চর্যাপদের পর বাংলা ভাষায় রচিত কবিতার যে প্রামাণ্য গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় তা হল বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন । রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনীই  যার উপজীব্য । আমার এই আলোচনার উদ্দেশ্য সেই কাহিনীর বিবরণ দেওয়া নয়। আমরা অনেক  সময় অবরে-সবরে পরিবারের সবাই  মিলিত হলে আমাদের কীর্তিমান পূর্ব পুরুষের স্মৃতিচারণে এক ধরণের আত্মতৃপ্তি পাই। হয়তো তাদের অনেকেই কমবেশি সেসব কথা জানে, তবু বার বার শুনতে বা বলতে ইচ্ছে করে। আর যতবার বলি বা শুনি ততবার এক অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতিতে চক চক করে ওঠে আমাদের চোখ, গর্বের বাতাসে ভরে ওঠে বুক। এই আলোচনাটিও অনেকটাই সেরকমই স্মৃতিচারণ ।


          স্মৃতিচারণ আমাদের বাংলা কবিতার ঐশ্বর্যময় ঐতিহ্যের। আর সেই স্মৃতিচারণা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না। কারণ বাংলা ভাষায় রচিত দ্বিতীয় প্রাচীনতম কবিতার নিদর্শন আমরা এখানেই পাই। বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা  পাওয়ার ক্ষেত্রেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অবদান কেউই অস্বীকার করেননি । যদিও কাব্যটির আদিরসাত্মক উপস্থাপনা আমাদের আধুনিক মাপকাঠিতে অশ্লীল বলে মনে হতে পারে তবু মনে রাখতে হবে, দেশভেদে অথবা যুগভেদে অশ্লীলতার সংজ্ঞা পৃথক  হয়ে থাকে । ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগের লোকাচারে আদিরসকে অশ্লীল বলে গণ্য করা হত না। তবে আমি এই আসরের মতো একটি মুক্ত অঙ্গনের কথা মাথায় রেখে বিস্তারিত দৃষ্টান্তে যাব না। কেবল তৎকালীন বাংলা ভাষা ও কাব্যপ্রকৃতি কেমন ছিল সেটি অনুধাবনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই উল্লেখ করব।


           1450 থেকে 1500 খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত এই গ্রন্থটি 1901 খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের  জনৈক বাসিন্দা দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে অযত্নে পড়ে থাকা তুলোট কাগজে লেখা এই কাব্যসম্ভারটি উদ্ধার করেন গবেষক বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ।


          মোট তেরটি খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থটিকে কাব্যনাট্য বলা যেতে পারে, যে নাটকে মাত্র তিনটি চরিত্র । রাধা, কৃষ্ণ এবং বড়ায়ি। বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যের উপকরণ জয়দেবের গীত গোবিন্দ, ভাগবত পুরাণ এবং লোকমুখে প্রচলিত নানা গল্প থেকে সংগ্রহ করলেও উপস্থাপনা ও চরিত্রচিত্রণে নতুনত্ব আনেন। দেবত্বের পরিবর্তে কৃষ্ণ ও রাধা চরিত্রে অনেকটাই মানবিক বৈশিষ্ট্য আরোপ করেন। তিনি যেভাবে রাধার মানসিক বিকাশ ও মানসিক টানাপোড়েনের বিবরণ দিয়েছেন তা  কোন যোগ্য মনস্তাত্বিকের  তুলনায় কম নয়। এবার বাংলা ভাষায় রচিত সর্বপ্রথম কাহিনীকাব্যটি থেকে কাব্যরসের  একটি নমুনা তুলে ধরেই এই পর্বের আলোচনা শেষ করব--
(নমুনাটি দেখলেই বোঝা যায়, চর্যাপদের তুলনায় অনেকটাই তখন সহজ হয়ে এসেছে বাংলা ভাষা।)
------------      
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন।।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।।
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।।


(কে বাঁশি বাজায় বড়ায়ি কালিন্দী-কূলে
কে বাঁশি বাজায় বড়ায়ি  গোষ্ঠ-গোকুলে?
আকুল শরীর মোর, ব্যাকুল হৃদয়
বাঁশির সুরেতে রন্ধন এলোমেলো  হয়।
কে বাঁশি বাজায় বড়ায়ি, কোথায় সে ধন?
দাসী হয়ে তাঁর পায়ে সঁপিবো জীবন।
মনের সুখেতে কানু বাজায় যে বাঁশি--
কী দোষ করেছি বলো, আমি সর্বনাশী?
আমার চোখের পানি ঝরোঝরো ঝরে হায়!
বাঁশির সুরে যে বড়ায়ি এ হৃদয় হারিয়ে যায়।)


----------------------------------------
এর পরের পর্বে আলোচিত হবে পদাবলী এবং সেটিই হবে শেষ পর্ব ।