মিহিরপুরের নন্দগোপাল
রেদুয়ান রায়হান


মিহিরপুরের বর্গাচাষী শ্রী নন্দগোপাল ঘোষ
মাটির বুকে মাটির বাড়া মাটির সে মানুষ,
দু'বেলাতে দু'মুঠো ভাত খেয়ে কোনমতে
কাটছিল দিন লড়াই করে দরিদ্রতার সাথে।
নিত্যদিনের দৈন্য তারে দিক না যতই দুখ
তবু সংসারেতে ছিল তাহার ভালবাসার সুখ।
বাপ-দাদাদের রেখে যাওয়া নগ্ন ভিটের 'পরে
নন্দগোপাল তুলেছিল ছোট্র একটা কুড়ে।
মাথা গোঁজার এতটুকু  ঠাঁইখানি সে পেয়ে
নন্দগোপাল থাকত স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে।


বড় মেয়ে অঞ্জলি ঘোষ বয়স হবে কতই
সরল মনের মিষ্টি মেয়ে ঝর্ণাধারার মতই,
বর্ণমালার শিক্ষাটুকু জুটেছিল ভাগ্যে যার
অনটনের সংসারেতে এগুনো আর হয়নি তার।
নন্দগোপাল ঘুরছে এখন ভাল ছেলের খোঁজে
পেলে তারে মেয়ের বিয়ে সারবে নয়ন বুজে।
গাঁয়ের লোকে অঞ্জলিকে দেখছে বাঁকা চোখে
কদিন পরেই বাঁকা কথা ফুটবে  তাদের মুখে।
বাঁকা চোখের বাঁকা মুখের বাঁকা বাঁকা কথা
রোখার মত ঢালখানি নন্দ পাবে কোথা!


ছোট্র মেয়ে মঞ্জুলি ঘোষ,  বয়স হবে নয়
তারে নিয়ে পিতার মনে ছিল না সংশয়,
পড়ালেখায় ভীষণ ভালো, দুষ্টুমিতেও পাকা
ভালই ভালই চলছিল তো নিত্যদিনের চাকা।


নন্দর বউএর একদা হঠাৎ হইল কঠিন রোগ
করিতে লাগিল বউটি তাহার ভীষণ যাতনা ভোগ,
সাধ্যে তাহার যেটুকু ছিল করিল সবই তার
তবু হয়না লাঘব,  বাড়ছে রোগীর যন্ত্রণার এ ভার।
চিকিৎসাতে ফুরিয়ে গেল হাতের সকল টাকা
কর্জ করার পথগুলো সব কর্জ দিয়েই ঢাকা।
করবে কি সে ভাবিয়া তাহার নিদ্রা হইল গত
সঙ্গিনী কি হারিয়ে যাবে চিরদিনের মত।
ভাবিতে যখন তাহার বুকে বিধিল বিষের ব্যথা
সহসা তাহার পড়িল মনে কৃষ্ণবাবুর কথা।
নিশ্চয় বাবু পারিবে না তারে ফিরাইবে খালি হাতে
তাই সে ছুটিল বাবুর দুয়ারে শ্রাবণের এক রাতে।


নন্দগোপাল অন্ধ আশায় করিল করুণ আর্জি
শুনিয়া তারে আশ্বাস দিলেন কৃষ্ণকান্ত মুখার্জি,
বলিলেন তিনি, "যত লাগে টাকা আমি দেব সবই তার
তুই শুধু দিবি সাদা কাগজে টিপসই একটিবার।
মানিয়া শর্ত ব্যকুল নন্দ নিল হাতে টাকা শত
টিপসই দিল সাদা কাগজে অন্ধজনের মত।
দেখিয়া তাহা হাসিলেন বাবু তৃপ্তির হাসিখানি
নির্বোধ নন্দ বুঝিল না এ যে কিসের বারতা বাণী।


বাড়ি ফিরিয়া দেখিল নন্দ মুঢ়ের মত চেয়ে
মাথা কুটিয়া কাদিয়া মরে তাহার দুইটি মেয়ে।
বুঝিল সে যে হারিয়ে গেছে এমন কিছু তার
পাইবে না যা ফিরিয়া আবার কাদিয়া হাজার বার।
নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু আকুল হয়ে নন্দ
প্রিয়ার সনে করিল এবার অর্থহীন এক দ্বন্দ্ব,
আমারে না কয়ে চলিলে কোথায় কোন অজানার দেশে
আমি তো হেথায় পড়িয়া আছি দীন ভিখারি বেশে।
যেই টাকা সে আনিয়াছিল করিতে অসুখ দূর
সৎকারে তার লাগিল সবি, বাজিল ব্যথার সুর।


মা হারায়ে মঞ্জুলি ত ভাঙিয়া পড়িল ভীষণ
কোথায় গেল মায়ের আদর, কোথায় মায়ের শাসন?
হৃদয়ে তাহার মা হারানোর ব্যথার বাঁশি বাজে
মায়ের স্নেহের মধুর ছোঁয়াই চাইছে সকাল সাঁঝে।
ক্ষণে ক্ষণে নিঠুর ব্যথা উঠছে মনে জেগে
তাহার মনের সূর্যখানি ঢাকল ব্যথার মেঘে।
অবুঝ মনের অবুঝ আকাশ মানল না আর বাঁধ
মায়ের সাথে মিশতে এবার জাগল মনে সাধ।
দীর্ঘদিনের ভালবাসার ভীষণ স্নেহের টানে
মঞ্জুলিরে নিল মা তার বুকের মাঝে টেনে।
নন্দঘোষের অশ্রুধারা মানল না আর বারণ
কোন প্রকার বার্তা ছাড়াই ঝরল ব্যথার শ্রাবণ।


নন্দ এবার বুনল মনে নতুন আশার জাল
অঞ্জলিরে বুকে ধরেই বাঁচবে চিরকাল।
হঠাৎ তাহার ডাক পড়িল কৃষ্ণবাবুর বাড়ি
ভাবে কর্জখানি শুধতে হবে ডাক পড়িছে তারই।
ভয়ে ভয়ে নত শিরে দাঁড়ায় বাবুর কাছে
বলল,"বাবু, এতদিনে সবি আমার গেছে,
দয়া করে আর কটা দিন সময় আমায় দিন
যেমন করেই শুধব আমি দীর্ঘদিনের ঋণ"।
"কর্জ যা তা যখন পারিস তখন দেখা যাবে,
তোর বসতবাড়ির ভিটেখানি ছাড়তে আজই হবে"।
শুনে তা নন্দ বোকার মত চাইল বাবুর মুখে
প্রশ্নবোধক চিহ্ন আকা হইল তাহার চোখে।
বুঝিয়া তাহা কহিল বাবু," নিজের হাতেই তুই
ভিটে বেচার দলিলখানায় করিয়াছিলি সই"।
নন্দ কহিল, " কোথাও যেন হইতেছে এক ভুল
বেচিনি আমি ভিটেটা আমার সন্দে নাই এক চুল"।
কহিলেন বাবু," সাজিয়া ন্যাকা পাইবি না তুই পার
ছাড়তে হবে ভিটেটা আজি সমই নাই যে আর"।
নন্দগোপাল কাঁদিল ভীষণ ধরিয়া বাবুর পা
বলিল আমার সম্বল সেতো বসতভিটেটা,
এও যদি হয় হারাতে তবে গুজিব কোথায় মাথা
নিষ্ফল হয়ে ফলিল তাহার করুণ মিনতি গাঁথা।


পরদিন কৃষ্ণবাবু সদলবলে হানিয়া নন্দ বাড়ি
বাপ-মেয়েরে করিল বাধ্য চলিতে ভিটে ছাড়ি।
বিদায়ের ক্ষণে কৃষ্ণবাবুর কৃষ্ণ চোখের দৃষ্টি
লোলুপ হয়ে দেখল বিধির অপরূপ এক সৃষ্টি।
অঞ্জলির ঐ চাঁদ বদনের আলো লেগে দুর্জনে
কামনার নষ্ট বাতাস বইল যেন তার মনে।


ঠাইহারা নন্দগোপাল মেয়েটারে ঠাই করে
বিদায় নিল অশ্রুজলে মায়ায় ঘেরা কোণ ছেড়ে।
কোথায় গেল জানল না কেউ তবু জাগে সন্দেহ
গেল কোথায় তার খবর রাখল নাকি আর কেহ।
কৃষ্ণবাবুর দৃষ্টি তবু চলল তাদের খুব কাছে
নিয়তি তারে চোখ রাঙালে কেমন করে সে বাঁচে!
কৃষ্ণবাবুর থাবা হতে বাঁচল নাতো অঞ্জলি
কামনার নষ্ট অনল ঝরিয়ে দিল ফুলকলি।


মিহিরপুরের নন্দগোপাল হারাল তার সকল ঠাই
সব হারিয়ে এখন দেখে হারানোর আর কিছুই নাই।
কৃষ্ণবাবুর কৃষ্ণ মনের কৃষ্ণ কালো অভিলাষ
আসবে  না আর তার জীবনে মুছতে মিছে স্বপবাস।
আশার ভেলা নাই ভাসুক, নাই বা এল তার মনে
কাটুক বেলা স্বপ্নহারা,  ধরার কোন নির্জনে।
নেইতো ব্যথা ভাঙল বলে সাজানো এ সরোবর
আসবে না আর হঠাৎ করে কালবোশেখির কালো ঝড়।
বাঁধবে না আর মনটারে সে নবীন কোন বন্ধনে
ছুটবে না আর নন্দগোপাল নতুন আশার সন্ধানে।(ত্রিশাল, ২০০৫)