আজ দুর্গা অষ্টমী খোকা...
তোর বিদেশে যাওয়া বছর পাঁচ হয়ে গেলো।
এই চৌদ্দতলা ফ্লাটের জানালা দিয়ে
একলা ঘরে রাতের আকাশ দেখছি...
একটা আদখানা চাঁদ উঠেছে শুক্ল পক্ষের!
ঠিক সেদিনের মতো,
যেদিন তুই আমার কোলে আমার ঘরে এলি।
তোর বাবা সারাটা বাড়ি আলোর দীপে ভরিয়ে দিল।
তখন আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকতাম l
তুই আমাদের  একমাত্র সন্তান l  
সারা বাড়িটা জুড়ে শুরু হলো উৎসব।
আকাশে ডানা মেলেছিল সেদিন অষ্টমীর চাঁদ ...
তোর বাবা বললো,তুই আমাদের অষ্টমীর চাঁদ !
এই ঘরের আলোর রশনাই !
আজ আমি খোলা জানালার ধারে,
অষ্টমীর  চাঁদের আলো জানালা বেয়ে
অন্ধকার ঘরটাকে কেমন ভরিয়ে দিতে চাইছে !
তোর বাবার কথা মনে পড়লো অষ্টমীর চাঁদ দেখে l
সত্যিই কি তুই  আমাদের অষ্টমীর চাঁদ...  
এই আলো আঁধারি ঘরটার মাঝে দূর থেকে
দুর্গা মায়ের আরতির ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে l
আর শিউলি সুবাস !
এই একলা ঘরটাকে আরো আরো... একলা করে দিচ্ছে l
তোরা আমাকে ছেড়ে দিলি কিন্তু এই আঁধার,
কক্ষনো ছেড়ে যায়নি আমাকে !
এই আঁধার বড় আপনার আজ l


খোকা আমার কথা তোর মনে পড়ে ?
অবুঝ মনটাযে মানতে চায়নারে,  বড় অবাধ্য l
শুধু তোকে কাছে পেতে চায় ,
তুই ভুলে গেছিস মানতে চায় না l
তাইতো শুন্য দৃষ্টিতে স্মৃতিগুলো
হাওয়ার সাথে ভেসে আসে আমার ফাঁকা ঘরে !


তোর কলেজের দিনগুলো ,
সেদিন কতো স্বপ্ন দেখতিস !
আমি আর আলাদা করে কোনো স্বপ্ন দেখিনি l
মনের সঙ্গে মন, হাসির সাথে হাসি,
দুখের সাথে দুখ তোর সঙ্গে আমার
অদ্ভুদ ভাবে এক হয়ে গিয়েছিল l
একটা ঝোলা কাঁধে ঝুলিয়ে নিতিস ,
আমি হেসে বলতাম ,কি আছেরে  ঝোলায় ?
সর্বক্ষণ বুকে আগলে রাখিস l
তুই বলেছিলিস যা আছে
তুমিতা খালি চোখে দেখতে পাবেনা মা !
আরো আছে রবি ঠাকুর জীবনানন্দ
শক্তি সুনীল নজরুল আরো কতো ...
বললাম আরো  …কি রে বুঝিয়ে বলনা l
যা খালি চোখে দেখতে পাইনা ?
জেরাজেরি করাতে বললি ,
জানো মা…এই ঝোলাতে আছে
সততা, বিবেক,ন্যায়,শান্তি…
শুনতে শুনতে তোর কথায় হারিয়ে গেলাম !
বললাম পারবিতো সারাজীবন ধরে রাখতে ?
অমূল্য সম্পদগুলো তোর ঐ কাঁধের ঝোলায় l
ও হেসেছিলো ,আর আমি তৃপ্ত হয়েছলাম।
ছেলে আমার কি অসীম সম্পদের অধিকারী l
সেদিন চোখ  ভরে এলো জলে l


অবশেষে তোর ইচ্ছে পূরণ হলো l
তুই বিদেশে চলে গেলি l
ফোনে কত কথাইনা হতো ,
কত বড় পদে তুই সুপ্রতিষ্ঠিত l
ওখানকার সংস্কৃতির কথা ,
ওখানকার মানুষের গল্প বলতিস ,
বিলেতে গিয়ে এক মেম সাহেবের সঙ্গে
মেলামেশা গভীর হলো তোর l
তুই আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করলি l
কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর ,
একদিন সে কথাটা ফোনে জানালি আমাকে l
জানতিস মা নিশ্চয় মেনে নেবে ,
বললি,বাবাকে আমার বিয়ের কথাটা বোলো মা l
নিশ্চয়  ভুল বুঝবেনা আমাকে ,
বোলবে দেশে গিয়ে বড় পার্টি দেবো l


কথাটা শুনে কি বলবো বুঝলামনা l
মনে বললাম তোদের ভালো হোক !
অনেক দ্বিধা দ্বন্দ ঝেড়ে মুছে ,
কথাটা বলেছিলাম তোর বাবাকে l
তোর বাবা সংবাদ শুনে নিরুত্তর ছিল l
পরে বলেছিল আমাদের খোকা
আজ সত্যিই মানুষ হয়েছে !
চোখের কোনায় আবার জল এলো l
বুঝিনি এ কোন কান্না..
কোন কান্না সুখের, আর কোনটা দুখের !


তোর বাবা যেদিন স্বর্গ রথে চলে গেল ,
বলে গেলো ভালো থেকো ,জয়া l
বললাম সঙ্গে নেবেনা ?
সে উত্তর আর  এলোনা l
একবুক অভিমান হলো আমার ,
অভিমান, দেখবে কে…
মনে পড়ে, তোর বাবার চলে যাওয়ার দিন ,
ডাক্তার বললো আর নেই l
হৃদরোগে সে চলে গেলো l
মনে হয় বোবা কান্নাগুলো জমতে জমতে
হৃদয়টাকে স্তব্দ করে দিলো!


সেদিন প্রকৃতিতেও দুর্যোগ ঘনিয়েছিলো l
রাতের আঁধার দমকা হাওয়া
তার সাথে বাঁধভাঙা বৃষ্টি l
আমি তোর বাবার নিথর দেহটাকে
একলা নিয়ে বসেছিলাম সারারাত l
বাইরে বইছিল অঝোড় ধারা , আর মনে
তোর অপেক্ষায় ছিলাম
তুই সকালে যখন বললি শোনো মা...
আমার আসা হবেনা ,অফিসের অনেক দায়িত্ব
এভাবে গেলে ক্ষতি হবে l
একটা বড় প্রোজেক্টের কাজ চলছে l
আমি সেদিনও তোকে কোনো উপদেশ দিই নি l
তোর বাবার দেহটা জ্বলে গেলো l
সঙ্গে আমার বুকটাও ছাই হয়ে গেলো l
সেদিনও আমি একলা ঘরে কাঁদলাম l
মনের যত কান্না ছিলো সবটা দিয়ে l


তারপর ধীরেধীরে চোখের জল শুকিয়ে গেলো l
একেবারে  খাঁ খাঁ মরুভূমি !


কয়েক মাস পড়ে, মেম সাহেবকে নিয়ে
যখন ঘরে ফিরলি, বললি কেমন আছো মা...
বাবার কথা খুব মনে পড়ছে l
তোকে কোনো উপদেশ আমি সেদিনও দিইনি l
তুই বড় পার্টি দিলি l
কত বড় মাপের সব মানুষ এলো l
বউমার সঙ্গে সবার পরিচয় হলো l
এমনি করেই বেশ কিছুদিন গেলো
একদিন বললি তুমি সাবধানে থেকো মা ,
আমাকে এবার ফিরতে হবে l
হঠাৎ করে বুকটা কেঁপে উঠলো আমার l
ভেবেছিলাম ...তুই আমাকে একা ছাড়বি না l
সব ভুলে আবার আশা করেছিলাম l


যাবার আগে তোকে একলা ডেকে
শুধালেম,খোকা তোর কাঁধের ঝোলাটায়
একটা মস্ত বড়ো ফুটো কেন !
তুই খানিক নাড়াচাড়া  করে বললি কই নাতো l
বললাম ভালো করে  দেখ ,
অবশ্যই ফুটোটা দেখতে পাবি l
তোকে কিছুক্ষনের জন্য কেমন বোকা দেখাচ্ছিল l
যেমন মায়ের কাছে ছোটোবেলায় বোকা হতিস...
আমি আর তোকে দ্বন্দে রাখলাম না l
বললাম, তোর ঐ ঝোলার ফুটোটা
খালি চোখে দেখা যায় না বাবা !
লক্ষ্য করেছিস যে সম্পদ গুলো তোর ঝোলায় ছিল ,
সেগুলো আর নেই,
মনে পড়ে তোর….সততা, বিবেক,ন্যায়,শান্তি…
যেগুলো তুই একদিন বয়ে বেড়াতিস
সেগুলো আর নেই….
ঝোলাটা ভালো করে খুঁজে দেখ l
কখন ঝোলাটার ফুটো দিয়ে পথের ধূলায় হারিয়ে গেছে
তুই বুঝতেও পারিস নি !
আবার আমার মরুভূমি চোখে  এলো জল l


যাবার সময় বললি প্রণাম করে
খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবো মা l
বললাম একটা কথা আছে ,
তোর কাছে কোনোদিন কিছু চায়নি আমি ,
আজ একটা কথা রাখবি l
পারিস যদি হারানো সম্পদগুলো আমায় এনে দিস
সততা, বিবেক,ন্যায়,শান্তি…  যেগুলো ছিল তোর একান্ত আপন।
খুঁজে নিয়ে আসিস ..আমি অপেক্ষা করবো l
অপেক্ষা করবো জীবনের বাকি দিনগুলো...
তানাহলে আর কোনোদিন আসিসনা ,
আর কোনোদিন না….কক্ষনোনা !
সেদিন চোখ আমার ঝলসে উঠেছিল l
যে আগুন আমার চোখ জুড়ে জ্বলে উঠছিলো !
তুই কোনোদিন দেখিসনি সে আগুন..
সে আগুনে ক্ষণিক আহত হয়ে ছিলিস তুই !
তার চেয়েও বেশি আহত হয়েছিলাম আমি !
তারপর ... তুই চলে গেলি ...
দিন যায়.. মাস যায়.. বছর…
আমি বসে থাকি
খোলা জানালার  পাশে…অন্ধকারে ...
নিথর নীরবতার গ্রাসে...