🔰ছন্দশিক্ষার গুরুত্ব🔰


       💄আমিও প্রথম দিকে ছন্দশিক্ষার ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দিইনি । ভাবতাম অঙ্ক কষে কি মনের ভাব প্রকাশ করা যায়? কিছু ছড়াকবিতা ও সনেট ছাড়া বাকিগুলি লিখে যেতাম যেমন খুশি, ছন্দ-মাত্রা বিচার না করেই। তবু সংশয় একটা ছিলই?  সেগুলো কি আদৌ কোন কবিতা হচ্ছে?  সংশয় দূর হল স্হানীয় এক কবির সাথে একান্ত আলাপনে । তিনি বললেন, কবিতা লিখতে হলে ছন্দ জানাটা জরুরি।


        বুঝলাম মাছের সাথে জলের যেরূপ সম্পর্ক কবিতার সাথে ছন্দেরও সেইরূপ।  অর্থাৎ আগের ধারণাটা আমূল বদলে গেল। ছন্দের গুরুত্ব বোঝাতে লিখে ফেললাম একখানি কবিতা । "ছন্দ-দ্বন্দ্ব" নাম দিয়ে প্রকাশ করলাম এই আসরে(30/05/2015)।   তারপর এই আসরের পরিচিত খ্যাতিমান কবি গীতিকার ও ছন্দবিশেষজ্ঞ আবিদ আনোয়ার মহাশয়ের এক আলোচনায় মন্তব্যের ঘরে কবিতাটি কপি পেষ্ট করে দিলাম নবলব্ধ ধারণাটি সঠিক  কিনা তা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে। উনি উত্তরে লিখলেন,
"সহিদুল হক পদ্যের ভাষায় চমৎকারভাবে লিখেছেন ছন্দের গুরুত্ব বিষয়ে। তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ ।"  অর্থাৎ তিনি আমার ধারণার সাথে সহমত।   তখন আহ্লাদে আটখানা হয়ে আরও বেশি করে ছন্দশিক্ষায় মন দিলাম। ছন্দের গুরুত্ব বোঝাতে সেই কবিতাটিই তুলে ধরছিঃ-
---------
ছন্দ-দ্বন্দ্ব
----------


কেউ বলে,'ভাই ছন্দ কিসের? নদী তো বয় আপন বেগে!
বাঁধ যদি দাও হঠাৎ করে কাব্যদেবী যাবেই রেগে।'


রসিক বলে, 'নদীর ভাষা বুঝতে আগে শেখো
ছন্দ জেনে তবেই তুমি নিজের মতো লেখো,
সাগর পাড়ি দিতে হলে শিখতে হবে সাঁতার,
নইলে অহং শুধুই ভড়ং, দোষটা যে ভাই মাথার।


মানছি নদী আপন বেগে চলছে ইচ্ছে মতো,
ঢেউবাদে সে চলতো যদি,বলো কেমন হতো?
দেখছো না ঐ পাহাড় বেয়ে ঝর্ণা কেমন ঝরে
ঝর্ণা তো নয় ছন্দে যেন পাহাড়ের বুক ভরে!


গায়কিটা শিখতে হবেই চাইলে হতে গায়ক
নইলে ধনুক থাকবে হাতে, ভুল নিশানায় সায়ক।
লতা রফি ক্লাসিক জেনেই গায় যে যেমন খুশি,
উর্বরতা চাই যে আগে নইলে সবই ভুষি।


'বই ছাপালেই কবি হলাম' ধারণাটাই ভ্রান্ত,
রসিকজনে রস না পেলে পড়লে হবেই ক্লান্ত।
শঙ্খ সুনীল দাশ রাহমান ছন্দ সবাই জানে
তাই তো তারা ছন্দ ভেঙেও রসের ধারা আনে।


হাসবো না ভাই যেমন বলে রামগরুড়ের ছানা
তেমন করে বলছো শুধুই শিখবো না না না না।
একগুঁয়ে ভাব মানায় কি ভাই চাইলে হতে কবি?
আঁকিবুকি শিখতে হবেই আঁকতে হলে ছবি।


ট্রেকিং শিখে পাহাড় চড়ো, দেবেই শিখর ধরা
নইলে যে ভাই অন্ধ খাদে মিছেই ঘোরাফেরা।'
--------'-'-----
     মনোযোগ দিয়ে দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন , কবি শামসুর রাহমান, সুনীল,শক্তি,
শঙ্খ  প্রমুখ খ্যাতিমান কবিসহ আধুনিক কবিদের অনেকের তথাকথিত  গদ্যকবিতাতেও অক্ষরবৃত্ত , মাত্রাবৃত্ত, মিশ্রবৃত্ত , চতুর্মাত্রিক  অথবা স্বসৃষ্ট কোন না কোন ছন্দের রীতি অনুসৃত হয়েছে।


🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰
                     ছন্দের সহজপাঠ
🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰💄🔰


এই আসরেই ছন্দবিষয়ক খুব ভাল ভাল আলোচনা আছে অনেকগুলি।তবু যাঁরা ছন্দে লিখতে আগ্রহী অথচ ছন্দবিষয়ে এখনও কিছুটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে তাঁদের উদ্দেশ্যে এবং কবি মূলচাঁদ মাহাত-র এই সংক্রান্ত অনুরোধের প্রেক্ষিতেই এই আলোচনার অবতারণা ।


            আমরা সবাই জানি, ছন্দের নানান রীতি প্রচলিত আছে । তার মধ্যে মূল তিনটি রীতি প্রথমেই জানা আবশ্যক । স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্ত । একসাথে সবদিকে তাকাবার দরকার নেই । প্রথমে কেবল স্বরবৃত্ত আয়ত্বে আনার চেষ্টা করুন। শুধুমাত্র এর মাত্রা বোঝার চেষ্টা করুন।
ছেদ,যতি, মিল, পর্ব ও  লয়ের ব্যাপারটা ক্রমশ জানাবো।


           মাত্রা ঠিক রাখার জন্য দল ( syllable)   সম্পর্কে  ধারণা থাকতে হবে। একবারের চেষ্টায় অর্থাৎ এক ঝোঁকে আমরা যেটুকু ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারি সেটিই হল দল।  দল দুরকমঃ-1) মুক্তদল আর 2) রুদ্ধদল।দলের প্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল উচ্চারণের উপর।


         1) মুক্তদলঃ- যে দল উচ্চারণে কোন বাধা পাই না সেই দলকে বলা হয় মুক্তদল। যেমন, অ,আ,ক,মা,সি, ধু,ভূ,লী ইত্যাদি ।


         2) রুদ্ধদলঃ - যে দল উচ্চারণের পর আটকে যাই সেই দলকে বলা হয় রুদ্ধদল। যেমন, দিক,ভুল,এই,কান,যাও ইত্যাদি ।
        
         কয়েকটি শব্দ বিশ্লেষণ করে দেখালে দল চিনতে আরও সুবিধা হবে ।
      কবিতা= ক(মুক্তদল) বি(মুক্তদল) তা(মুক্তদল )।
      যান্ত্রিক = যান (রুদ্ধদল ) ত্রিক (রুদ্ধদল )।
      অবিচার= অ (মুক্তদল ) বি(মুক্তদল ) চার (রুদ্ধদল )
      নিঃসঙ্গ(নিস্ সঙ্গ)= নিস্(রুদ্ধদল ) সঙ (রুদ্ধদল ) গ (মুক্তদল)।
     দৃষ্টান্ত  = দৃষ (রুদ্ধদল ) টান (রুদ্ধদল ) ত (মুক্তদল)।
      আশ্রয় = আশ (রুদ্ধদল ) শ্রয় (রুদ্ধদল )।
* বুঝতেই পারছেন, উচ্চারণই হল আসল মাপকাঠি দলনির্ণয়ের ক্ষেত্রে ।


"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
     স্বরবৃত্ত ছন্দঃ-  অনেকেই একে ছড়ার ছন্দ বলে থাকেন। তবে অন্য ধরণের কবিতাতেও এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।  এই ছন্দে মুক্তদলও একমাত্রা, রুদ্ধদলও একমাত্রা হিসাবে গণ্য হয়। অর্থাৎ এই রীতিতে মাত্রাসংখ্যা, দলসংখ্যার সমান । এই কারণে এই ছন্দকে দলবৃত্ত ছন্দও বলা হয়।


      এই ছন্দ-রীতিতে পূর্ণ পর্ব  সর্বদাই চারমাত্রার হয়। এই খাইছে! পর্ব ব্যাপারটা আবার কি? খুব সহজ। কবিতা পড়ার সময় আমরা কি এক নিঃশ্বাসে গোটা কবিতা পড়ে ফেলি? তাতো নয়।  দাঁড়ি কমা না থাকলেও কবিতার অর্থ  ও ভাব বুঝে  মাঝে মাঝে একটুখানি হলেও থামি। আমরা আসলে থামি পর্বে পর্বে ।   দৃষ্টান্তঃ-


কৃষ্ণকলি / আমি তারেই / বলি
কালো তারে / বলে গাঁয়ের / লোক
মেঘলা দিনে / দেখেছিলাম / মাঠে
কালো মেয়ের / কালো হরিণ / চোখ। (রবীন্দ্রনাথ)
---
কৃষ্ণকলি= এটি পড়ার পর একটুখানি থামি। সুতরাং এটি একটি পর্ব।
দল বিশ্লেষণঃ-
কৃষ্ণকলি = কৃষ্+ ণ+ ক+ লি--
কৃষ্ = রুদ্ধদল  (এক মাত্রা )
ণ=মুক্তদল  (এক মাত্রা )
ক=মুক্তদল  (এক মাত্রা )
লি=মুক্তদল  (এক মাত্রা )
তাহলে দেখা যাচ্ছে 1+1+1+1=4 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ব্যবহার করা হয়েছে।
আমি তারেই =
আ=মুক্তদল (এক মাত্রা )
মি= মুক্তদল  (এক মাত্রা )
তা=মুক্তদল  (এক মাত্রা )
রেই=রুদ্ধদল   (এক মাত্রা )
এ ক্ষেত্রেও 1+1+1+1=4 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ব্যবহার করা হয়েছে।
বলি=
ব= মুক্তদল  (এক মাত্রা )
লি= মুক্তদল  (এক মাত্রা )
এখানে 1+1= 2 মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ব্যবহৃত হয়েছে।
---------
কালো তারে  (2+2= 4 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ।
বলে =ব+লে, (1+1) গাঁয়ের = গাঁ+ এর(1+1)= 4 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ।
লোক= একটাই মাত্র রুদ্ধদল অর্থাৎ এক মাত্রার অপূর্ণ পর্ব  ব্যবহৃত হয়েছে এখানে ।


মেঘলা = মেঘ (রুদ্ধদল ),লা(মুক্তদল )=1+1
দিনে=দি(মুক্তদল ), নে(মুক্তদল ) = 1+1
এখানেও 4 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ।
দেখেছিলাম = দে+খে+ছি+লাম=4 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ।
মাঠে=মা+ঠে= 2 মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ।
কালো= কা+লো= 2, মেয়ের=মে+এর=2 (চার মাত্রার পূর্ণ পর্ব ।
কালো=2, হরিণ =হ+রিণ=2 (চার মাত্রার পূর্ণ পর্ব )
চোখ= একটাই রুদ্ধদল অর্থাৎ এখানেও এক মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ব্যবহার করা হয়েছে ।
    
    সুতরাং কবিতাটির  পর্ব বিভাজন হল নিম্নরূপ --


কৃষ্ণকলি / আমি তারেই / বলি           4+4+2
কালো তারে / বলে গাঁয়ের / লোক      4+4+1
মেঘলা দিনে / দেখেছিলাম / মাঠে      4+4+2
কালো মেয়ের / কালো হরিণ / চোখ।   4+4+1
-----------------------------
স্বরবৃত্তের আরও কয়েকটি দৃষ্টান্তঃ-


1)  ফাগুন বেলা/ পড়ে এল/ বুকটি জলে/ না জুড়াতে     4+4+4+4
     কলস-ভরা/ শেষ হবে সই/ মনের কথা/ না ফুরাতে     4+4+4+4
        (মোহিতলাল মজুমদার )
----
2)  আমায় যদি / হঠাৎ কোনো / ছলে    4+4+2
     কেউ করে দেয় / আজকে রাতের / রাজা
     4+4+2
     করি গোটা / কয়েক আইন / জারি   4+4+2
     দু' এক জনায় / খুব  কষে দিই / সাজা।
     4+4+2
        (প্রেমেন্দ্র মিত্র )
----


3)   মাথার উপর/ ডাকল পেঁচা/ চমকে উঠি/ আরে
      4+4+4+2
      আধখানা চাঁদ/ আটকে আছে/ টেলিগ্রাফের/ তারে
      4+4+4+2
     (অশোকবিজয় রাহা)
----
** আপনারা চাইলে উপরে উল্লেখিত তিনটি কবিতাংশের প্রতিটি পর্বের মাত্রাবিশ্লেষণ করে দেখাতে পারেন মন্তব্যের ঘরে।
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
আশা করি, স্বরবৃত্ত ছন্দটা নতুনদের কাছেও এবার পরিস্কার হয়েছে।তবু যদি কারো কোন প্রশ্ন থাকে নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন।
------------'-



     ছন্দবিশেষজ্ঞ কবি আবিদ আনোয়ারের আলোচনার লিঙ্কটি হল---      
http://www.gaanerpata.com/abid50anwar/prosody-made-easy-introduction/
--------------