
ওর জীবনের প্রথম বসন্ত,
কোথায় হারিয়ে গেছে ...


ভাবতে অবাক লাগে
রতনের বন্ধু বিকাশের প্রেমে পড়েছিলো,
আজকের মডগার্ল মালা,
ওর একসময়ের স্বপ্নরাজপুত্র বিকাশ
আর বিকশিত হলো কই?
স্রেফ ফালতুর দলে,
Idealism নিয়ে বসে ছাপাখানায় ধুঁকছে।
যত্ত backdated fools.


ব্যক্তিস্বাধীনতা ছড়াচ্ছে সংক্রামক ব্যাধির মতই।


বাবা মায়ের স্বাধীনতার প্রতিযোগিতায়,
অবহেলিত, নিঃসঙ্গ প্রতীক স্বাধীন হয়েছে।
Rapsong এর মত Rapid জীবনে,
উন্মাদনা খুঁজে বেড়াচ্ছে দিনরাত্তির।


শ্রমিকের স্বাধীনতার চাপে,
কারখানার যন্ত্রে মরচে ধরে গেছে।
জমি বিক্রির টাকা পাচ্ছে মালিক-দালাল,
মধ্যবিত্ত পাচ্ছে নতুন নগরী।


ব্যবসায়ী মহলের স্বাধীনতা,
দাবা খেলছে রাজনীতি নিয়ে।
তাদের দাবার মন্ত্রীগণ,
এখন আর সততার দাবীও করে না।
'কোন দলে কত কম অসৎ এর ভীড় '
সেটাই একমাত্র মাপকাঠি - সততার!


ট্রেনে বাসে ভীড়ের থে‌কে-
প্রাণ বাঁচা‌তে গিয়ে,
রাস্তাঘাটে কটূক্তি হতে-
সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে,
স্কুল টপকে কলেজে যাবার-
অশালীন চাহিদা মেটাতে গিয়ে,
কিম্বা, বেকার ভাতার অন্যায্য দাবী-
সংগ্রহের জন্যে ছোটাছুটি করতে গিয়ে,
যখনই বিতৃষ্ণা জমতে থাকে-
সারাটা বছর জুড়ে...


তেমনি সময়ে,
গুমোট কাটাতে শ্রাবণ ধারা-
স্বাধীনতার রূপে এসে হাতছানি দেয়!
আবারও এক বছর স্বপ্ন তৈরী করতে।


এমনভাবে স্তরে স্তরে-
স্বাধীনতা ছড়াতে ছড়াতে,
আজ,
সুবর্ণ জয়ন্তী লগ্নে স্বাধীনতা।


স্বভাবতঃই আনন্দের জোয়ার এসে গেল,
আমাদের ক্লাবেও নেই ব্যতিক্রম ...
নামজাদা নেতা আসছেন পতাকা তুলবে,
প্রভাতফেরির আওয়াজও তাই ...
তুঙ্গে এ বছর।


"বাবা, ওঠো, ক্লাবে যাবে না? "
ঝিমুনি ভেঙে যায়, মেয়ের ডাকে।
মেয়ে আমার এই দিনটির রুটিন জেনে গেছে,
সাত-সাতবার ওর জীবনে এসেছে এই দিন,
সকালে ক্লাব, সেখান থেকে স্কুল,
বিকেলে বেড়ানো সেরে হোটেলে খাওয়া,
দারুণ কাটে দিনটি বরাবর।


"শুনছ! উঠে পড়ো, চা রেডি,
আর হ্যাঁ, স্কুল থে‌কে ফেরার পথে
একটু মাটন নিয়ে এসো। "
উৎসবের দিন বা স্মরণীয় কোনো দিন,
শাকচচ্চরি মার্কা হতেই পারে না।
কপাল ভালো সক্কালেই বলেনি,
"শুনছ! আজ স্বাধীনতার দিন,
আমিও স্বাধীন!
আজ আর কোনো রান্না নয়,
হোম ডেলিভারিতে খবর দাও,
বিরিয়ানি আর কষা..."
বলতেই পারতো, দাবীও সংগত,
সুবর্ণজয়ন্তী বলে কথা...।


দাঁতব্রাশ করে, মেয়ের হাত ধরে, চটি গলালাম,
যেতে যেতে মেয়ের আমার প্রশ্নের ফুলঝুরি,
আচ্ছা বাবা, ইংরেজরা খুব দুষ্টু ছিলো, তাই না?
গান্ধীজি বুঝি সবসময় সত্যি কথা বলতেন, নাঃ ...
জানো দিদিরা বলেছে,
মাস্টারদা নাকি খুব সাহসী ছিলো?
অবাক হয়ে ভাবছিলাম,
ওরা বেশ এডভ্যান্সড,
আমরা ওই বয়সে এতো নাম শুনিই নি ...


ক্লাবে পতাকার নীচে ভীড় করে আছে,
নীলু,মন্টা,নাড়ুদের দল,
ওরাই এখন ক্লাবের মধ্যমনি,
চাঁদা তোলা, ব্যাণ্ড শেখানো, ট্রেনার খোঁজা,
সবেতেই ওরা।
উৎসাহে ঘাটতি নেই এতটুকু,


তবুও পতাকা উঠছে না।


কানাঘুষায় জানা গেল,
পতাকা তোলার দড়িটা ছিঁড়ে গেছে,
পতাকার নীচে যারা দাঁড়িয়ে আছে,
তাদের উপরে ভার পড়েছে - অতিথি আপ্যায়ন,
এই দুচারজন যারা কিছু বলতে পারে,
বাকিসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজে ব্যস্ত।


জরাজীর্ণ দড়িগাছা পরে আছে,
টুকরো টুকরো হয়ে,
অনেক বছর পতাকা বয়ে,
এখন প্রাচীনের দলে।
একগাছা নতুন রশি দরকার।
বৃষ্টি ফুড়ে চড়া রোদ্দুর,
এ ওকে ঠেলছে, যাচ্ছে না কেউ,


দোকান বলতে বড় রাস্তার মোড়,
হেঁটে গেলে দশ মিনিটের পথ,
ক্লাব সম্পাদক অরুণের গলা পেলাম,
"যা না বাবা সন্টে,
পল্টার দোকান থে‌কে,
আমার নাম করে -
হাত চল্লিশেক,
নাইলন দড়ি নিয়ে আয়..."


"বাঃ! সব ব্যাটাকে ছেড়ে,
এবার নরম মাটিটা পাকড়ালে!
নেহাত তোমার মুখের ওপরে,
'না' বলি না, তাই...
যাক্, সক্কালবেলা হুজ্জুতি ভালো লাগে না।
দাও! একটা সাইকেল দাও।
নইলে এ মিঞা নড়বে না এক পাও,
হ্যাঁ বাবা, সাফ কথা একদম।
বাপরে বাপ। যা ঠা ঠা রোদ্দুর!
ভেবেছ, বার খাইয়ে ক্ষুদিরাম বানাবে!
সেটি হবে না..."


বিবর্ণ হয়ে গেল সুবর্ণ জয়ন্তী!
চট্‌ করে মেয়ের হাত ধরে বল্লাম,
"চল্ মা, দড়ি এনে পতাকা তুলতে দেরী আছে,
স্কুলে যাবার সময় থাকবে না। "


যাবার পথে আবার মেয়ের প্রশ্ন,
"বাবা, ক্ষুদিরাম কি চকলেট বার
খুব ভালোবাসতো? "
"কে বলেছে? "
"কেন, সন্টে দা বলছিলো যে! "
"আঃ!তোমাকে না বলেছি -
বড়দের সব কথায় কান দেবে না।
চলো, দেরী হয়ে যাবে। "


সঠিক উত্তর না পেয়ে,
আমার গম্ভীর গলা শুনে,
মেয়ে চুপ হয়ে গেল।
তার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে বুঝলাম,
সে আঘাত পেয়েছে।


ও আঘাত পেলো,
কথাটার মানে না বোঝানোয়,
আঘাত আমিও পেলাম,
কথাটার মানে বোঝার যন্ত্র‌নায়,


তবুও,
ঘোর অন্ধকারে যেন একটু আলোর সাড়া,
আমি চাই,
সুবর্ণ জয়ন্তীর এই সকাল থে‌কে,
নিজেকে দর্শকের আসনে বসিয়ে,
দেখে যেতে,
ভবিষ্যৎ এর এই সরল জিজ্ঞাসা,
মাস্টারমশাই এর সত্যকে সঙ্গী করে,
কতদূর চলতে পারে,
বাধাহীন ভাবে।


আজ এটাই শুধু লক্ষণীয় ,
আমার ....আমাদের .....।


                 -- :    য ব নি কা     : --


                       বাসভবন, পানিহাটি।
                            (১৪/০৮/১৯৯৭)