উত্তর ২৪ পরগণার একটা গাঁয়ে আমার শৈশব কেটেছে। গ্রামখানি ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর। তবে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য যত না তার চেয়ে অনেক বেশি বর্ণগত বৈচিত্র্য। মুসলিম পাড়া তো ছিলই, পাশাপাশি ছিল, বামুন(ব্রাহ্মণ) পাড়া, গোয়ালা পাড়া, মাহেশ্য পাড়া, কায়স্থ পাড়া, কাহার(জেলে) পাড়া, মুচি পাড়া ইত্যাদি প্রায় সব বর্ণের বসবাস। কয়েক ঘর নাপিতও ছিল।


      যাই হোক, বামুন পাড়ায় আমাদের প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক থাকতেন। বলাই বাহুল্য, সে সময় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ছিল যৎসামান্য। সেই সামান্য বেতন আর যজমানি করে কোন রকমে তাঁর সংসার চলতো। অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন ধনীর দুলালী। ফলে, সং সারে অশান্তি লেগেই থাকতো। এখন, সেই ভর্ৎ সনা-ক্লিষ্ট জীবন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কি না জানি না, এক দিন হঠাৎ মা মা বলে বিকট চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সে কথা শুনে এ পাড়া সে পাড়া থেকে লোক জড় হতে শুরু করলো। আমরাও সব দল বেঁধে গেলাম।অনেকক্ষণ পর তিনি উঠে বসলেন, তারপর যেন ঘোরের মধ্যে অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে কখনো স্মিত হাস্যে কখনো বা রাগত স্বরে এর ওর উদ্দেশ্যে নানা রকম মন্তব্য করে যেতে লাগলেন।সবাই বলাবলি করতে লাগলো, ঠাকুর ভর করেছে।


          তার পরদিনই তাঁর বাড়ির উঠোনের এক কোণে একটা ছোট্ট মন্দির গড়ে উঠলো। সেখানে প্রতি শনিবার তিনি ধ্যানে বসতেন, অনেক ক্ষণ পর ঠাকুর এসে ভর করতেন তাঁর উপর, তখন দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষজনের যাবতীয় মুশকিল আসানের উপায় বলে দিতেন।দর্শনার্থীরাও দু হাত ভরে প্রণামী দিয়ে যেতেন।বলাই বাহুল্য, এর পর অনটন শব্দটি তাঁর বাড়িতে আর প্রবেশ করে নি, গিন্নীর অমৃত ভাষণও আর শুনতে হয় নি শিক্ষক মশাইকে।


          এই পর্যন্ত পড়ার পর যদি ভাবেন, শিরোনাম দিয়েছি শিয়ালদা, আর কাহিনী লিখছি হাওড়ার, তাহলে আপনাকে একটুও দোষ দেওয়া যাবে না। এবার তাহলে আসল কথায় আসা যাক।


          বেশিরভাগ দিনই কোন না কোন কবিতার আইডিয়া হঠাৎই মাথায় এসে যায়। কিন্তু এক এক দিন কিছুতেই আসতে চায় না। সেদিন ছোটবেলার ঐ শিক্ষক মশাইয়ের কথা মনে পড়ে। একেকদিন দেখেছি, ধ্যানে বসার পর অল্প সময়ের মধ্যেই ভর শুরু হয়ে যেত। আবার এক একদিন  অনেকক্ষণ পর শুরু হতো। সত্যি সত্যি ঠাকুর ভর করুক আর নাই করুক, আমার মনে হতো, কিছু একটা ভর নিশ্চয় করতো  তাঁর মাথায়।যাই হোক, ঐ শিক্ষক মশাই যেমন ঠাকুরকে মাথায় আনার জন্য ধ্যানে বসতেন আমিও তেমনি যেদিন কবিতা সহজে আসতে চায় না সেদিন ধ্যানে বসি, আধবোজা চোখে যাবতীয় পার্থিব চিন্তা দূর করে পদ্মাসনে চুপচাপ বসে থাকি কিছুক্ষণ।আর সত্যি সত্যিই কে যেন নিঃশব্দ উচ্চারণে সাজিয়ে দিয়ে যায় শব্দের পর শব্দ। তৎক্ষণাৎ লিখে ফেলি কবিতাটি। তারপর বার বার পড়তে থাকি আর ভাবতে থাকি, সত্যিই কি আমিই লিখেছি কবিতাটি!!