আলোকরেখা হীন, অবক্ষয়াপন্ন এক বিষণ্ণ সভ্যতায়
উদ্ভাসিত হলো বঙ্গভূমির অন্তর্গত জাগরণ,
ভাষা, যা আত্মার অন্বয়, চিন্তার বিমূর্ত ব্যঞ্জনা—
তা লাঞ্ছিত হলে, বাঙালি ক্ষুণ্ণগৌরবে জ্বলে ওঠে দীপ্ত প্রতিবাদে।

তৎসম ভাষায় সংযোজিত নীতিকথা নয়,
বরং রক্তসিক্ত মুখবন্ধ,
যেখানে আত্মত্যাগই স্বাধীনতার প্রস্তাবনা।
১৯৫২—ফাল্গুনের নির্মম প্রভাতে,
ধ্বংসকামী রাষ্ট্রচিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়
আব্দুল জব্বার, রফিক, বরকতের প্রলম্বিত ছায়া।
তাদের শোণিতে অঙ্কিত হয়
ভাষার পূর্ণাধিকার।

একুশের মিনার শুধুমাত্র স্থাপত্য নয়,
সেটি এক গর্বোজ্জ্বল জাতিস্মৃতি,
যেখানে পাথরের নিঃশব্দতাও বাঙালির মহাগর্জনে রূপান্তরিত।

তারপর আসে এক প্রত্যাশাশীল সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি—
ষাটের দশকে জাতির বিবেকপুঞ্জের বিস্ফোরণ।
ছয়দফা—শেখ মুজিবের কণ্ঠে এক আত্মনির্ভরতার মন্ত্র,
স্বায়ত্তশাসনের মহা-অভিনয়।
ঢাকার রাজপথে ধ্বনিত হয় স্বাধীনতার পূর্বধ্বনি,
উদ্ভিন্ন হয় জনমানস,
নবজন্ম ঘটে রাজনৈতিক চেতনার।

পূর্ব পাকিস্তানের শস্যভাণ্ডার লুণ্ঠিত,
কারখানার ঘর্মাক্ত শ্রমিকেরা বন্দী নিঃশ্বাসে,
নিষ্পেষিত ভূমি কামনা করে বাঁচার অবকাশ।
ছয় দফা যেন পূর্বসূরি এক বিপ্লবের—
সেই ছিলো নিরুত্তাপ আগ্নেয়গিরির গর্ভের তাপসঞ্চয়।

১৯৭১—এক সন্নিপাতের বর্বর ইতিহাস।
সাতই মার্চের শিখায় প্রদীপ্ত জাতির দিগন্ত,
"এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"—
শব্দ নয়, তা ছিল অস্ত্রসম আহ্বান।

রাত্রি নামে, ঘুমায় না মানুষ,
২৫শে মার্চের বিভীষিকায় ঘরে ঘরে মৃতপ্রায় আর্তনাদ,
অপারেশন সার্চলাইট—
পৃথিবীর ইতিহাসে গর্হিততম হত্যাযজ্ঞের সংজ্ঞা।

নিশাচরের মতো পাকিস্তানি সেনারা
ভ্রাতৃহত্যায় অগ্রসর,
ভস্মীভূত বিশ্ববিদ্যালয়, বিবস্ত্র নারীর আর্তচিৎকার,
পুড়ে যায় পাণ্ডুলিপি, গ্রন্থ, মন্দির, মসজিদ।

তবু বাংলার পলিমাটির মতো অবিনশ্বর
রয়ে যায় প্রতিরোধ,
পাহাড়ে, নদীতে, জনপদে গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধার সংকল্প।
ছাত্র, কৃষক, বৃদ্ধ, নারী—
সবাই হয় যুদ্ধে অমর কাব্যরচয়িতা।

দীর্ঘ নয় মাসের এক নিরন্তর অগ্নিপথ,
প্রতিটি বিজয় একটি বিসর্জনের ফল,
একটি স্বাধীন পতাকা,
যার রক্তাভ রেখা
রফিকের, সূর্যসেনের, শহীদ জননীর প্রতিচ্ছবি।

এটাই বাংলাদেশ—
রক্তাশ্রু-সিক্ত, চেতনায় চিরোজ্জ্বল,
যার মাটি কাঁদে, অথচ মাথা নত করে না।