গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শিশু কিশোর তরুণ যুবক (তরুণ কবি) কবিদের কবিতা পাঠ করেছি। পাঠ করার প্রচণ্ড তৃষ্ণা থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়েছি। অক্লান্ত  পড়েছি। সাহিত্যতত্ত্ব, সাহিত্যসমালোচনা, এবং আরও অনেক বিষয় মগজে রেখে ডাইসেক্টিং টেবিলের ওপরে রেখে কেটে কেটে দেখেছি। কিন্তু হয়েছি উচ্চণ্ড হতাশ। অকবিতায় সয়লাব বইমেলা, বিভিন্ন সাইট, কবিতার পেজ ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশ আক্ষেপ করে এদের 'উপকবি' বলেছিলেন। কেউ কেউ অকবিও বলে থাকেন, আমি বলি 'উনকবি'। এই উনকবিদের সমস্ত লেখাই পদ্য/অকবিতা/চম্পু/খিস্তিখেউড়/প্রলাপ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার কথা প্রবন্ধের নাম প্রবন্ধে বলেছিলেন, "সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি—কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য বিকিরণ তাদের সাহায্য করেছে।" এই হলো জীবনানন্দীয় কবি ও প্রছন্নভাবে কবিতার সংজ্ঞা। বিশ্ববিশ্রুত ইংরেজ কবি-সমালোচক টি. এস. এলিয়ট-এর 'Tradition and the Individual Talent' প্রবন্ধে একই ধরনের অনুরণন পাওয়া যায়। বর্তমানিক সময়ে অ/কবিতার একমাত্র অনুষঙ্গ 'লুতুপুতু প্রেম'। প্রাচীন চর্যা থেকে আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা কবিতার বিষয়-বিস্তৃতির পরিধি ছিলো সীমিত ও সীমাবদ্ধ। রৈবিক ও উত্তররৈবিক যুগে কবিতার বিষয়বল্লরি ছিলো শতমুখী। কিন্তু 'ডিজিটাল' যুগে কবিতার বিষয়বস্তু দেখে মনে হয় আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি সে চর্বিতচর্বণ যুগে। হতাশা শব্দটি গ্রহণ করা মানেই হলো আশাও আছে—অনেক প্রতিভাপ্রবর কবিও আছেন, কিন্তু আমার আলোচনায় বিষয়বস্তু আজ উনকবিদের নিয়ে। সংস্কৃতে কবিতা বলতে বোঝায় 'শব্দাথৌ সহিতো কাব্যং'। ইংরেজিতে কাব্যের একটি প্রভাবশালী সংজ্ঞা রয়েছে: Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings. কবিতা ধারণাটি বহুমাত্রিক। একে যতই পাঠ করবেন ততই নব নব রূপে হাজির হবে, কিন্তু প্রলাপ বা পদ্য একমাত্রিক যার স্ফূরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি হাল আমলে। আর আমাদের রসবোধ আর রুচির অধঃপতনে হতাশ হয়ে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, "এ দেশে রসবোধ যে হৃদয়হীনভাবে বিরল।" কবিতা লিখতে হলে দরকার 'ইমাজিনেশন' বা কল্পনা। জীবনানন্দের ভাষায় 'ভাবপ্রতিভা', কিন্তু আমাদের উনকবিরা কবিতা লেখেন 'ফ্যান্সি' বা চটুলপ্রতিভা থেকে। বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশের দশকের পর থেকে গদ্য কবিতার রণরিণি বাজতে বাজতে এখন এক হ-য-ব-র-ল অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। যেহেতু মানুষ ভাষিক প্রাণী, ভাষার বাহিরে তার তেমন সারবত্তা নেই—এজন্য ইদানীং বিভিন্ন মাধ্যমে 'বটতলার পুঁথি'র পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। যদি ছন্দের প্রচলন থাকতো, অলঙ্কার এর প্রচলন থাকতো, 'অপরিহার্য শব্দ (ডিকশান), 'অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাস' থাকতো, তাহলে এত অকবি/উপকবি/উনকবির ব্যাপন হতো না।
কিছু কিছু অতিআধুনিক কবি আছেন যারা 'বাকচাল' ও 'চমক' এর মাধ্যমে পাঠককে একটা ধূম্রজালে রাখতে চান—গভীর পাঠে তাদের অনৃত মকসুদ ধরা পড়ে। কবিতার শরীর যদি গদ্যের মতো হয় আর নদীর শরীর যদি মরুভূমির মতো হয়- তা হবে বিশুষ্ক বিরস প্রলাপ। তবে তাতে যদি ভাবপ্রতিভা, কাব্যশব্দ, ও কাব্যবল্লরি থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত তাঁর 'আধুনিক বাংলা কবিতার ভূমিকা'য় লিখেছেন, "রোমান্টিক ও প্রথাগত কবিতার মহিমায়ই আমরা আজো মুগ্ধ হয়ে আছি।" উত্তর-আধুনিক যুগে কবিতা যে বিনিমার্ণ করা যায় তা অনেকেরই অজানা। মামুনর অর রশীদ তাঁর 'উত্তর-আধুনিকতা' গ্রন্থে লিখেছেন, "এদেশের কবিতা নির্মাণের চেয়ে জীবনদেবতার মতো 'লিখিয়ে নেয়ার' মাধ্যমে সৃষ্ট; অধিকাংশ কবিই চারণ কবিদের মতো স্বতঃস্ফূর্ত।" কবিতা বিনিমার্ণ করা জটিল ও শ্রমসাধ্য কাজ যা উনকবিদের দ্বারা সম্ভবপর নয়। কিছু 'তথাকথিত  বিখ্যাত' নারী কবির কবিতাও পাঠ করেছি, যেগুলো প্রলাপ, পদ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।