🎤 আমার অনেকগুলো লেখাতেই বলেছি যে একজন পরিপূর্ণ কবি হয়ে উঠতে হলে প্রকাশভঙ্গিতে বৈচিত্র্য আনা দরকার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথই নিজের রচনাসম্ভার-এর মাধ্যমে আমাদের সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আজ এমন একজন কবির কথা বলতে চাই যিনি ভাণহীন সাবলীল প্রকাশের মাধ্যমেও আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। যার কাব্যসম্ভার ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বাংলাকে গৌরবান্বিত করেছে। হ্যাঁ তথাকথিত নারীবাদী কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের কথাই বলতে চাইছি। তাঁর প্রকাশভঙ্গির বিচিত্রতা ও ক্ষুরধার রাজনৈতিক ও নারীবাদী বক্তব্য পাঠককে একাধারে যেমন মুগ্ধ করে, তেমনই প্রতিবাদী হয়ে ওঠারও প্রেরণা যোগায়। তাঁর নিজের কথায়,"আমি কান্না পড়ি, আগুন লিখি, নিগ্রহ দেখি, অঙ্গার খাই, লাঞ্ছিত হই, আগুন লিখি।"
    
       🎤 কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের জন্ম 1960 সালের 27 মার্চ এবং মৃত্যু 2011 সালের 28 মে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কবি সুবোধ সরকারের ঘরনী ছিলেন। আমি বিভিন্ন লেখায় প্রসঙ্গক্রমে বলেছি যে কবিদের একটা সামাজিক দায় থাকে। কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতাতেও সেই দায়ের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাই। মেয়েদের হতাশা লাঞ্ছনা  উপেক্ষা ও আর্থসামাজিক অবস্থানের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা বারবার গর্জে উঠেছে।


       🎤 1981 সালে লেখা শুরুর সাথে সাথেই কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পেশাগতভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যার অধ্যাপিকা এই কবি 1988 সালে সুকান্ত পুরস্কার, 2004 সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও 1998 সালে ভারত সরকারের জুনিয়র রাইটার ফেলোশিপ পুরস্কারে ভূষিত হন। কুড়িটি গ্রন্থের প্রণেতা এই কবির অন্যতম তিনটি কাব্যগ্রন্থ হল 'কথা মানবী কবিতা' 'পুরুষকে লেখা চিঠি' ও 'আমাকে সারিয়ে দাও ভালোবাসায়'।


      🎤 এবার তাঁর লেখা কয়েকটি কবিতা আপনাদের সকলের সামনে তুলে ধরতে চাই যাতে তাঁর প্রকাশভঙ্গির বিচিত্রতা সম্পর্কে আপনারা সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।


     🎤 মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা


স্মাইলিং বুদ্ধ / ১৮মে, ১৯৭৪


(ঐ তারিখে ভারত যে পরমাণু বোমাটি ফাটায়, তার নাম স্মাইলিং বুদ্ধ)


কোথায়, কোথায় তিনি ?
ওরা যে বলল এই মরুস্থানে তিনি হাসছেন !


আমাকে তোমরা কেন যেতে দিচ্ছ না
এত পুলিশ পাহারা, লোকজন, অস্ত্রসম্ভার !
তোমরা বুঝতে পারছ না, উপোসি আছেন তিনি
আমি এই পরমান্ন নিয়ে তাঁর কাছে যেতে চাই
কয়েক শতাব্দি ধরে খুঁজতে খুঁজতে
আজ এত দিন পরে সন্ধান পেযেছি তাঁর এই মরুদেশে


বুদ্ধপূর্ণিমার রাত
ভয়ংকর শব্দ লেগে পরমান্ন চলকে পড়ল
চারিদিকে হৈ হৈ হাততালি, জনবিস্ফোরণ
সবাই বলল, দেখো, তিনি হাসছেন


তিনি হাসছেন ! এই ভয়-শব্দ  তাঁরই হাসির |
কাকে তোরা বেদিতে বসালি
কাকে তোরা সৈন্যদল পাহারা দিচ্ছিস
এ তো আলোকসামান্য সে মানব নয় !
এত ধোঁয়া, এত শব্দ  এত সৈন্যদল দিয়ে ঘেরা যে মানুষ
তাঁর পরমান্ন আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি
ওই যারা ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে
তাঁর পরমান্ন আমি সেই সব নিরন্নকে ভাগ করে দেব |


পারমানবিক বুদ্ধ এই দেশে থাকুক উপোসি |


-----------------
তেভাগার ডায়েরি


আমি বিলাসিনীদের কাপড়ে নক্সা তুলি, সামান্য জীবিকা
পোকা আলু আর আতপ দেয় হাত ভরে
ভাসুরের কাছাকাছি এলোচুলে থাকি না কখনও


খোঁপায় জড়িয়ে নেব লাল ফিতে, কাস্তের ফলক
ক্ষেতের ফসল তিন ভাগ হবে, দুই ভাগ গৃহমূষিকের
উনুনের চার পাশে বসে হাত গরম করছি |


দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও
আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব
-------------------
বালিকা ও দুষ্টু লোক


বালিকাকে যৌনহেনস্থার দায়ে স্কুলবাসের ড্রাইভার ও হেল্পার ধৃত--
                                                   সংবাদ, আগস্ট, ২০০১


স্কুলবাসের বাচ্চা মেয়ে
সবার শেষে নামে
সঙ্গীগুলো বিদায় নিলে
তার কেন গা ঘামে !


বাসের কাকু বাসের চাচা
কেমন যেন করে
হঠাত গাড়ি থামিয়ে দিয়ে
আমায় নিয়ে পড়ে


কাকু জেঠুর মতন নয়
দুষ্টু লোক ওরা
মাগো আমার বাস ছাড়িয়ে
দাও না সাদা ঘোড়া !


দুষ্টু কাকু দুষ্টু চাচা
থাকুক না তার ঘরে
বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে কেন
অসভ্যতা করে !


এই পৃথিবী সাদা কালোয়
মন্দ এবং ভাল
তবু কেন এই জীবনে
ঘনিয়ে এল কালো ?


আমার কিছু ভাল্লাগে না
স্কুলের বাসে ভয়
মাগো তোমার পায়ে পড়ি
ওই বাসে আর নয়


আমাকে আর কিছুতেই যেন
না ছুঁতে পারে ওরা
আমাকে দাও সবুজ মাঠ
পক্ষীরাজ ঘোড়া |
--------------


অনাবাসির চিঠি


এখানে জীবন বড় মায়াময়
বদলে গিয়েছে সমাজ সময়
এখানে সুখের ঘর বানিয়েছি
তপ্ত দুপুরে সারা দিন এ সি
তবু মনে পড়ে ধূ ধূ বাংলায়
বন্ধুরা মিলে শিতে বরষায়
চায়ের কাপেই তুলেছি তুফান
রকে বসে বসে সিনেমার গান


মন খারাপের বিকেলবেলায়
একটি মেয়েকে মনে পড়ে যায়
দেশে ফেলে আসা সেই সুখস্মৃতি
ভোলা তো গেল না প্রথম পিরিতি
এ দেশে আরাম এ দেশে ডলার
ছেলে মেয়ে বৌ ফিরবে না আর
এখন এখানে নামছে শেকড়
জমিও কিনেছি দু-এক একর


এখানে অশেষ অঢেল খাবার
এখানে পিত্জা হ্যামবার্গার
তবুও মায়ের হাতের শুক্ তো
মনে পড়লেই ভিষণ দুখ তো !
এখানে বৌরা স্বয়ংসিদ্ধা
নিজে হাতে কাজ তরুণী বৃদ্ধা
তবু মনে পড়ে কলেজের সেই
ছিপছিপে রোগা তরুণীটিকেই
বুকে দাগা দিয়ে গিয়েছিল চলে
আজও ডাক দেয় স্মৃতির অতলে


এখানে সুখের ঘর বানিয়েছি
তবু মনে হয় কি যেন হল না
বুক খাঁ খাঁ করে, বলো না বলো না
সুখপাখিটিকে হারিয়ে ফেলেছি |


-------------
ভাষা


ভাষা মানে তুমি আমি
ভাষা মানে বাংলা
ভাষা মানে বরাকর
থেকে ভাতজাংলা
বাজারের দোকানের
রাস্তার এ ভাষা
কবিতার স্লোগানের
বচসার এ ভাষা
বাংলায় কথা বলি
বাংলায় ছন্দ
তাই নিয়ে এত কথা
এত কেন দ্বন্দ্ব !
আমাদের বেঁচে থাকা
দাঁড়াবার ভঙ্গি
আমাদের শিকড়ের
পিপাসার সঙ্গী
আজ যদি সেই ভাষা
পথে পথে ভিখারি
যদি তাকে তাড়া করে
নিষ্ঠুর শিকারি
তবু ঘুম ভাঙবে না
পশ্চিমবঙ্গী !
একবার জেগে ওঠো
যুদ্ধের সঙ্গী |


-------------------
আপনি বলুন, মার্কস


ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল
দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গমবোনা শুরু করেছিল
আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন করেছিল শিশু
সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে ?


আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক, কে শ্রমিক নয়
নতুনযন্ত্রের যারা মাসমাইনের কারিগর
শুধু তারা শ্রম করে !
শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল
সেই শ্রমিকগৃহিণী
প্রতিদিন জল তোলে, ঘর মোছে, খাবার বানায়
হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে রাত হলে
ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি শ্রমিক নয় !
আপনি বলুন মার্কস, শ্রম কাকে বলে !


গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আর কমরেড শুধু যার হাতে কাস্তে হাতুড়ি !
আপনাকে মানায় না এই অবিচার


কখনো বিপ্লব হলে
পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী
হবে ?


-----------------
* ঋণ স্বীকার: বাংলা নিউজ 24
ও মিলন সাগর