জয় গোস্বামীর কবিতা আমার ভালো লাগে তাই মাঝে মধ্যে একটু চোখ বোলাবার ট্রাই করি। আসলে মানুষের জীবনে এমন কিছু অদ্ভুত অনুভব থাকে, যা ভাষায় ধারণ করা যায় না—তবু কেন জানি আমরা তার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারি না! তেমনই এক অনুভবের নাম "অতল"। এই শব্দটি শুধু একটি গভীরতার দ্যোতক নয়; এটি সেই সব অবচেতন আবেগের প্রতিনিধি, যা আমাদের মনের গোপন প্রকোষ্ঠে দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকে, কিন্তু কখনো কখনো এগুলো জেগে উঠে আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কেন যায় তার ব্যাখ্যাও বৃহৎ!
"অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে"—
এই দুটি পঙ্ক্তি যখন পড়ি চিন্তা করি ,কী ছিল এর মধ্যে? জয় গোস্বামী কী তার এক পরিহাসময় পুনর্মিলনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এর মধ্য দিয়ে? এক অতলস্বরূপ সত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটলেও তাকে চিনতে না পারার দুঃখ যেন হৃৎপিণ্ডকে বন্যার জলে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। অলকানন্দা এখানে শুধুই একটি নদী নয়, বরং স্মৃতি ও আবেগের একটি প্রতীক, যা কবির হৃদয়ে ভর করে বয়ে গেছে মিলেছে সমুদ্রদূরে।
"করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে"—
এখানে এসে কবি যেন সেই অতল সত্তাকে আহ্বান জানাচ্ছেন আনন্দের প্রস্তুতি নিতে, এবং সেই গোপন লিপিগুলিকে আবার পাঠ করতে, যেগুলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে লুকিয়ে আছে। এই "লিপি" একদিকে স্মৃতির নিদর্শন, অন্যদিকে আত্মোপলব্ধির এক গোপন গদ্য। পাহাড়ের সানু যেমন সহজে দৃষ্টিগোচর নয়, তেমনি আমাদের জীবনের কিছু স্মৃতি বা অনুভবও রয়ে যায় ঝাপসা, হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রাচীন চিহ্নের মতো।
"যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো"—
এটি অনেকটা আবেদনের মতো শোনায়। আমরা সকলেই জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে নিজেদের হারিয়ে ফেলি—শারীরিক নয়, মানসিকভাবে। জয় গোস্বামী এই পঙ্ক্তিতে সেই হারিয়ে যাওয়া আত্মাকে পুনরুদ্ধার করার অনুরোধ রেখেছেন—হয়তো নিজের ভেতরের সেই একাকী শিশুটিকে, অথবা এক প্রিয়জনকে।
শেষ তিনটি পঙ্ক্তি—
"করেছো, অতল; করেছিলে; পড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;"
এখানে তিনি উপলব্ধি করেন, অতল শুধু তার সাক্ষাৎ দান করেনি, বরং তাকে অতীতের একটি মূল্যবান লিপি বা চিহ্নও মনে করিয়ে দিয়েছে। সেই লিপি—যা ভুলে গিয়েছিলো—হাত থেকে পড়ে গিয়ে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিল। অতল তাকে আবার দেখিয়ে দিলো, আবার হাতে তুলে দিলো—এই "মনে করিয়ে দেওয়া" আসলে স্মৃতি ও আত্মচেতনার এক আশ্চর্য পুনরাগমন।আমি তাইতো জয় গোস্বামীর বৃহৎ পান্ডিতে মুগ্ধ।