একটি সফল কিংবা সার্থক কিংবা শিল্পসমৃদ্ধ কবিতা লেখা কঠিন ও দুরবগাহ কাজ। ইদানীং আমাদের সমাজে ও সাহিত্যে রুচিহীনতার প্যানডেমিক চলছে। এই রোগ ও বিকার কতদিন চলবে তা অনুমান করাও ক্লেশকর। এখানে যে ধরনের হা-হুতাশ করা হচ্ছে তা উত্তরআধুনিকতার সংজ্ঞায় পড়ে না, কিন্তু আমাদের সমাজে চলমান এই সস্তা অনুকরণ বা খিস্তি দেখে নীরবে সহ্য করাটাও ঢের কঠিন। এজন্য-ই রুচির এহেন লাগামহীনতার মিছিল প্রসার্যমাণ।


অনেকদিন ধরেই বেশকিছু সাহিত্যের গ্রুপে ও সাইটে যুক্ত আছি। ওখানকার অধিকাংশ লেখাতেই কোনো চিন্তা-ভাবনার বহিঃপ্রকাশ নেই। ছন্দ না-জেনেই বা না-মেনেই লেখা হচ্ছে সস্তা সব প্রলাপ। আমি অবশ্য ছন্দ না-মানার পক্ষপাতী। আমাদের দেশে কবি মাত্রই স্বভাবকবি। কবিতা যে বিনির্মাণ করা যায় বা করতে হয় তা অধিকাংশ কবি-ই মনে হয় জানেন না। কোনো রকম রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, সমাসোক্তি অর্থাৎ শব্দালংকার ও অর্থালংকার না প্রয়োগ করেই, ছন্দ না মেনেই, ডিকশন বা শব্দশৈলী না ভেবেই, পর্ব ও মাত্রা বিন্যাস উপেক্ষা করেই, প্রচলিত সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে না গিয়েই, কোনো তত্ত্ব না জেনেই শুধু ভালোবাসা-কেন্দ্রিক এক ঘরানার অতি নিম্নরুচির প্রলাপ লেখা হচ্ছে।


নারী ও নিসর্গ এ দুটি অনুষঙ্গ এদেশে খুবই জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক প্রলাপে বা অকবিতায় এখন আর নিসর্গ তেমন দেখা যায় না। নারী বা পুরুষ-কেন্দ্রিক কবিতাই/প্রলাপ-ই এখন সয়লাব। বিরহের প্রলাপ এখানে বেশ জনপ্রিয়। আবার এ অচলায়তনে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আবার অনেকটা বিশুদ্ধতাবাদী। এখানে 'স্তন' শব্দটি প্রয়োগ করা গেলেও এর সমার্থক শব্দ প্রয়োগ করা মাত্রই মধ্যরাতও জেগে ওঠে ভৈরব নাদে। প্রেম ও ভালোবাসা অনেকটা আমাজান নদীর মতো, অথচ আমাদের দেশে তা হলো বগা লেক এর মতো। এখানে শুধু বিরহ নিয়েই অধিকাংশ অকবিতা কিংবা নারী-কেন্দ্রিক প্রলাপ লেখা হয়, হচ্ছে, হবেও।


মূল আলোচনায় ফিরে আসি এবার। পদ্য এবং কবিতার মাঝে বিস্তর পার্থক্য। পদ্য একমাত্রিক অর্থাৎ আপনি একটি লেখা শীতে কিংবা শ্রাবণে, সকালে কিংবা রাতে, বাংলাদেশে কিংবা আমেরিকায়, ফুরফুরে মেজাজেল কিংবা বিষণ্ণতায়- যখন যেখানে যেরূপে পাঠ করবেন তা একই ভাব ব্যক্ত করবে। এর ভাব অপরিবর্তনীয় থাকবে। নিচে কুসুমকুমারী দাশ এর একটি পদ্যের নমুনা দেওয়া হলো :


আদর্শ ছেলে


আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
'মানুষ হইতে হবে'- এই তার পণ।
বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান
নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?
হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়?
চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়?
সে ছেলে কে চাই বল, কথায় কথায়
আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়?
মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান,
তোমরা 'মানুষ' হলে দেশের কল্যাণ।


কিংবা সাদাত হোসাইন এর একটি পদ্যের নমুনা দেওয়া হলো। আমি ওনার সমস্ত স্ট্যাটাস কবিতা, কবিতার বই (যদিও লেখক এসব লেখাকে কবিতা বলেননি) পাঠ করেছি। এতে ঘুরেফিরে বিরহের সুর-ই মুখ্য। সহজ ভাষায় অন্তানুপ্রাস মিলিয়ে লেখাগুলো কেন এত দারুণ জনপ্রিয় তা সহজেই অনুমেয়। ওনাকে কবি না বলে পদ্যকার বলাই শ্রেয়। নিচে তাঁর একটি পদ্যের নমুনা দেখা যেতে পারে :


আয়না


হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই দেখি, তোমার ছায়ায় তুমি নেই,
দাঁড়িয়ে ছিলাম সবুজ ঘাসে, ঘাসের নিচে ভূমি নেই।
তোমার সজল চোখের ভাষায়, যা ভেবেছি রাত্রিদিন,
মেঘের প্রহর কাটলে দেখি, ছুটেছে ট্রেন যাত্রীহীন।
একলা পথিক পথের ধুলোয়, হাঁটল যে পথ হাত ছুঁয়ে,
অবাক আলোয় দেখল জীবন, ডুবছে ভীষণ রাত ছুঁয়ে।
এক জীবনের আঁতুড় ঘরে, যা জন্মেছে বিশ্বাসের,
আরেক জীবন শুধবে সে ঋণ, অপেক্ষাটা নিঃশ্বাসের।
হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই দেখি, তোমার ছায়ায় তুমি নেই,
সবুজ ঘাসের বুকের ভেতর, জলজ জীবন, ভূমি নেই।


উপরিউক্ত লেখা দুটি হলো পদ্য। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যা পড়ানো হয়েছে তার অধিকাংশ-ই ছিলো পদ্য। মধ্যযুগের সাহিত্যও মূলত পদ্য। এগুলো একমাত্রিক। বাংলা সাহিত্যে কবিতা ধারণাটি তথাকথিত আধুনিক কালের। কবিতা ধারণাটি ত্রিমাত্রিক বা বহুমাত্রিক অর্থাৎ এটি আপনি যখন-ই পাঠ করবেন ভিন্ন ভিন্ন ভাবের বল্লরি ও পেশলতা আপনার সামনে নগ্ন হবে। আধুনিক বাংলা কবিতায়ও অনেক পদ্য লেখা হয়েছে। একটি লেখায় ছন্দ ও অন্তানুপ্রাস মেলালেই কবিতা হয় না। কবিতার ভাব, ভাষা ও শৈলী আলাদা। অনেকে আবার সংহত ও সংযত শব্দ-ভাব-অনুষঙ্গ প্রয়োগের পক্ষপাতী। এ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। দুশো বছরের আধুনিক বাংলা কবিতার ধারা কয়েকটি বাক্যে বলা খুবই কঠিন বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেলাম। বর্তমান লেখায় কেউ ছন্দ না-জেনে বা না-মেনে লিখলে তেমন আপত্তি নেই, কিন্তু কবিতার নামে আবেগের সস্তা প্রলাপ খুবই বিরক্তিকর। তবে একজন কবি জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় এবং কাল ও জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বাঁকে ভিন্ন ভিন্ন কবিতা লিখবেন এমনটাই কাম্য। অতি দুরবগাহ ভাব ও ভাষা প্রয়োগের ফলে কবিতার শ্রী নষ্ট হতে পারে কিংবা পাঠকের কাছে প্রলাপ মনে হতে পারে। তাই বলে পাঠকসর্বস্ব প্রলাপ যাতে না রচনা হয় সেদিকেও লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। অনেক সময় পাঠকরাও একজন লেখকের রুচি নির্মাণ করতে পারেন। নিচে জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা পাঠ করা যেতে পারে :


পাখিরা


ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে—
বসন্তের রাতে
বিছানায় শুয়ে আছি;
—এখন সে কতো রাত!
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,
স্কাইলাইট মাথার উপর,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।
তারপর চ’লে যায় কোথায় আকাশে?
তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে।


শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে,
চোখ আর চায় না ঘুমাতে;
জানালার থেকে ওই নক্ষত্রের অালো নেমে আসে,
সাগরের জলের বাতাসে
অামার হৃদয় সুস্থ হয়;
সবাই ঘুমায়ে অাছে সব দিকে—
সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময়?


সাগরের ওই পারে—আরো দূর পারে
কোনো এক মেরুর পাহাড়ে
এই সব পাখি ছিলো;
ব্লিজার্ডের তাড়া খেয়ে দলে-দলে সমুদ্রের ’পর
নেমেছিলো তারা তারপর,
মানুষ যেমন তার মৃত্যুর অজ্ঞানে নেমে পড়ে।
বাদামী—সোনালি—শাদা—ফুট্‌ফুট্‌ ডানার ভিতরে
রবারের বলের মতন ছোটো বুকে
তাদের জীবন ছিলো—
যেমন রয়েছে মৃত্যু লক্ষ-লক্ষ মাইল ধ’রে সমুদ্রের মুখে
তেমন অতল সত্য হ’য়ে।


কোথাও জীবন আছে—জীবনের স্বাদ রহিয়াছে,
কোথাও নদীর জল র’য়ে গেছে–সাগরের তিতা ফেনা নয়,
খেলার বলের মতো তাদের হৃদয়
এই জানিয়াছে;
কোথাও রয়েছে প’ড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে
তা’রা আসিয়াছে।


তারপর চ’লে যায় কোন এক খেতে;
তাহার প্রিয়ের সাথে আকাশের পথে যেতে-যেতে
সে কি কথা কয়?
তাদের প্রথম ডিম জন্মিবার এসেছে সময়।


অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ-মাটির ঘ্রাণ,
ভালোবাসা অার ভালোবাসার সন্তান,
আর সেই নীড়,
এই স্বাদ—গভীর—গভীর ।


আজ এই বসন্তের রাতে
ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে;
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,
স্কাইলাইট মাথার উপর,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর


হালআমলে আরেক ধরনের লেখা খুব-ই জনপ্রিয় যাকে আমি 'প্রলাপ' নামে অভিহিত করতে চাই। পদ্যে অন্ত্যমিল, ছন্দ এসব মানা হয়। কবিতায় এসব মানা হয় কিংবা না-মেনে সুন্দর-সাবলীল-জটিল-অনবদ্য শৈলী-অনুষঙ্গ-শব্দ-অলংকারও প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু প্রলাপে না থাকে পদ্য না থাকে কবিতা। টানা গদ্যে কোনো রকম ভাবনার দম্ভোলি ছাড়াই যাচ্ছেতাই লেখা হয়। মনে করা হয় এতে ডাডাবাদ কিংবা পরাবাস্তববাদ এর প্রয়োগ ঘটেছে। বিষয়টি আদৌও তা নয়। নিম্নে মারজুক রাসেল এর একটি প্রলাপের উদাহরণ :


ওভাবে যারা ওড়না ব্যবহার করে, আমরা তাদের বিশ্বাস করি না


এইসব ক্ষেত্রে আগুন জ্বালালে অন্ধকার আরো সারাৎসার।
চোখ-নাক-ঠোঁট-জিহ্বা হিসেব ধরেছি করতলে।
জলে নামার প্রস্তুতি রোদ যায় ঘাটে;
মেঘ আসবেন, নদী কারো দিন, নৌকা থামবেন-
বৈঠা গেছে মাঝিকে ডাকতে- পোশাক পালাচ্ছে-
ঘর-
যাকে নেব আমাদের, ঘরের মানুষ, রবীন্দ্রনাথের।