স্বল্পপ্রজ কবি হেলাল হাফিজ। যিনি ভাবেন 'দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ'। দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, হাহাকার, ভাঙচুর, বিরহের অপগত অতলান্ত অনুভূতি ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অধিকাংশ কবিতায়। কষ্ট তাঁর বাঁচার 'মৌল' মালমশলা যিনি নিজের প্রয়োজনে কষ্ট তৈরি করেন। বাংলা সাহিত্যে অনেকে যেখানে সংখ্যাহীন কবিতা বা ত্রিশোর্ধ্ব কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেও কবিখ্যাতি বা যশ মেলেনি, তিনি সেখানে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমেই অর্জন করেছেন তুমুল পাঠকপ্রিয়তা। তিনি মূলত যুগের পালস ঠিকমতো বুঝেছিলেন। সহজ শব্দে হৃদয়ের প্রগাঢ় ও গভীর কষ্টের কথা সুবলিত বাকবল্লরিতে এঁকেছেন। জীবনানন্দের বেদনা-বিষাদ-অন্তর্লীন কষ্ট 'বিপন্ন বিস্ময়'কর যা বুঝতে পাঠকের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে হেলাল হাফিজ ভিন্ন ধরনের। তিনি তাঁর যাপিত জীবনকে করুণ মন্থনে এমন একটি হাহাকার হৃদয়ের পট এঁকেছেন যা অভাবিতপূর্ব। "এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়" কিংবা "নিউটন বোমা বোঝো,/মানুষ বুঝো না"-ছত্রগুলোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পূর্বাপর সময়ের যে 'গ্রাফিক এ্যাজিটেশন' আঁকা হয়েছিল তা ব্যাপকভাবে আলোচিত ও কালোচিত। ১৯৮৫ (দিব্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইয়ে ১৯৮৫, অন্যত্র সবখানে ১৯৮৬?) সালে প্রকাশিত 'যে জলে আগুন জ্বলে' কাব্যগ্রন্থে দুরবগাহ ভাব ও শব্দ বাদ দিয়ে সুললিত, সুগীতল ও সুবলিত সহজ শব্দে যে কষ্টের কথা এঁকেছেন তা অলোকসামান্য। গ্রন্থটিতে মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আমাদের মতে বারোটি কবিতা তুমুল জনপ্রিয়, আট/নয়টি কবিতা অলোক আলোচিত, বাকিগুলো গড়পড়তা হলেও সুখপাঠ্য। বহুদিন বিরতির পর ২০১২ সালে 'কবিতা একাত্তর' নামে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন যেখানে আগের ছাপ্পান্নটি কবিতার সাথে নতুন পনেরোটি কবিতা যুক্ত করেন। 'অচল প্রেমের পদ্য (১-১৩) এবং 'রাখালের বাঁশি' ও 'সুন্দরের গান'-এ হলো মোট পনেরটি। সে অর্থে গ্রন্থটি মৌলিক নয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' কাব্যগ্রন্থটি কবি মৌলিক দাবি করলেও পুরোপুরি মৌলিক নয়। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ছত্রিশটি কবিতার মধ্যে আগের 'অচল প্রেমের পদ্য(১-১৩) এবং 'রাখালের বাঁশি' ও 'সুন্দরের গান' কবিতাগুলো স্থান পাওয়ায় সহিহ মৌলিক বলা যাচ্ছে না। তাহলে নতুন কবিতা যুক্ত করেছেন মাত্র একুশটি। এগুলোর মাঝে তিনটি কবিতা ছাড়া বাকিগুলো এক বা দুই বা তিন বা চার পঙক্তি বা পাঁতিতেই সীমাবদ্ধ। এগুলোকে অণুকবিতা বলা হলেও আমাদের প্রস্তাব মতে এগুলো মূলত 'স্ট্যাটাস কবিতা'। ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া স্ট্যাটাসগুলো সংগ্রহ করেই মূলত বইটি মুদ্রিত হয়েছে। তাই কবিতাগুলোর সাথে পাঠকের এক ধরনের পূর্বপরিচিতি ছিল।
তবে প্রথম কাব্যগ্রন্থের তুলনায় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে (কবির মতানুসারে দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ) কবিকে অনেকটাই নিষ্প্রভ ও কবিসত্তার অদার্ঢ্য পষ্ট বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিরহ-প্রধান এ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে মূলত ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার কষ্ট ও বেদনা মিশিয়ে একটি পাঠকমুখী হাহাকার তৈরি করতে কিছুটা সক্ষম হয়েছেন। 'ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে' কবিতায় প্যারাডক্সের মাধ্যমে তুমুলবিরহ ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে :


"এক জীবনের সব হাহাকার বুকে নিয়ে
অভিশাপ তোমাকে দিলাম,-
তুমি সুখী হবে"


স্ট্যাটাস কবিতাগুলো বিরহ-হাহাকার-অপ্রাপ্তির অতলান্ত করুণ স্পন্দনে মুখর হলেও অধিকাংশ স্ট্যাটাস কবিতা-ই তেমন শিল্পোত্তীর্ণ নয়। মানোত্তীর্ণও নয়। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কবি সাদাত হোসাইন কিংবা ইমতিয়াজ মাহমুদের মতো সূক্ষ্মতা কিংবা সুচারুতা কিংবা ঋদ্ধতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে টিনেজ উপযোগী কিছু ছত্র আবার জনপ্রিয় যেমন :


"তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।"


আবার জটিল জ্যামিতি নামক স্ট্যাটাস কবিতাটিতে নিখুঁত বুনন লক্ষ করা যায় :


"হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয়তো গিয়েছি হেরে
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।"


অন্যদিকে 'বুকের দোকান' কবিতায়  লক্ষ করা যায় কবির ফ্যাটিশ ডিজায়ার যা অভিনব। ছোট্ট আলোচনায় অনেক বিষয়-ই অনালোচিত থাকলো।