আমি কামলা,প্রবাসী কামলা।
আমার বাবা পুবের জমি থেকে একটুকরো বিক্রি করে আমাকে কামলা বানিয়েছে।
এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনেই বুঝে নিয়েছি,আমি কামলা।
কামলাদের কি আর মান ইজ্জত থাকে?
ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে
আমার পয়সায় দেয়া বেতনধারীদের স্যার স্যার বলতে বলতে আমি
একসময় উড়োজাহাজে গিয়ে বসি।
জানালার পাশে বসে বাইরে চোখ রাখি।
ছোট্ট জানালা দিয়ে আমি আমার পুরো দেশকে আরেকবার দেখে নেই।
চোখের কোনা ভিজে উঠে
কখনো বা টুপ টুপ করে কয়েক ফোটা পানি ঝরেও পড়তে চায়।
পরনের কাপড় দিয়ে চোখের পানি গায়ে মেখে নেই।
বিমানের কার্পেটে পড়তে দেই না।কেননা
চোখ থেকে নির্গত এই ক'ফোটা পানি বড়ই মমতার,দেশের প্রতি ভালবাসার।
নিজেকে অনেক ভারী মনে হয়।
মনে হয়, কে যেন বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখেছে।
নিজেকে হালকা করার জন্যে লম্বা এক দম নিয়ে আসতে করে ছেড়ে দেই।
বুকের চাপটা একটু কমে আসে।
উড়োজাহাজটাও ততক্ষণে আকাশে উড়তে ডানা মেলে দেয়।


সাদা কালো মেঘ ভেদ করে উড়োজাহাজ চলতে থাকে আকাশের গা ঘেসে
আর,আমার মন
উড়োজাহাজের গতি থেকেও অধিক তীব্রতায় ছুটে চলে
কখনো দেশে,কখনো গন্তব্যে।


বাড়ি থেকে কামলার সার্টিফিকেট সাথে নিয়ে এসেছি।
তাই, গন্তব্যে আসার পরদিন ভোর থেকেই শুরু আমার কাজ।
খেয়ে, না খেয়ে প্রতিদিন কাজ করেই চলেছি।
কখনো বা ঠিকমত ঘুমাতে পারি না।
অসুখ-বিসুখেও নিস্তার নেই,কাজে যেতে হবে।
আমি যে কামলা।


অর্ধ শতাধিক তাপমাত্রায়,উত্তপ্ত বালু ভূমিতে আমি কাজ করি,
মাইনাস আট দশ ডিগ্রী তাপমাত্রার বরফ আচ্ছাদিত পথে কাজের সন্ধানে আমি হেটে চলি।
কায়িক শ্রম, অবিশ্রান্ত গতর খাটুনির পর মাস শেষে আমার হাতে যখন মাইনেটা আসে তখন আমি কি করি জানেন?
আমি ছুটে চলি কোনো এক মানি এক্সচেঞ্জে।
বাবা কিংবা ভাইয়ের নামে টাকাটা অর্ডার করি।
আমার মুখে হাসির গোলাপ প্রস্ফুটিত হয়,
আমার অন্তরে পরম প্রশান্তি অনুভব করি।
প্রচণ্ড খররোদের পর এক পশলা বৃষ্টির পরশ পেয়ে পত্র পল্লবে যে প্রাণ ফিরে আসে
আমার মাঝেও আমি সেই প্রাণ ফিরে পাই।
আমি আবার কাজে উদ্যমি হই।
কেননা, আমি যে কামলা।


আপনি ভাবছেন,এই টাকা বুঝি আমার বাপ ভাইকেই শুধু দিয়েছি।
না, জনাব।
এখানেই মস্তবড় ভুল অংক কষছেন আপনি।
এই টাকা দেশের জন্য রেমিটেন্স হয়,
এই টাকা দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করে,
এই টাকা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে,
এই টাকা দেশের দারিদ্রতা বিমোচনে ভুমিকা রাখে,
এই টাকা আপনার মত হাজারো অফিসারের বেতন ভাতা হয়।


অতএব, প্লিজ আমাকে গালি দিবেন না।
সত্যিই আমি কামলা,প্রবাসী কামলা।


প্রবাসী কামলাদের মন যেন স্বেত শুভ্র নরম কাশফুল।
দিল কানায় কানায় ভরপুর ভালবাসায়।
দুঃখ, অপমান বুকের জমিনে কবর দেয়ার মত সীমাহীন ধৈর্য যেন প্রকৃতিগত।
শত ঝড়-জঞ্জায় ওরা বুক পেতে দেয় অসীম সাহসিকতায়।
হাজারো দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ওরা হাসতে পারে অকৃত্রিম।
শুধু এই কামলাদের উদাস চাহনিটা বড়ই করুন।
আর
আর,ওরা চরম মিথ্যুক।
হাসতে হাসতে ওরা মিথ্যা বলতে পারে।
ঈদের দিনে না খেয়ে কাজে গিয়ে বাড়িতে ফোন দিয়ে বলে খুরমা পোলাও খেয়েছে।
এক শার্টে তিন ঈদ পার করেও মাকে বলে খুব সুন্দর জামা কিনেছে এবারে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ভোগলেও বলে, না সামান্য সর্দি জ্বর হয়েছে কমে যাবে।
লাশ হয়ে দেশে ফেরার আগে পর্যন্ত এই কামলারা দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবে- নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে।