সস্তায় ফলন বেশি চাহিদাও সঙ্গে,
রক্ষণশীলেরাও বেমালুম জব্দ;
অর্ধ-সাহেবেরা বাসা  বাঁধে বঙ্গে--
হেঁটে হেঁটে ঘেঁটে যায় পরিপাটি শব্দ।


বদন ঢেকেছে জানি বিশুদ্ধ প্রজাতি
কীটে খাওয়া জর্জর পুরাতন অব্দে;
আকাশে বাজে না আর সঙ্গীত প্রভাতী--
বাজার ছেয়েছে এখন হাইব্রিড শব্দে।


          * * *


অবিরাম বৃষ্টিতে দৃষ্টি আচ্ছন্ন হলে
খুঁজে নাও ছায়াপথ  প্রচ্ছন্ন সাধনায়--
নক্ষত্র সঞ্চয় করো গভীর অন্তঃস্থলে;
পাষাণও বিগলিত হয় পবিত্র বন্দনায়।


সন্ধানে হয়রান ভূমিতল-বাজারে--
চারিদিকে সঙ্কর,মিলছে না ভাল জাত!
সাধনায় লব্ধ তারা হাজারে হাজারে
জমে জমে মেঘ হলে হবেই আলোপাত।
------------------------------''-----'
অক্ষরবৃত্ত বলতে অনেকে পয়ার বোঝেন, এবং পয়ার বলতে অক্ষরবৃত্ত। কিন্তু পয়ার বলতে সত্যিই কোনও ছন্দ বোঝায় না, পয়ার আসলে একটা বন্ধমাত্র (অর্থাৎ কবিতার পঙক্তিবিন্যাসের বিশেষ একটা পদ্ধতি), এবং সেই বন্ধে যেমন অক্ষরবৃত্ত, তেমনই মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্তের পঙক্তিকে বাঁধা যেতে পারে। অনেকেই বেঁধেছেন।


কী সেই বন্ধের চেহারা? উত্তরটা সত্যেন্দ্ৰনাথ দত্ত দিয়েছেন। তিনিও অবশ্য পয়ার বলতে আলাদা একটা ছন্দই বুঝতেন (“পয়ার জান না? তুমি যে ছন্দে লিখেছি একেই বলে পয়ার”-‘ছন্দসরস্বতী’), কিন্তু তা হোক, ওই যে তিনি পয়ারের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন “আট-ছয় আট-ছয় পয়ারের ছাঁদ কয়”, ওইটেই হচ্ছে পয়ার-বন্ধের সঠিক বর্ণনা। আট-ছয় বলতে এখানে আট-ছয় মাত্রার বিন্যাস বুঝতে হবে। অর্থাৎ যে-সব পঙক্তি আমাদের পড়বার ঝোক অনুযায়ী দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। (অংশ’ না বলে “পদ” বলাই রীতিসম্মত, কিন্তু পড়ুয়াদের বোঝাবার সুবিধার জন্য আপাতত আমি অংশ’ বলাই শ্রেয় মনে করছি, পদ-এর প্রসঙ্গ এর পরের পরিচ্ছেদে আসছে) এবং যার প্রথমাংশে পাওয়া যায় আটটি মাত্রা ও দ্বিতীয়াংশে ছটি, তাদেরই আমরা বলি পয়ার-বন্ধে বাঁধা পঙক্তি। এখন এই অংশভাগের কথাটা আর-একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, পাঠকের দম নেবার সুবিধের জন্যে পঙক্তির শেষে একটা ভাঙা-পর্ব রাখা হয়, এবং সেই ভাঙা-পর্ব অনেকসময়ে দু-মাত্রার হয়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনার সময়ে আমি এ-ও বলেছিলুম যে, কবিতার “লাইনটাকে যখন একসঙ্গে দেখি, তখন গোটা লাইনের বিন্যাসের মধ্যে ওই বাড়তি মাত্রা দুটি এমন চমৎকারভাবে নিজেদের ঢেকে রাখে যে, ওরা যে আলাদা, তা ঠিক ধরাও পড়ে না। বিশেষ করে ছয় কিংবা দশের বৃত্ত ছাড়িয়ে আমরা যখন চোদ্দো মাত্রায় গিয়ে পৌঁছই, অতিরিক্ত ওই দু-মাত্রাকে তখন ছন্দের মূল চালেরই অঙ্গ বলে মনে হয়।” অর্থাৎ চোদ্দ মাত্রার লাইনটা তখন আর ছোটো মাপের বিচার অনুযায়ী ৪+৪+৪+১২ থাকে না, বড়ো মাপের চালে সেটা ৮+৬ হয়ে ওঠে। এটা যেমন অক্ষরবৃত্তের পক্ষে সত্য, তেমনিই ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্তের পক্ষেও সত্য। যা ছিল ছোটো-ছোটো অংশের সমষ্টি, তা দুটি বড়ো মাপের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই যে দুই অংশে বিন্যস্ত পঙক্তির আট-ছয় বন্ধ, একেই বলে পয়ার-বন্ধ। এই বন্ধে বাংলায় যেমন সেকালে ও একালে অক্ষরবৃত্তের কবিতা প্রচুর লেখা হয়েছে, তেমনি রবীন্দ্রনাথ নিজে ও তাঁর পরবর্তী কবিরা এই বন্ধে মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তেও কম কবিতা লেখেননি।
নিম্নে আদিগন্ত শুধু / সমুদ্র সুনীল
ঊর্ধ্বাকাশে উড়ে যায় / দুটি গাংচিল


এ হল পয়ারে-বাঁধা অক্ষরবৃত্তের নমুনা। তেমনি–


নীচে আদিগন্ত-যে / সিন্ধু সুনীল
ঊর্ধ্বে মেলেছে ডানা / দুটি গাংচিল


এ হল পয়ারে-বাঁধা মাত্রাবৃত্ত। ঠিক তেমনি—


যোজন-যোজন নীলের খেলা / সমুদ্দুরের জলে
ঊর্ধ্বাকাশে শুভ্র দুটি / সারস উড়ে চলে


পয়ার-বন্ধের কথা তো বলা গেল, এবারে খুব সংক্ষেপে মহাপয়ারের কথা বলা যাক। মহাপয়ারের নামেই প্রমাণ, ওটি আর-কিছু নয়, পয়ারেরই একটা বড় সংস্করণ। পয়ার যে-ক্ষেত্রে আট-ছায়ের বন্ধ, মহাপয়ার সে-ক্ষেত্রে আট-দশের। অর্থাৎ মহাপয়ারের বেলায় পঙক্তির প্রথমাংশে – পয়ারের মতোই- আট মাত্রা থাকে, কিন্তু দ্বিতীয়াংশ আরও বড়ো চালে দশ মাত্রায় ছড়িয়ে যায়। দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো যাক। পয়ারের বেলায় যে-দৃষ্টান্ত দিয়েছি, তারই বক্তব্যকে এখানে মহাপয়ারে বান্ধব।


নিম্নে সারাদিন দেখি / আদিগন্ত সমুদ্র সুনীল
ঊর্ধ্বে শ্বেতবিন্দুসম / উড়ে যায় দুটি গাংচিল।


এ হল মহাপয়ারে-বাঁধা অক্ষরবৃত্তের নমুনা। আবার—


নীচে আদিগন্ত-যে / চঞল সিন্ধু সুনীল ঊর্ধ্বে মেলেছে ডানা / সুন্দর দুটি গাংচিল এ হল মহাপয়ারে-বাঁধা মাত্রাবৃত্ত। আবার


যোজন-যোজন দেখছি শুধু / নীলের খেলা সমুদুরের জলে
ঊর্ধ্বকাশে পাল্লা দিয়ে / শুভ্র দুটি সারস উড়ে চলে।


এ হল মহাপয়ারে-বাঁধা স্বরবৃত্তের দৃষ্টান্ত। (হায় চিল, ছন্দের খাতিরে আবার তোমাকে সারস বানালুম!)


পয়ারি-মহাপয়ার প্রসঙ্গ এখানেই শেষ হল। এর পরে আসছে পদ, যতি ও যতিলোপের কথা।